গণতন্ত্র চাপের মুখে যেসব দেশে

থমাস কারোথার্স ও ম্যাকেঞ্জি ক্যারিয়ার
থমাস কারোথার্স ও ম্যাকেঞ্জি ক্যারিয়ার
গণতন্ত্র চাপের মুখে যেসব দেশে
অনেক দেশেই গণতন্ত্র ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। ছবি: রয়টার্স

গত কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক গণতন্ত্র একটি দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। কোনো কোনো দেশ গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধার ও নবায়নের সম্ভাব্য পথে যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। আবার অনেক দেশেই গণতন্ত্র ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।

২০২৫ সালের শেষে এসে বিশ্বের দশটি দেশের দিকে তাকালে, এই অস্বস্তিকর অনিশ্চয়তা বোঝা যায়। প্রথম দলে রয়েছে পাঁচটি গণতান্ত্রিক দেশ, যে দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভিন্ন কারণে গণতন্ত্র ঝুঁকির উদ্বেগজনক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় দলে থাকা পাঁচটি দেশ বর্তমানে শক্তিশালী স্বৈরাচারবিরোধী বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর কিছু ক্ষেত্রে তা অর্থবহ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথ খুলে দিয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী নেতৃত্ব ও বিরোধী শক্তির দ্বন্দ্বের ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সব দেশেই স্বৈরাতন্ত্রবিরোধিতা ক্রমেই বাড়ছে।

এই দশটি উদাহরণ মূল্যায়ন করলে আগামী বছরে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের অগ্রগতি না পশ্চাদপসরণ–কোনটি ঘটতে পারে, তা নির্ধারণে কিছুটা সহায়ক হবে। জেনে নেওয়া যাক গণতন্ত্র চাপের মুখে থাকা দেশগুলোর ব্যাপারে।

আমেরিকা

এই তালিকায় সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশটি অবশ্যই আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার দল প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত করেছেন। আইন প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থার মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। এবং বিচার বিভাগ, কংগ্রেস ও অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলোকে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতে দিচ্ছেন না। এর মাধ্যমে আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্র ক্রমশ দুর্বল রূপ নিচ্ছে। পাশাপাশি নির্বাচন পরিচালনায় সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং মুক্ত গণমাধ্যম, নাগরিক কর্মী, আইন সংস্থা ও বিরোধী কণ্ঠস্বর নানাভাবে দমন করা হচ্ছে।

ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে একাধিকবার বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকায় গণতান্ত্রিক অবক্ষয় কতটা ঘটেছে এবং ট্রাম্পের মেয়াদের বাকি সময়ে তা কতদূর যাবে–এ নিয়ে পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক চলছে। কেউ কেউ মনে করেন, আমেরিকা ইতোমধ্যেই “প্রতিযোগিতামূলক স্বৈরতন্ত্রে” প্রবেশ করেছে। আবার অন্যদের মতে, গণতান্ত্রিক রীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলো চাপের মুখে থাকলেও এখনো মোটামুটি অক্ষত আছে। ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডের ফলে শুধু আমেরিকা নয়, তার অনুদার নীতির প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে।

২০২৬ সালের নভেম্বরের মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা। আমেরিকার গণতন্ত্র কতটা স্থিতিস্থাপকতা দেখাতে পারছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হয়ে উঠবে এই নির্বাচন।

ফ্রান্স

আপাতদৃষ্টিতে ফ্রান্সের গণতন্ত্র স্থিতিশীল মনে হলেও দীর্ঘদিন ধরে জমে ওঠা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো জনসাধারণের গভীর হতাশা উসকে দিচ্ছে। তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণ ও বাজেট সমস্যার ফলে দেশটি বর্তমানে রাজনৈতিক অকার্যকারিতার জালে আটকে আছে। গত দুই বছরে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তিত হয়েছে। ২০২৭ সাল পর্যন্ত মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখো চরমভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছেন, তার জনপ্রিয়তা আগের তুলনায় কম, এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পারছেন না। এই পরিস্থিতি ফ্রান্সে গণতন্ত্রের প্রতি জনসমর্থন দুর্বল করে দিচ্ছে। লে মঁদ–এর মতে, “৩৫ বছরের নিচে প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ মনে করে, গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা অন্তত সমানভাবে ভালো হতে পারে।”

এখানেও গণতন্ত্র কতটা ঝুঁকির মুখে রয়েছে–এ নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এক পক্ষের আশঙ্কা, দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থা চরম ডানপন্থার উত্থান এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা দখলের দিকে নিয়ে যাবে, এবং ক্ষমতায় এলে হাঙ্গেরি বা আমেরিকার ডানপন্থীদের মতো গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতা প্রদর্শন করবে। অন্যরা মনে করেন, যদিও এই অচলাবস্থা গুরুতর গণতান্ত্রিক ক্ষয়ের প্রতিফলন, তবুও মূল ঝুঁকিটি গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের চেয়ে শাসনগত অকার্যকারিতার মধ্যেই বেশি নিহিত।

ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রে আগে থেকেই প্রাথমিক ক্ষয়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। ২০২৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট প্রাবো সুবিয়ান্তো তা আরও তীব্র করে তুলেছেন। তিনি দেশের শাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর প্রভাব বাড়িয়ে তুলেছেন। সমালোচনামূলক গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডিজিটাল দমন-পীড়ন ব্যবহার করেছেন। এবং সহিংস দমন ও বিক্ষোভকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে নাগরিক পরিসর সংকুচিত করেছেন।

এসব পদক্ষেপের জবাবে একের পর এক বিক্ষোভের ঢেউ দেখা দিয়েছে। বছরের শুরু থেকে শিক্ষার্থীরা বারবার সংগঠিত হয়ে রাস্তায় নেমেছে বাজেট সংকোচন, সরকারি পদে সশস্ত্র বাহিনীর বাড়তি উপস্থিতি এবং মধ্য জাভার একটি অঞ্চলে কর বৃদ্ধিসহ নানা অভিযোগের প্রতিবাদে। আগস্টের শেষ দিকে, ইন্দোনেশীয় আইনপ্রণেতাদের বিতর্কিত বেতন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে চলা বিক্ষোভের সময় পুলিশের একটি গাড়ির ধাক্কায় এক মোটরসাইকেল চালক নিহত হলে, সারা দেশে প্রতিবাদ আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। এসব বিক্ষোভের পেছনে আছে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং পুলিশি সহিংসতা নিয়ে দীর্ঘদিনের জমে থাকা জনক্ষোভ। তখন নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে আরও কয়েকজন নিহত হন।

এই গণআন্দোলনের মধ্যেই প্রাবো বিক্ষোভকারীদের “রাষ্ট্রদ্রোহী” আখ্যা দেন এবং দাবি করেন যে, এসব বিক্ষোভের পেছনে বিদেশি শক্তির প্রভাব রয়েছে। জনরোষ প্রশমিত করতে তিনি কিছু সংস্কার প্রস্তাবে সম্মত হন, যার মধ্যে পুলিশি সহিংসতার ঘটনাগুলোর তদন্তের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে “১৭+৮” শিরোনামে উপস্থাপিত বিক্ষোভকারীদের বহু দাবি এখনো পূরণ হয়নি, এবং বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এখনও রয়ে গেছে। এই ক্ষয় ও প্রতিবাদের চক্র কীভাবে এগোবে এবং ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদান আদৌ প্রাবো রক্ষা করতে পারবেন কিনা—তা একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রয়েছে।

আর্জেন্টিনা

আর্জেন্টিনার গণতন্ত্র বর্তমানে এক অস্বাভাবিকভাবে জটিল ও সংকটপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ২০২৩ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই দেশটির দীর্ঘদিনের স্থবিরতা, ঘাটতি পূরণ ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো ভাঙার লক্ষ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার এগিয়ে নিচ্ছেন। তার সমর্থকদের মতে, আর্জেন্টিনার গণতন্ত্র দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার জন্য এসব সংস্কার অব্যাহত থাকা এবং সফল হওয়া অত্যাবশ্যক। তবে মিলেইর নেতৃত্বে কিছু অসহিষ্ণু এবং কখনও কখনও প্রকাশ্যভাবে গণতন্ত্রবিরোধী উপাদানও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জনবিক্ষোভে সহিংস দমন-পীড়ন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করা—যা তার বিরোধী পক্ষ ও কিছু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের মতে আর্জেন্টিনার গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।

দেশটির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি। প্রথমত, মিলেইর অর্থনৈতিক কর্মসূচি কি নতুন ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথ তৈরি করতে পারবে? এর সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে ২০২৫ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হওয়া মধ্যবর্তী নির্বাচনে তার সাফল্যকে তিনি আদৌ দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সমর্থনে রূপ দিতে পারেন কি না। বিশেষ করে যখন তার কর্মসূচি চলমান অস্থিরতার সঙ্গে জড়িত। একই সঙ্গে, যদি তার অর্থনৈতিক কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থন কমতে শুরু করে, সে ক্ষেত্রে তিনি আরও অসহিষ্ণু বা এমনকি প্রকাশ্যভাবে গণতন্ত্রবিরোধী পথে এগিয়ে যান কি না–এটিও আর্জেন্টিনার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন।

কেনিয়া

গত দেড় বছরে কেনিয়ার গণতন্ত্র আগের চেয়ে নড়বড়ে হয়ে গেছে। উচ্চ কর, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, উচ্চ বেকারত্ব এবং সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামা তরুণদের ওপর সরকারের সহিংস দমন-পীড়ন এর প্রধান কারণ। প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোর অবস্থান ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা এবং রাজনৈতিক কঠোরতার ইঙ্গিত দেয়, যা জনসাধারণ বা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপকে বাধাগ্রস্ত করে। তরুণ বিক্ষোভকারীদের “সন্ত্রাসী” আখ্যা দেওয়া, ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার সীমিত করা, এবং সমালোচক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগ করেছেন। অস্থিরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রুটোর বাহিনীর সহিংস প্রতিক্রিয়া অর্থনৈতিক উত্তেজনাকে আরও তীব্র করেছে, ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এখন বিনিয়োগে আগ্রহী নন।

আফ্রিকা মহাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও কেনিয়াকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো, তবে রুটোর নেতৃত্বের গতিপথ এই বাস্তবতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। এ বছরের নভেম্বরের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম, সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং ঘুষের অভিযোগ উঠেছে যা কেনিয়ার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর থাকা চাপকে স্পষ্ট করে তুলেছে।

২০২৭ সালে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আগামী বছরটি হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা; ক্ষমতা ধরে রাখতে রুটো তার কর্তৃত্ববাদী কৌশল কঠোর করবেন, নাকি জনসমর্থন ধরে রাখতে দেশকে গণতান্ত্রিক শাসনের দিকে নিয়ে যাবেন–সেটাই এখন দেখার বিষয়।

লেখা: ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের নিবন্ধ

লেখক: থমাস ক্যারোথার্স হার্ভে ভি. ফাইনবার্গ চেয়ার ফর ডেমোক্রেসি স্টাডিজ ও ডেমোক্রেসি, কনফ্লিক্ট, অ্যান্ড গভর্নেন্স প্রোগ্রামের পরিচালক।

ম্যাকেনজি ক্যারিয়ার ডেমোক্রেসি, কনফ্লিক্ট, অ্যান্ড গভর্নেন্স প্রোগ্রামের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট

সম্পর্কিত