ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাতের সূচনা উনিশ শতকের শেষ ভাগে, যখন ইউরোপে নির্যাতনের শিকার হয়ে ইহুদিরা জায়নবাদী মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেয়। ১৮৯৭ সালে প্রথম জায়নবাদী কংগ্রেসে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য স্থির করা হয়। ধীরে ধীরে হাজার হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে আসতে থাকেন, যা স্থানীয় জনমিতি ও সামাজিক কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশদের বেলফোর ঘোষণা (১৯১৭) ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এর ফলে ইহুদি অভিবাসন আরও ত্বরান্বিত হয়। ১৯২৯ সালে জেরুজালেমের ওয়েইলিং ওয়াল বা বুরাক দেয়াল নিয়ে প্রথম বড় ইহুদি–মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এর পর ইহুদি মিলিশিয়া গড়ে ওঠে, যারা ১৯৪৬ সালে কিং ডেভিড হোটেলে বোমা হামলা চালায় এবং ১৯৪৮ সালে দেইর ইয়াসিন গ্রামে গণহত্যা চালায়।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এর পরদিনই মিসর, জর্ডান, সিরিয়া ও ইরাক যুদ্ধ শুরু করে, যা ইতিহাসে প্রথম আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ইসরায়েল অস্ত্রের জোগান পায় চেকোস্লোভাকিয়া থেকে এবং শেষ পর্যন্ত টিকে যায়। এই যুদ্ধেই বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী জীবনে ঠেলে দেওয়া হয়।
পরবর্তী দশকগুলোতে একের পর এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। এই সময়ে আরও লাখো ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়। ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপুর যুদ্ধে মিসর কিছুটা ভূমি পুনরুদ্ধার করলেও ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্র গঠনের পথে এগোতে পারেনি।
১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আংশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা হলেও পশ্চিম তীর ও গাজার বেশির ভাগ অংশ ইসরায়েলের সামরিক নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়। ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়, যা পাঁচ বছর স্থায়ী ছিল এবং উভয় পক্ষের হাজারো প্রাণহানি ঘটায়।
২০০৬ সালে হামাস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর থেকে গাজা ইসরায়েলি অবরোধ ও ধারাবাহিক সামরিক হামলার শিকার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়।
২০১৮ সালের ১৪ মে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংকট নতুন মাত্রা পায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয় গাজায়। তখন ৫৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয় ইসরায়েলি হামলায়। আহত হয় ৩ হাজারের বেশি। ওই ঘটনার পর শতাধিক ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলি ও বোমায় নিহত হয়। ফিলিস্তিনিরা তাদের এই বিক্ষোভের নাম দেয় ‘গ্রেট মার্চ টু রিটার্ন’। অর্থাৎ নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার মিছিল।
২০২১ জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে আবারও সংঘাত হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের পাঠানো বিশেষ দূতের মাধ্যমে হওয়া আলোচনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। নিরস্ত হয় ইসরায়েলি বাহিনী। বরাবরের মতোই ক্ষয়ক্ষতির পাল্লা ফিলিস্তিনিদের দিকেই ভারী ছিল।
এই সংঘাতের একটি রূপই এখনকার ইসরায়েল–হামাস যুদ্ধ। গাজার সংকীর্ণ ভূখণ্ডে প্রতিদিন আছড়ে পড়ছে বোমা, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ছে শিশু ও নারী-পুরুষ। এ যুদ্ধে গাজায় সাড়ে ৬৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, মিডল ইস্ট মনিটর