আরমান ভূঁইয়া

২৯ নভেম্বর। সন্ধ্যা। মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পের রাস্তায় গুরুতর জখম অবস্থায় পড়ে আছেন ভূঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ মুমুর্ষূ অবস্থায় ঘটনাস্থলে থেকে তাকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। বর্তমানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিবীড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন বুনিয়া সোহেলের নামে রয়েছে ১০টি হত্যা মামলাসহ ৪০টি মামলা।
গত ১৭ বছর ধরে ক্যাম্পে চলা মাদক কারবারে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা বুনিয়া সোহেলের সঙ্গে সঙ্গে তার সাম্রাজ্যও এখন আইসিইউতে। ক্যাম্পের মাদক সাম্রাজ্যের দখল এখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী তিন গ্রুপের। সাম্রাজ্যই বটে।
ঢাকার অন্যতম মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। দিনরাত এখানে চলে ইয়াবা, গাঁজা ও হেরোইন বেচাকেনা। ক্যাম্পের অন্তত ২৫টি স্পটে প্রতিদিন প্রায় দেড় কোটি টাকারও বেশি মাদক বিক্রি হয়। মাদক কারবারকে কেন্দ্র করে গত কয়েক যুগ ধরে ক্যাম্পজুড়ে সংঘর্ষ, আধিপত্যের লড়াই, খুনোখুনি চলছে। বিশেষ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেড় বছরে একাধিক সংঘর্ষে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
গত ১৭ বছর ধরে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক-সম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিলেন ভূঁইয়া সোহেল ওরফে ‘বুনিয়া সোহেল’। ক্ষমতার পালাবদলের পর সম্প্রতি ক্যাম্পের ভেতরে বুনিয়াকে সরিয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে তিনটি শক্তিশালী গ্রুপ—‘পিচ্চি রাজা’, ‘পার মনু’ ও ‘চুয়া সেলিম’।
ঘটনার শুরু যেভাবে
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকেই বুনিয়া সোহেলকে সরাতে পিচ্চি রাজা, পার মনু ও চুয়া সেলিমের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ যৌথভাবে চেষ্টা করছিল। ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে বুনিয়া ও প্রতিপক্ষ গ্রুপের একাধিক সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন নিহত হয়। গত নভেম্বরে ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর একাধিক অভিযানে বুনিয়া সোহেলের আস্তানা থেকে প্রায় দুই শতাধিক ককটেল বোমা ও বোমা তৈরির প্রায় পাঁচ কেজি সংঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ গত ২৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে বুনিয়ায় আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ৭৭টি ককটেল, ৪০০ গ্রাম গানপাউডার, ককটেল তৈরির সরঞ্জাম, ৪টি সামুরাই তলোয়ার, ইয়াবা, হেরোইন ও সোয়া ৪ লাখ টাকা জব্দ করা। এ সময় পালিয়ে যায় বুনিয়া সোহেল ও লোকজন। এর দু মাস আগে সেপ্টেম্বর মাসে পৃথক দুটি অভিযানে সোহেলের আস্তানা ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা থেকে মাদক, অস্ত্রসহ প্রায় ৫ কোটি টাকা জব্দ করে যৌথবাহিনী।
অভিযোগ রয়েছে, নভেম্বরে সেনা অভিযানের পর বুনিয়া সোহেলের আস্তানায় লুটপাট চালায় পিচ্চি রাজা, পার মনু ও চুয়া সেলিম গ্রুপের সদস্যরা। এরপর গত শনিবার (২৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ক্যাম্পের চার ও সাত নম্বর ব্লকে পিচ্চি রাজার নেতৃত্বে তিন গ্রুপের যৌথ হামলার শিকার হন কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও শীর্ষ মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেল। তিনটি গ্রুপের অন্তত অর্ধশতাধিক সদস্য এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে তাকে। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেদিনই তাকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। ওই রাতেই ক্যাম্প থেকে বুনিয়া সোহেলের দুই সহযোগী নয়ন ও রাব্বিকে ৭.৬৫ এমএম ক্যালিবারের দুটি বিদেশি পিস্তল ও ছয় রাউন্ড গুলিসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কাজী রফিকুল ইসলাম চরচাকে বলেন, “শনিবার সন্ধ্যায় বুনিয়া সোহেলকে উদ্ধারের পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর অবস্থার অবনতি হলে থানার পাশে সিটি হাসপাতালের আইসিইউতে রেখে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।”
পুলিশ বলছে, বুনিয়া সোহেলের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানাসহ ঢাকার বিভিন্ন থানায় ৩৮ থেকে ৪০টি মামলা রয়েছে। শুধু গত দেড় বছরেই মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় তার গ্যাং অন্তত সাত থেকে আটটি হত্যা করেছে।
মো. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “জেনেভা ক্যাম্পের মাদককারবারি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঠেকাতে আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। অনেক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদককারবারিদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
কিন্তু বিষয়টি এতটা সহজ নয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, যৌথবাহিনীর টানা অভিযানের পর ক্যাম্পের ভেতরেই বুনিয়া সোহেল প্রতিপক্ষের হামলায় গুরুতর আহত হলে শুরু হয় নতুন সমীকরণ।

ক্যাম্পের আধিপত্যে তিন গ্রুপের জোট
পুলিশ ও ক্যাম্প সূত্রে জানা যায়, বুনিয়ার নেটওয়ার্ক এখন কার্যত ছিন্নভিন্ন। জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে বর্তমানে অন্তত পাঁচটি গ্রুপ সক্রিয়। তবে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে তিনটি গ্রুপ। এসব গ্রুপে রয়েছে আবার শতাধিক উপগ্রুপ, যার নিয়ন্ত্রণে থাকে লিডার। প্রত্যেক লিডারের আছে ১০–১২ সদস্যের পৃথক দল। এ ছাড়া প্রতিটি উপগ্রুপের মাঠপর্যায়ে মাদক বিক্রির জন্য আলাদা আলাদা ‘সেল টিম’ রয়েছে।
বুনিয়া সোহেলের একক নেতৃত্বে পরিচালিত এই গ্রুপগুলো এখন তিনটি গ্রুপের ছাতার নিচে সংঘবদ্ধ। এই তিনটি গ্রুপ জোট তৈরির মধ্য দিয়ে পুরো ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করছে।
পিচ্চি রাজা গ্রুপ
বর্তমানে ক্যাম্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রুপ এটি। মাত্র ২৯ বছর বয়সী ‘পিচ্চি রাজার’ নেতৃত্বে তার গ্রুপের অন্যতম সদস্যরা হলেন–আদি, নবাব, শাহজাদা, ফাইজান, বেলুন, রুবেল, রনি ওরফে ম্যানেজার রনি, নাটা সুমন, সুজন, ব্যাটারি কামরান, হীরা ও মঈন পিচ্চি। এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ মূলত ক্যাম্পের ১, ২, ৪ ও ৭ নম্বর সেক্টরে।
পার মনু গ্রুপ
গালকাটা মনু ওরফে পার মনুর নেতৃত্বে গ্রুপটি পরিচালিত হয়। তার সঙ্গে আছেন লালন, ইমতিয়াজ, শাহ আলম, বাঙালি রনি, বাবু সামির, ফেরদৌস, ফয়সাল, ফারুক, শুভ ও বিজয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ক্যাম্পের ৪, ৫, ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টর।
চুয়া সেলিম গ্রুপ
চুয়া সেলিমের নেতৃত্বে কাজ করে সাজিদ, নেতা সামির, উল্টা সালাম, হামজা, ফেকু, লালি সোহেল, আল আমিন, শাহজাহান সাজ্জু, চেম্বার রাজ ও সুলতান। তাদের প্রভাব ১, ২ ও ৪ নম্বর সেক্টরে। এ তিন গ্রুপই এখন ক্যাম্পের পুরো মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।
মাদক নিয়ে সংঘর্ষ দেড় বছরে চরমে
ক্যাম্পে মাদককারবারি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়। কয়েক যুগ ধরেই প্রাণঘাতী এ সংঘর্ষ চলে আসছে। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পালাবদলের পর থেকে ক্যাম্পের ভেতরে আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। সে সময় থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা সংঘর্ষে দুই শিশুসহ আটজনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে পাঁচজনই ছিল বিভিন্ন গ্রুপের সদস্য।
এসব সংঘর্ষের পর পুলিশ, সেনাবাহিনী ও র্যাবের যৌথ অভিযানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, মোল্লা বশির, নওশাদ, আলতাফ, কামাল, মোহাম্মদ দ্বীন, নিয়াজসহ দেড় শতাধিকের বেশি মাদককারবারি ও সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের কয়েক মাসের মধ্যে চুয়া সেলিম ও বুনিয়া সোহেলসহ শীর্ষ অনেক মাদককারবারী জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর আবার শুরু হয় সংঘর্ষ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ইবনে মিজান চরচাকে বলেন, “ক্যাম্পের মাদককারবারি ও সংঘর্ষ ঠেকাতে আমরা প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছি। সাতটি প্রবেশমুখে বিশেষ চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। মাদক ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে চেক করা হচ্ছে।”
ক্যাম্প সূত্রে জানা যায়—প্রায় ১৪ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা জেনেভা ক্যাম্পে ছোট ছোট খুপরি ঘরে অন্তত ৫০ হাজারের বেশি পরিবারের বাস। এ ক্যাম্পে রয়েছে ৯টি ব্লক বা সেক্টর। ভেতরে ঢুকলে মনে হবে শহরের মধ্যে এক ক্ষুদ্র শহর। প্রতিটি সেক্টরে রয়েছে দু–তিনটি মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী গ্রুপ।
ক্যাম্পে বর্তমানে পাঁচটি গ্রুপ সক্রিয়। এর মধ্যে ‘পিচ্চি রাজা’, ‘পার মনু’ ও ‘চুয়া সেলিম’ গ্রুপই পুরো ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া ‘শান্তি’ গ্রুপ ও ‘বুনিয়া সোহেল’ গ্রুপও রয়েছে। তবে ক্যাম্পে বিএনপির নেতা হিসেবে পরিচিত শাহনেওয়াজ আহমাদ খান সানুর নিয়ন্ত্রণাধীন শান্তি গ্রুপের সিংহভাগ সদস্য বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। আবার অনেকেই পলাতক। ফলে এই গ্রুপ ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করতে পারছে না। শান্তি গ্রুপের অন্যতম সদস্যরা হলেন–পোপলা মুন্না, আজম, ইমরান, রহমত, বারকাত, সাঈদ, তানভীর, নয়ন ও কামরান ওরফে পলাল অন্যতম।
অন্যদিকে বুনিয়া সোহেলের গ্রুপে রয়েছে–বুনিয়ার ভাই টুনটুন, কলিম জাম্বু, মোটকি সীমার দুই ছেলে আরিফ ও ফরিদ, গোলাম জিলানী ও তার ছেলে নাসিম। গত বছরের নভেম্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানের সময় বুনিয়ার ভাই রানা পালাতে গিয়ে বৈদ্যতিক শর্টসাকির্টে নিহত হন। এর একমাস পর তার আরেক ভাই রাজন ক্যাম্পের ভেতরেই আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে বুনিয়া সোহেলের অন্যতম সদস্য আরিফ, ফরিদসহ একাধিক সদস্য তার প্রতিপক্ষ গ্রুপে যোগ দেয়।

সর্বশেষ বুনিয়া সোহেলের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে তার সাম্রাজ্য পতনের বিষয়টি এখন দৃশ্যমান। এই সুযোগে জেনেভা ক্যাম্পে শুরু হয়েছে নতুন ক্ষমতার খেলা। পিচ্চি রাজা, পার মনু ও চুয়া সেলিম গ্রুপের যৌথ দাপটে এখন একটি নতুন ‘সম্রাজ্য’ দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ইবনে মিজান বলেন, “চিহ্নিত মাদককারবারিদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান চলমান। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। শুধু পুলিশ নয়—র্যাব ও সেনাবাহিনীও সমন্বিতভাবে কাজ করছে।”
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়লেও মাদকবাণিজ্যের মূল উৎস এখনো অক্ষত। ক্যাম্পের ভেতর-বাইরে যত্রতত্র মাদক বিক্রি হয়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এত চেকপোস্ট সত্ত্বেও সীমান্ত পেরিয়ে কীভাবে দেশে মাদক ঢুকছে?
ক্যাম্পে থাকা বিহারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানি জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশনস কমিটি (এসপিজিআরসি)। এই সংগঠনের আহ্বায়ক ও ক্যাম্পের ভেতরের নন-লোকাল জুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষক সৈকত আলী মাস্টার চরচাকে বলেন, “ক্যাম্পে মাদক আসা ঠেকানো যায় না—এটা ঠিক না। বাইরেই খোলা বাজার চলছে। আসল প্রশ্ন হলো– সীমান্ত দিয়ে এসব আসছে কীভাবে? সরকার চাইলে মাদক পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব।”
সেনাবাহিনী-পুলিশ যৌথ অভিযানের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। আগের তুলনায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও মাদকের মূল সাপ্লাই চেইন অক্ষুণ্ন থাকায় পরিস্থিতি আবারও অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
এসপিজিআরসির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইকবাল জানান, তারা গত ২৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে ক্যাম্পসংক্রান্ত একটি স্মারকলিপি দেন। তিনি বলেন, “আমাদের অভিযোগ, সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও মাদকবাণিজ্যের বিষয়গুলো বিস্তারিত জানিয়েছি। এরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান জোরদার করেছে।”
এমনিতে জেনেভা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নানা সময়েই সংঘর্ষ হলেও এর মাত্রা গত দেড় বছরে বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হওয়া হঠাৎ বদলকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, “জেনেভা ক্যাম্প বহু বছর ধরে অপরাধপ্রবণ একটি ‘ইকোলজিক্যাল জোন’ হিসেবে পরিচিত। ক্ষমতার পালাবদলে সেখানে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নতুন করে সংঘর্ষ সূত্রপাত হওয়াটাই স্বাভাবিক বিষয়। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে ক্যাম্পে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে অপরাধ সংঘটন তুলনামূলক সহজ এবং স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।”
এ ক্ষেত্রে এ ধরনের অপরাধ ও তার নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সংযোগের বিষয়টিও তুলে ধরেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, “ক্যাম্পের দুর্বল সামাজিক কাঠামোকে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে এসেছে। ক্ষমতার পালাবদলের সময় ক্যাম্পের তরুণদের একটি অংশ খুব সহজেই মাদক চোরাচালান, অস্ত্র পরিবহন ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। কারণ তাদের জীবিকা ও পুনর্বাসনের বিকল্প ব্যবস্থা নেই। ফলে ক্যাম্পটিতে একটি স্থায়ী পেশাদার অপরাধী শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রলোভনে দ্রুত সক্রিয় হয় এবং এলাকাটিকে একটি বৃহৎ অপরাধচক্রের অধীনে রাখে।”

২৯ নভেম্বর। সন্ধ্যা। মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পের রাস্তায় গুরুতর জখম অবস্থায় পড়ে আছেন ভূঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ মুমুর্ষূ অবস্থায় ঘটনাস্থলে থেকে তাকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। বর্তমানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিবীড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন বুনিয়া সোহেলের নামে রয়েছে ১০টি হত্যা মামলাসহ ৪০টি মামলা।
গত ১৭ বছর ধরে ক্যাম্পে চলা মাদক কারবারে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা বুনিয়া সোহেলের সঙ্গে সঙ্গে তার সাম্রাজ্যও এখন আইসিইউতে। ক্যাম্পের মাদক সাম্রাজ্যের দখল এখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী তিন গ্রুপের। সাম্রাজ্যই বটে।
ঢাকার অন্যতম মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। দিনরাত এখানে চলে ইয়াবা, গাঁজা ও হেরোইন বেচাকেনা। ক্যাম্পের অন্তত ২৫টি স্পটে প্রতিদিন প্রায় দেড় কোটি টাকারও বেশি মাদক বিক্রি হয়। মাদক কারবারকে কেন্দ্র করে গত কয়েক যুগ ধরে ক্যাম্পজুড়ে সংঘর্ষ, আধিপত্যের লড়াই, খুনোখুনি চলছে। বিশেষ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেড় বছরে একাধিক সংঘর্ষে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
গত ১৭ বছর ধরে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক-সম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিলেন ভূঁইয়া সোহেল ওরফে ‘বুনিয়া সোহেল’। ক্ষমতার পালাবদলের পর সম্প্রতি ক্যাম্পের ভেতরে বুনিয়াকে সরিয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে তিনটি শক্তিশালী গ্রুপ—‘পিচ্চি রাজা’, ‘পার মনু’ ও ‘চুয়া সেলিম’।
ঘটনার শুরু যেভাবে
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকেই বুনিয়া সোহেলকে সরাতে পিচ্চি রাজা, পার মনু ও চুয়া সেলিমের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ যৌথভাবে চেষ্টা করছিল। ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে বুনিয়া ও প্রতিপক্ষ গ্রুপের একাধিক সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন নিহত হয়। গত নভেম্বরে ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর একাধিক অভিযানে বুনিয়া সোহেলের আস্তানা থেকে প্রায় দুই শতাধিক ককটেল বোমা ও বোমা তৈরির প্রায় পাঁচ কেজি সংঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ গত ২৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে বুনিয়ায় আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ৭৭টি ককটেল, ৪০০ গ্রাম গানপাউডার, ককটেল তৈরির সরঞ্জাম, ৪টি সামুরাই তলোয়ার, ইয়াবা, হেরোইন ও সোয়া ৪ লাখ টাকা জব্দ করা। এ সময় পালিয়ে যায় বুনিয়া সোহেল ও লোকজন। এর দু মাস আগে সেপ্টেম্বর মাসে পৃথক দুটি অভিযানে সোহেলের আস্তানা ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা থেকে মাদক, অস্ত্রসহ প্রায় ৫ কোটি টাকা জব্দ করে যৌথবাহিনী।
অভিযোগ রয়েছে, নভেম্বরে সেনা অভিযানের পর বুনিয়া সোহেলের আস্তানায় লুটপাট চালায় পিচ্চি রাজা, পার মনু ও চুয়া সেলিম গ্রুপের সদস্যরা। এরপর গত শনিবার (২৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ক্যাম্পের চার ও সাত নম্বর ব্লকে পিচ্চি রাজার নেতৃত্বে তিন গ্রুপের যৌথ হামলার শিকার হন কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও শীর্ষ মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেল। তিনটি গ্রুপের অন্তত অর্ধশতাধিক সদস্য এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে তাকে। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেদিনই তাকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। ওই রাতেই ক্যাম্প থেকে বুনিয়া সোহেলের দুই সহযোগী নয়ন ও রাব্বিকে ৭.৬৫ এমএম ক্যালিবারের দুটি বিদেশি পিস্তল ও ছয় রাউন্ড গুলিসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কাজী রফিকুল ইসলাম চরচাকে বলেন, “শনিবার সন্ধ্যায় বুনিয়া সোহেলকে উদ্ধারের পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর অবস্থার অবনতি হলে থানার পাশে সিটি হাসপাতালের আইসিইউতে রেখে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।”
পুলিশ বলছে, বুনিয়া সোহেলের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানাসহ ঢাকার বিভিন্ন থানায় ৩৮ থেকে ৪০টি মামলা রয়েছে। শুধু গত দেড় বছরেই মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় তার গ্যাং অন্তত সাত থেকে আটটি হত্যা করেছে।
মো. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “জেনেভা ক্যাম্পের মাদককারবারি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঠেকাতে আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। অনেক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদককারবারিদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
কিন্তু বিষয়টি এতটা সহজ নয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, যৌথবাহিনীর টানা অভিযানের পর ক্যাম্পের ভেতরেই বুনিয়া সোহেল প্রতিপক্ষের হামলায় গুরুতর আহত হলে শুরু হয় নতুন সমীকরণ।

ক্যাম্পের আধিপত্যে তিন গ্রুপের জোট
পুলিশ ও ক্যাম্প সূত্রে জানা যায়, বুনিয়ার নেটওয়ার্ক এখন কার্যত ছিন্নভিন্ন। জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে বর্তমানে অন্তত পাঁচটি গ্রুপ সক্রিয়। তবে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে তিনটি গ্রুপ। এসব গ্রুপে রয়েছে আবার শতাধিক উপগ্রুপ, যার নিয়ন্ত্রণে থাকে লিডার। প্রত্যেক লিডারের আছে ১০–১২ সদস্যের পৃথক দল। এ ছাড়া প্রতিটি উপগ্রুপের মাঠপর্যায়ে মাদক বিক্রির জন্য আলাদা আলাদা ‘সেল টিম’ রয়েছে।
বুনিয়া সোহেলের একক নেতৃত্বে পরিচালিত এই গ্রুপগুলো এখন তিনটি গ্রুপের ছাতার নিচে সংঘবদ্ধ। এই তিনটি গ্রুপ জোট তৈরির মধ্য দিয়ে পুরো ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করছে।
পিচ্চি রাজা গ্রুপ
বর্তমানে ক্যাম্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রুপ এটি। মাত্র ২৯ বছর বয়সী ‘পিচ্চি রাজার’ নেতৃত্বে তার গ্রুপের অন্যতম সদস্যরা হলেন–আদি, নবাব, শাহজাদা, ফাইজান, বেলুন, রুবেল, রনি ওরফে ম্যানেজার রনি, নাটা সুমন, সুজন, ব্যাটারি কামরান, হীরা ও মঈন পিচ্চি। এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ মূলত ক্যাম্পের ১, ২, ৪ ও ৭ নম্বর সেক্টরে।
পার মনু গ্রুপ
গালকাটা মনু ওরফে পার মনুর নেতৃত্বে গ্রুপটি পরিচালিত হয়। তার সঙ্গে আছেন লালন, ইমতিয়াজ, শাহ আলম, বাঙালি রনি, বাবু সামির, ফেরদৌস, ফয়সাল, ফারুক, শুভ ও বিজয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ক্যাম্পের ৪, ৫, ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টর।
চুয়া সেলিম গ্রুপ
চুয়া সেলিমের নেতৃত্বে কাজ করে সাজিদ, নেতা সামির, উল্টা সালাম, হামজা, ফেকু, লালি সোহেল, আল আমিন, শাহজাহান সাজ্জু, চেম্বার রাজ ও সুলতান। তাদের প্রভাব ১, ২ ও ৪ নম্বর সেক্টরে। এ তিন গ্রুপই এখন ক্যাম্পের পুরো মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।
মাদক নিয়ে সংঘর্ষ দেড় বছরে চরমে
ক্যাম্পে মাদককারবারি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়। কয়েক যুগ ধরেই প্রাণঘাতী এ সংঘর্ষ চলে আসছে। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পালাবদলের পর থেকে ক্যাম্পের ভেতরে আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। সে সময় থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা সংঘর্ষে দুই শিশুসহ আটজনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে পাঁচজনই ছিল বিভিন্ন গ্রুপের সদস্য।
এসব সংঘর্ষের পর পুলিশ, সেনাবাহিনী ও র্যাবের যৌথ অভিযানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, মোল্লা বশির, নওশাদ, আলতাফ, কামাল, মোহাম্মদ দ্বীন, নিয়াজসহ দেড় শতাধিকের বেশি মাদককারবারি ও সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের কয়েক মাসের মধ্যে চুয়া সেলিম ও বুনিয়া সোহেলসহ শীর্ষ অনেক মাদককারবারী জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর আবার শুরু হয় সংঘর্ষ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ইবনে মিজান চরচাকে বলেন, “ক্যাম্পের মাদককারবারি ও সংঘর্ষ ঠেকাতে আমরা প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছি। সাতটি প্রবেশমুখে বিশেষ চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। মাদক ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে চেক করা হচ্ছে।”
ক্যাম্প সূত্রে জানা যায়—প্রায় ১৪ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা জেনেভা ক্যাম্পে ছোট ছোট খুপরি ঘরে অন্তত ৫০ হাজারের বেশি পরিবারের বাস। এ ক্যাম্পে রয়েছে ৯টি ব্লক বা সেক্টর। ভেতরে ঢুকলে মনে হবে শহরের মধ্যে এক ক্ষুদ্র শহর। প্রতিটি সেক্টরে রয়েছে দু–তিনটি মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী গ্রুপ।
ক্যাম্পে বর্তমানে পাঁচটি গ্রুপ সক্রিয়। এর মধ্যে ‘পিচ্চি রাজা’, ‘পার মনু’ ও ‘চুয়া সেলিম’ গ্রুপই পুরো ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া ‘শান্তি’ গ্রুপ ও ‘বুনিয়া সোহেল’ গ্রুপও রয়েছে। তবে ক্যাম্পে বিএনপির নেতা হিসেবে পরিচিত শাহনেওয়াজ আহমাদ খান সানুর নিয়ন্ত্রণাধীন শান্তি গ্রুপের সিংহভাগ সদস্য বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। আবার অনেকেই পলাতক। ফলে এই গ্রুপ ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করতে পারছে না। শান্তি গ্রুপের অন্যতম সদস্যরা হলেন–পোপলা মুন্না, আজম, ইমরান, রহমত, বারকাত, সাঈদ, তানভীর, নয়ন ও কামরান ওরফে পলাল অন্যতম।
অন্যদিকে বুনিয়া সোহেলের গ্রুপে রয়েছে–বুনিয়ার ভাই টুনটুন, কলিম জাম্বু, মোটকি সীমার দুই ছেলে আরিফ ও ফরিদ, গোলাম জিলানী ও তার ছেলে নাসিম। গত বছরের নভেম্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানের সময় বুনিয়ার ভাই রানা পালাতে গিয়ে বৈদ্যতিক শর্টসাকির্টে নিহত হন। এর একমাস পর তার আরেক ভাই রাজন ক্যাম্পের ভেতরেই আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে বুনিয়া সোহেলের অন্যতম সদস্য আরিফ, ফরিদসহ একাধিক সদস্য তার প্রতিপক্ষ গ্রুপে যোগ দেয়।

সর্বশেষ বুনিয়া সোহেলের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে তার সাম্রাজ্য পতনের বিষয়টি এখন দৃশ্যমান। এই সুযোগে জেনেভা ক্যাম্পে শুরু হয়েছে নতুন ক্ষমতার খেলা। পিচ্চি রাজা, পার মনু ও চুয়া সেলিম গ্রুপের যৌথ দাপটে এখন একটি নতুন ‘সম্রাজ্য’ দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ইবনে মিজান বলেন, “চিহ্নিত মাদককারবারিদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান চলমান। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। শুধু পুলিশ নয়—র্যাব ও সেনাবাহিনীও সমন্বিতভাবে কাজ করছে।”
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়লেও মাদকবাণিজ্যের মূল উৎস এখনো অক্ষত। ক্যাম্পের ভেতর-বাইরে যত্রতত্র মাদক বিক্রি হয়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এত চেকপোস্ট সত্ত্বেও সীমান্ত পেরিয়ে কীভাবে দেশে মাদক ঢুকছে?
ক্যাম্পে থাকা বিহারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানি জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশনস কমিটি (এসপিজিআরসি)। এই সংগঠনের আহ্বায়ক ও ক্যাম্পের ভেতরের নন-লোকাল জুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষক সৈকত আলী মাস্টার চরচাকে বলেন, “ক্যাম্পে মাদক আসা ঠেকানো যায় না—এটা ঠিক না। বাইরেই খোলা বাজার চলছে। আসল প্রশ্ন হলো– সীমান্ত দিয়ে এসব আসছে কীভাবে? সরকার চাইলে মাদক পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব।”
সেনাবাহিনী-পুলিশ যৌথ অভিযানের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। আগের তুলনায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও মাদকের মূল সাপ্লাই চেইন অক্ষুণ্ন থাকায় পরিস্থিতি আবারও অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
এসপিজিআরসির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইকবাল জানান, তারা গত ২৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে ক্যাম্পসংক্রান্ত একটি স্মারকলিপি দেন। তিনি বলেন, “আমাদের অভিযোগ, সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও মাদকবাণিজ্যের বিষয়গুলো বিস্তারিত জানিয়েছি। এরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান জোরদার করেছে।”
এমনিতে জেনেভা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নানা সময়েই সংঘর্ষ হলেও এর মাত্রা গত দেড় বছরে বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হওয়া হঠাৎ বদলকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, “জেনেভা ক্যাম্প বহু বছর ধরে অপরাধপ্রবণ একটি ‘ইকোলজিক্যাল জোন’ হিসেবে পরিচিত। ক্ষমতার পালাবদলে সেখানে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নতুন করে সংঘর্ষ সূত্রপাত হওয়াটাই স্বাভাবিক বিষয়। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে ক্যাম্পে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে অপরাধ সংঘটন তুলনামূলক সহজ এবং স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।”
এ ক্ষেত্রে এ ধরনের অপরাধ ও তার নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সংযোগের বিষয়টিও তুলে ধরেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, “ক্যাম্পের দুর্বল সামাজিক কাঠামোকে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে এসেছে। ক্ষমতার পালাবদলের সময় ক্যাম্পের তরুণদের একটি অংশ খুব সহজেই মাদক চোরাচালান, অস্ত্র পরিবহন ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। কারণ তাদের জীবিকা ও পুনর্বাসনের বিকল্প ব্যবস্থা নেই। ফলে ক্যাম্পটিতে একটি স্থায়ী পেশাদার অপরাধী শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রলোভনে দ্রুত সক্রিয় হয় এবং এলাকাটিকে একটি বৃহৎ অপরাধচক্রের অধীনে রাখে।”