দেশের ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৫৮ শতাংশ সম্পদ

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
দেশের ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৫৮ শতাংশ সম্পদ
পৃথিবীর বহু অঞ্চলে মানুষের জীবন স্থবির হয়ে আছে, আর সম্পদ ও ক্ষমতা ক্রমশ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এক জায়গায়। ছবি: রয়টার্স

দেশের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের কাছে মোট সম্পদের ৫৮ শতাংশ আছে। আর নিচের তলার ৫০ শতাংশ হাতে আছে মাত্র ৫ শতাংশ সম্পদ।

সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বিশ্ব বৈষম্য প্রতিবেদন ২০২৬’-এ এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্পদ বৈষম্যের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩১তম।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈষম্যের দিক থেকে গোটা বিশ্বের অবস্থা একই রকম প্রায়। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের মোট ব্যক্তিগত সম্পদের তিন-চতুর্থাংশ মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত। আয় বৈষম্যের চিত্রও খুব ভিন্ন নয়। মোট আয়ের ৯০ শতাংশেরও বেশি পায় ৫০ শতাংশ মানুষ, আর বাকি অর্ধেক মানুষ মিলে পায় ১০ শতাংশেরও কম।

প্যারিসভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব 'ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২৬' শীর্ষক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট সম্পদের ২৪ শতাংশ রয়েছে সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষের হাতে।

বিশ্বের ৪০টি দেশের আয় ও সম্পদ বণ্টনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে আয় বৈষম্যের চেয়ে সম্পদ বৈষম্য অনেক বেশি তীব্র।

আয় বৈষম্যের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২৬তম। এখানে শীর্ষ ১০ শতাংশ মানুষ মোট আয়ের ১৯ শতাংশ পেয়ে থাকে। মধ্যবর্তী ৪০ শতাংশ পেয়ে থাকে ৪০ শতাংশ এবং বাকি অর্ধেক মানুষ উপার্জন করে মোট আয়ের ৪১ শতাংশ।

তবে সম্পদ বৈষম্যের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩১তম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের কাছে মোট সম্পদের ৫৮ শতাংশ আছে, মাঝের ৪০ শতাংশ জনগণ ভোগ করে ৩৭ শতাংশ সম্পদ এবং বাকি অর্ধেক মানুষের কাছে মোট সম্পদের মাত্র ৫ শতাংশ।

২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছর নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে এই প্রতিবেদন। ২০২৬ সালের প্রতিবেদনটি এমন একটি সময়ে প্রকাশিত হলো, যখন পৃথিবীর বহু অঞ্চলে মানুষের জীবন স্থবির হয়ে আছে, আর সম্পদ ও ক্ষমতা ক্রমশ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এক জায়গায়।

আয় বৈষম্য ও সম্পদ বৈষম্যের মধ্যে পার্থক্য

সম্পদ ও আয়ের মধ্যে ধারণাগত কিছু পার্থক্য আছে। সর্বোচ্চ সম্পদশালী সবসময় সর্বোচ্চ আয়কারী নন, আবার একজন ব্যক্তি যা উপার্জন করে, তা সবসময় জমা রাখেন না। এই বিষয়টি আয় ও সম্পদের সংজ্ঞার মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে।

সম্পদ বলতে বোঝায় একজন মানুষের কাছে গচ্ছিত বস্তুর মূল্যমান, যেমন সঞ্চয়, বিনিয়োগ বা সম্পত্তি, ঋণ বাদ দেওয়ার পর যা থাকে।

২০২৫ সালে বিশ্বের ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল বৈশ্বিক সম্পদের ৭৫ শতাংশ। মধ্যবিত্ত ৪০ শতাংশের হাতে ছিল ২৩ শতাংশ, আর নিম্নবিত্ত অর্ধেক মানুষের নিয়ন্ত্রণে ছিল মাত্র ২ শতাংশ।

‘বিশ্ব বৈষম্য প্রতিবেদন ২০২৬’-এ উঠে এসেছে বিশ্বের আয় ও সম্পদের বৈষম্যের বর্তমান চিত্র। ছবি: ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২৬ সৌজন্যে
‘বিশ্ব বৈষম্য প্রতিবেদন ২০২৬’-এ উঠে এসেছে বিশ্বের আয় ও সম্পদের বৈষম্যের বর্তমান চিত্র। ছবি: ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২৬ সৌজন্যে

১৯৯০-এর দশক থেকে বিলিয়নিয়ার ও সেন্টি-মিলিয়নিয়ারদের সম্পদ প্রতি বছর প্রায় ৮ শতাংশ করে বেড়েছে, যা বিশ্বের দরিদ্রতম অর্ধেক মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির হারের প্রায় দ্বিগুণ। অন্যদিকে, দরিদ্রতম মানুষের সম্পদ সামান্য বাড়লেও শীর্ষ স্তরে সম্পদের দ্রুত সঞ্চয় সেই অগ্রগতিকে ছাপিয়ে গেছে। ফলে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যেখানে অতি ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর কাছে আছে বিপুল সম্পদ, আর কোটি কোটি মানুষ মৌলিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য সংগ্রাম করছে।

আয় পরিমাপ করা হয় কর পরিশোধের আগের উপার্জন অনুযায়ী, তবে পেনশন বা বেকার ভাতা সংক্রান্ত অর্থমূল্য এখানে বাদ দেওয়া হয়। ২০২৫ সালে বৈশ্বিক আয়ের ৫৩ শতাংশ পেয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ। মধ্যবর্তী ৪০ শতাংশের আয় ছিল ৩৮ শতাংশ, বাকি অর্ধেক মানুষ অর্জন করেছে মাত্র ৮ শতাংশ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি পৃথিবীতে মোট ১০ জন মানুষ থাকত এবং বৈশ্বিক মোট আয় হতো ১০০ ডলার, তবে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি পেতেন ৫৩ ডলার, পরবর্তী চারজন মিলিয়ে পেতেন ৩৮ ডলার, আর বাকি পাঁচজন মিলে মাত্র ৮ ডলার ভাগ করে নিতে হতো।

অঞ্চলভেদে বৈষম্যের চিত্র

বিশ্বের একেক অঞ্চলে বৈষম্যের ধরন একেক রকম। একজন ব্যক্তির আয় ও সম্পদ কিছু সূচকের ওপর নির্ভর করে।

২০২৫ সালে উত্তর আমেরিকা ও ওশেনিয়ার মানুষের গড় সম্পদ মোট বৈশ্বিক গড়ের ৩৩৮ শতাংশ ছিল। এই দুই মহাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল। এই দুই অঞ্চলের আয়ের গড় বৈশ্বিক মোট আয়ের গড়ের ২৯০ শতাংশ, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এর পর ছিল ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়া। অন্যদিকে সাব-সাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল অংশ বৈশ্বিক গড়ের অনেক নিচে অবস্থান করছে।

আয় বৈষম্যের অবস্থা

বিশ্বের সর্বোচ্চ আয়-বৈষম্যের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখানে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ সেদেশের মোট আয়ের ৬৬ শতাংশ উপার্জন করে, আর অর্ধেকেরও বেশি জনগণ পায় মাত্র ৬ শতাংশ। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে, যেমন ব্রাজিল, মেক্সিকো, চিলি ও কলম্বিয়ায় একই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। সেখানে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ প্রায় ৬০ শতাংশ আয় দখলে রাখে।

বাংলাদেশ ও চীনে তুলনামূলকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো দেখা গেলেও ভারত, থাইল্যান্ড ও তুরস্কে কিছু আয় বৈষম্য আছে। ছবি: রয়টার্স
বাংলাদেশ ও চীনে তুলনামূলকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো দেখা গেলেও ভারত, থাইল্যান্ড ও তুরস্কে কিছু আয় বৈষম্য আছে। ছবি: রয়টার্স

ইউরোপীয় দেশগুলো তুলনামূলকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ। সুইডেন ও নরওয়েতে নিচের ৫০ শতাংশ মানুষ মোট আয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ পায়, আর শীর্ষ ১০ শতাংশ পায় আয়ের ৩০ শতাংশেরও কম।

অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, জাপান ও যুক্তরাজ্যসহ বহু উন্নত অর্থনীতির দেশ তালিকার মাঝামাঝি অবস্থান করছে। এসব দেশে শীর্ষ ১০ শতাংশ মোট আয়ের প্রায় ৩৩ থেকে ৪৭ শতাংশ উপার্জন করে, আর নিচের অর্ধেক মানুষ পায় ১৬ থেকে ২১ শতাংশ।

এশিয়ায় আয়ের বণ্টন মিশ্র ধরনের। বাংলাদেশ ও চীনে তুলনামূলকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো দেখা গেলেও ভারত, থাইল্যান্ড ও তুরস্কে কিছু আয় বৈষম্য আছে। এসব দেশে শীর্ষ ১০ শতাংশ মোট আয়ের অর্ধেকেরও বেশি দখল করে।

সম্পদ বৈষম্যের অবস্থা

সম্পদ বৈষম্যের ক্ষেত্রেও তালিকার শীর্ষে আছে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখানে শীর্ষ ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ব্যক্তিগত সম্পদের ৮৫ শতাংশ কেন্দ্রীভূত। আর নিচের অর্ধেক মানুষের সম্পদের শতকরা পরিমাণ ঋণাত্মক; অর্থাৎ, তাদের ঋণ সম্পদের চেয়ে বেশি। রাশিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়, যেখানে ধনী শ্রেণি মোট সম্পদের ৭০ শতাংশ বা তার বেশি দখলে রাখে, দরিদ্ররা পায় মাত্র ২-৩ শতাংশ।

ইতালি, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও নেদারল্যান্ডসের মতো ইউরোপীয় দেশগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক ভারসাম্যপূর্ণ। এসব দেশে মাঝখানের ৪০ শতাংশ জনগণ প্রায় ৪৫ শতাংশ সম্পদের মালিক এবং নিম্নবর্তী অর্ধেক মানুষ কিছুটা বেশি অংশ পেলেও, শীর্ষ ১০ শতাংশ এখানেও আধিপত্যশীল।

আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো ধনী দেশেও বৈষম্য বিদ্যমান। এসব দেশে শীর্ষ ১০ শতাংশ মোট সম্পদের অর্ধেকের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে, আর নিচের অর্ধেক মানুষের হাতে থাকে মাত্র ১ থেকে ৫ শতাংশ।

আমেরিকা সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল হলেও সেখানেও সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য বিদ্যমান। ছবি: রয়টার্স
আমেরিকা সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল হলেও সেখানেও সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য বিদ্যমান। ছবি: রয়টার্স

চীন, ভারত, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোগুলোতেও বৈষম্য প্রকট। এসব দেশে শীর্ষ ১০ শতাংশ মোট সম্পদের প্রায় ৬৫ থেকে ৬৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, যা আসলে সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার ইঙ্গিত দেয়।

সূত্র: আল জাজিরা

সম্পর্কিত