‘নয়া বন্দোবস্তে’ স্বাগতম, বাংলাদেশ যাবে কোথায়?

‘নয়া বন্দোবস্তে’ স্বাগতম, বাংলাদেশ যাবে কোথায়?
বিশ্বক্রম এখন নতুন পথে হাঁটছে। প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

সেই যে কবে শুরু হলো, আর থামার জো নেই। মহামারির মতো দিনের পর দিন কেবল ‘আক্রান্ত এলাকা’ বেড়েই চলেছে। কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। মহামারিও তো শেষ হয়, দাবালনও একসময় নিভে যায়। কিন্তু জোঁকের মতো সেই পুরোনো দুর্গতি একদম আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে আছে পৃথিবীর গায়। আর বাংলাদেশের মতো দেশগুলোও নতুন ‘ভাবনায়’।

বলা হচ্ছে যুদ্ধের কথা। কোনো কিছুতেই যাকে আটকানো যাচ্ছে না। এমনকি একের পর এক নিষেধাজ্ঞাও যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে নেতাদের সরাতে পারছে না কোনোমতেই।

আর যে ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ, সেই ক্ষমতাও আজ আর একা কারও হাতে নেই। বিশ্ব ক্রমে পাল্টে যাওয়ার এই আলাপ তো নতুন নয়। তবে এই ক্ষমতা, বিশ্বক্রম ও নিষেধাজ্ঞা–কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছে না। যুদ্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য এক প্রভাবে।

এই আলাপে সবচেয়ে আলোচিত টার্ম হচ্ছে ‘ডিস্ট্রিবিউটেড মাল্টিপোলারিটি’। এর মানে, আধুনিক বিশ্বে ক্ষমতা এখন আর একক কারও হাতে নেই। বরং বহু কেন্দ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা ক্রমশই কমছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, চলমান দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ব্যর্থতা। আর তাতে ছোট দেশগুলোর নতুন সুযোগ।

সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক মতামত কলামে রাজনৈতিক বিশ্লেষক পেইমান সালেহি বলছেন, বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্ষমতা বলতে বোঝাত সেসব রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব, যারা দ্রুত যুদ্ধে জিততে পারত। তারা শত্রু দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারত। দুই বিশ্বযুদ্ধে এমনটাই দেখেছে বিশ্ব।

নিজেদের সীমানার বাইরেও রাজনৈতিক ফলাফল চাপিয়ে দিতে পারত এসব দেশ। কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সেই সংজ্ঞা আর কার্যকর নয়। আর এ কারণেই যুদ্ধ আর শেষ হয় না।

যুদ্ধ কেন ফুরায় না?

আধুনিক যুদ্ধগুলো এখন আর দ্রুত বা চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে আসছে না। বরং দীর্ঘ এক ক্লান্তিকর অচলাবস্থা তৈরি করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কথাই বলা যেতে পারে। রাশিয়া দ্রুত বিজয় আশা করেছিল। কিন্তু তিন বছর পেরিয়েও কোনো পক্ষ তাদের ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।

ইসরায়েল চেয়েছিল দ্রুত হামাসকে নির্মূল করতে। কিন্তু যুদ্ধটি আঞ্চলিক প্রভাবসহ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে পরিণত হয়েছে। এখন কি এর কোনো স্পষ্ট সমাধান আছে? আপাতত মনে হচ্ছে, নেই।

প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং নির্ভুল অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে এখন কোনো রাষ্ট্রকে হারানো বেশ কঠিন। তবে কোনো দেশকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে তাদের ওপর নিজেদের রাজনৈতিক ফলাফল চাপিয়ে দেওয়া আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। ক্ষমতা এখন বিজয়ের চেয়ে প্রতিরোধের দিকে ঝুঁকছে।

নিষেধাজ্ঞা কেন কাজ করে না?

চীনা সংবাদমাধ্যম সিনহুয়ার এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, একসময় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার একটি যৌক্তিক হাতিয়ার হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু রাশিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা, কিউবা ও উত্তর কোরিয়ার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নিষেধাজ্ঞার ফলাফল ভিন্ন গল্প বলছে। যদিও এই রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার রাজনৈতিক প্রভাব প্রায়শই উল্টো। নিষেধাজ্ঞা বরং রাষ্ট্রগুলোকে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য করছে।

আরেকটি বিষয় বলতেই হবে, প্রযুক্তির উত্থান। ডিজিটাল মুদ্রা, বার্টার নেটওয়ার্ক এবং বিকল্প ব্যাংকিং ব্যবস্থার কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রাষ্ট্রগুলোর জন্য বিকল্প পথে হাঁটার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ব্রিকস এবং সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) মতো জোটগুলো নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট দুর্বলতা কমাতে সাহায্য করছে। অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা কার্যকর করা কঠিন হওয়ায় ক্ষমতার প্রভাব প্রশমিত হচ্ছে।

ব্রিকস সম্মেলন। ছবি: রয়টার্স
ব্রিকস সম্মেলন। ছবি: রয়টার্স

অবস্থাটা কী

সংবাদমাধ্যম কিয়েভ ইন্টারন্যাশনালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একক কোনো শক্তি (আমেরিকা, চীন বা রাশিয়া) একা আর বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বিশ্ব রাজনীতি এখন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করছে। এসব দেশ আর পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধের কাঠামোর মধ্যে পড়ে না।

একটু তাকানো যাক, আসলে বিশ্বে কী হচ্ছে।

ভারত ব্রিকস জোটে রয়েছে। আবার আমেরিকার সঙ্গে নিরাপত্তা সম্পর্কও জোরদার করছে। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম এশিয়ায় পশ্চিমা মিত্রদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। সৌদি আরব আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেও চীনের সঙ্গে কাজ করছে। পাকিস্তান আমেরিকার সঙ্গেও সম্পর্ক রেখেছে, চীনের সঙ্গেও। আবার আমেরিকার মিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তাও দিচ্ছে।

এই রাষ্ট্রগুলো কিন্তু চিরাচরিত ‘সুইং পাওয়ার’ নয়। বরং তাদের নিজস্ব কৌশলগত এজেন্ডা আছে। এতেই বোঝা যায়, মাঝারি শক্তিগুলো এখন বিশ্ব রাজনীতিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব রাখছে।

কী করবে বাংলাদেশ

এই নতুন বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের মতো ছোট ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলো একটি জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক পেইমান সালেহি। যদিও তিনি আলাদা করে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেননি। তবুও পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশকে বাদ দেওয়া যায় না। এ ছাড়া সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের মতামত কলামে তার এ-সংক্রান্ত লেখায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর উল্লেখ রয়েছে।

চিত্রটা এমন–একদিকে বড় শক্তিগুলোর কাছে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব বেড়েছে। ফলে তারা বিনিয়োগ ও সহযোগিতার জন্য আগ্রহী। অন্যদিকে, এই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা একটি পুরোপুরি আলাদা ও স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশ এখন প্রায়শই বিভিন্ন বড় শক্তির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলে। চীন থেকে অবকাঠামোতে বড় বিনিয়োগ গ্রহণের পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রাখছে।

যদিও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব সীমাবদ্ধতা আছে। তবুও এই ‘ডিস্ট্রিবিউটেড মাল্টিপোলারিটি’ তাদের জন্য একটি সুযোগও এনেছে। একাধিক শক্তিকে সঙ্গে রেখে সর্বোত্তম সুবিধা আদায়ের জন্য তাদের আলোচনা সক্ষমতা কিছুটা বেড়েছে।

সারকথা, পুরোনো বিশ্বব্যবস্থা পুরোপুরি বিলীন হয়নি। কিন্তু তা আর একচেটিয়া কাঠামো হিসেবে কাজ করছে না। ক্ষমতা এখন বিকেন্দ্রীকৃত।

এই নতুন ব্যবস্থায় সামরিক শক্তি বা অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা থাকলেই কেউ এসে পায়ে পড়বে না। বরং, প্রযুক্তি যখন ছড়িয়ে পড়ছে, আঞ্চলিক শক্তিগুলো যখন নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরছে, তখন ক্ষমতা আর ফলাফল চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে নেই। এটি এখন বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সঠিক পথে চলার কৌশল আয়ত্ত করার মধ্যে নিহিত। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো সেই সুযোগের ফায়দা নিতে পারবে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

সম্পর্কিত