তারেক রহমান কবে দেশে ফিরছেন?

তারেক রহমান কবে দেশে ফিরছেন?
পরিবারের সঙ্গে তারেক রহমান। ফাইল ছবি: ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও তার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে। এর আগে দলের নেতারা জানিয়েছিলেন, তারেক রহমান নভেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরবেন। কিন্তু তিনি ফেরেননি। দল থেকে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরামর্শের জন্য যুক্তরাজ্য ও চীন থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা এসে সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন করছেন।

এরপর মায়ের গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তারেক রহমানের দেশে না আসা নিয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হতে থাকে। তখন তিনি নিজেই ফেসবুক বার্তায় জানিয়ে দিলেন, তার দেশে আসার সিদ্ধান্তের বিষয়টি অবারিত ও তার একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।

এই প্রেক্ষাপটে জনমনে প্রশ্ন উঠল, তাহলে তারেক রহমানের দেশে আসার ক্ষেত্রে কি মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে? এরকম ঝুঁকি থাকলে সেটা দূর করার দায়িত্ব সরকারেরই। একজন সাধারণ নাগরিকও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তাহলে দেশের অন্যতম বড় দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধানের বিষয়ে তারা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, তারা মনে করেন না নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে, তারপরও তিনি দেশে আসলে তার প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

ইতোমধ্যে সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার জন্য এসএসএফ সুবিধা দিয়েছে। আইন অনুযায়ী এটি কেবল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা এই সুবিধা পেয়ে থাকেন। ধারণা করা হচ্ছে, তারেক রহমান দেশে ফিরলেও একই সুবিধা পাবেন।

তবে রাজনৈতিক মহলে যেই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো, তারেক রহমান কি শুধু নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণেই দেশে আসছেন না? না, এর পেছনে ভূরাজনৈতিক কোনো বিষয় জড়িত আছে?

আবার কেউ কেউ আইনি জটিলতার কথাও বলেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার তার পাসপোর্ট বাতিল করে দিলে তিনি রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক হয়ে পড়েন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সেনা সমর্থিত সরকারের সময় তারেক রহমান ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে দেশ ছেড়ে লন্ডনে যেতে বাধ্য হন এবং সেই থেকে তিনি সেখানেই আছেন।

সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, তারেকের দেশে ফিরতে কোনো বাধা নেই। তিনি চাইলে সরকার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ট্রাভেল পাস দেবে। সমস্যাটি কেবল ট্রাভেল পাসের নয়, আরও অনেক কিছু। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জন আছে।

লন্ডনে থাকাকালে পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হলে তারেক রহমান নবায়নের জন্য আবেদন করলেও আওয়ামী লীগ সরকার তা অনুমোদন না করে পাসপোর্ট আটকে রাখে। এ অবস্থায় তারেক যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা ব্যক্তিদের স্বাগতিক দেশের কিছু শর্ত পালন করতে হয়। বিএনপির ঘনিষ্ঠ সূত্র বলেছে, তারেক রহমানের দেশে ফিরতে সেটা কোনো বাধা নয়। রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকলেও তিনি সেখানকার নাগরিকত্ব নেননি। বিএনপির আরেকটি সূত্র বলেছে, তারেক রহমানের দেশে আসার বিষয়ে সবুজ সংকেত পাওয়া যায়নি।

তারেক রহমান ও মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: ফেসবুক
তারেক রহমান ও মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: ফেসবুক

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরপরই তারেক রহমানের দেশে আসা উচিত ছিল। এখন যেসব প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলো হয়তো তখন উঠত না। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ আমলের মামলা থাকলেও সেটা প্রতিপালনের পরিবেশ ছিল না।

তারেক রহমান কখন দেশে আসবেন, সেটা একান্তই তার বিষয়। তারপরও, তিনি যেহেতু রাজনীতিক বা পাবলিক ফিগার, তাকে জনমতের বিষয়টিও ভাবতে হয়।

চরচার খবর অনুযায়ী, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি মেডিকেল বোর্ড এখনো অনুমোদন করেনি। এ কারণে সিদ্ধান্তও নেওয়া যাচ্ছে না। তবে লন্ডনে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ‘প্রস্তুত আছে’ বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের বাইরে গতকাল শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, “মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা জরুরি সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওই মুহূর্তে বেগম খালেদা জিয়ার ফ্লাই করা ঠিক হবে না। সেজন্য বিদেশ নেওয়ার বিষয়টি বিলম্বিত হচ্ছে।”

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে জানানো হয়েছিল, শুক্রবার মধ্যরাত বা পরদিন ভোরের দিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হবে।

গত ২৩ নভেম্বর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড বিএনপি নেত্রীর চিকিৎসা দিচ্ছেন। এই মেডিকেল বোর্ডে সদস্য হিসেবে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানও রয়েছেন।

দল থেকে বলা হয়েছে, তারেক রহমান লন্ডন থেকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি সার্বক্ষণিক তদারক করছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য যদি লন্ডন যান এবং সেখানে চিকিৎসা সেবা নিতে দু-এক মাস সময় লাগে, তখন কি তারেক রহমান সেখানে থাকবেন, না দেশে এসে নির্বাচনি কাজে নিজেকে যুক্ত করবেন? এতদিন তিনি দূর থেকে দল পরিচালনা করলেও নির্বাচনি প্রচার সেখান থেকে সেভাবে করা সম্ভব নয়।

বিএনপির একদা মিত্র ও বর্তমানে নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান সিলেটের জনসভায় বলেছেন, “যারা এত দিন নির্বাচন নির্বাচন করে জনগণকে বেহুঁশ করে তুলেছিলেন, এখন তারা কেউ কেউ ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন, তারা যে সমস্ত কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে পরিচালনা করছেন, বাংলাদেশের জনগণ তাদের আগামী নির্বাচনে লাল কার্ড দেখানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছেন।” এটা যে বিএনপিকে ইঙ্গিত করেই বলা, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

বিষয়টি নিয়ে বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “বিএনপি কখনোই নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলেনি। তফসিল ঘোষণার পরপরই তারেক রহমান দেশে আসবেন, সেটা দলীয় প্রধান দেশে থাকুন কিংবা চিকিৎসার জন্য তাকে বাইরে যেতে হোক। ম্যাডামের চিকিৎসার জন্য নির্বাচন যেমন পিছিয়ে যাবে না, তেমনি নির্বাচনের জন্য চিকিৎসার কাজও ব্যাহত হবে না।”

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন নির্বাচন কমিশনকে সাক্ষাতের সময় দিয়েছেন ১০ ডিসেম্বর। সেক্ষেত্রে ওই দিন রাতে বা পরদিন তফসিল ঘোষণা হতে পারে। তাহলে কি তারেক রহমান ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে দেশে ফিরবেন? বিএনপি যে বিজয় মাসের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল, তাতে ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে মহাসমাবেশ করার কথা আছে। যদিও দলীয় প্রধানের অসুস্থতার কারণে তারা কর্মসূচি স্থগিত রেখেছেন।

সোহরাব হাসান: সম্পাদক, চরচা

সম্পর্কিত