রাজনীতির জোট-মহাজোট কি সমাজে অসহনশীলতা বাড়াচ্ছে?

রাজনীতির জোট-মহাজোট কি সমাজে অসহনশীলতা বাড়াচ্ছে?
ফাইল ছবি: চরচা

‘জোট বাঁধো তৈরি হও/ তোলো আওয়াজ’। খুব পরিচিত গণসংগীত, যা আসলে যুদ্ধবাজদের বিপরীতে জোট বাঁধার আহ্বান জানায়। একইসঙ্গে জানায়-যুদ্ধ নয়, আওয়াজ তুলতে হবে যুদ্ধের বিরুদ্ধেই। এ জোট অস্ত্র ও সংঘাতের বিপরীতে অগণিতের, আর তাই শক্তিতে বিপুলা। সাধারণত পেশিতে দুর্বল ও খর্বশক্তির অগণিত মানুষের সম্মীলনে দানবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই এ অমিত শক্তির সম্ভাবনাময় জোট গড়ার আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশেও জোট আছে। নির্বাচনী জোট। তাহলে দানব কে? সমাজের ভেতরেও কি এর প্রভাব আছে?

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একের পর এক জোট আত্মপ্রকাশ করেছে। এর মধ্যে আছে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ইসলামি দলগুলোর জোট; এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের তিন দলীয় জোট; জাতীয় পার্টির নানা অংশ মিলে এবং আরও কয়েকটি দলকে সঙ্গে নিয়ে ১৮টি দলের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। এই জোটগুলো নিয়ে নানা আলাপ চলছে।

এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি সেভাবে কোনো জোট করেনি। তবে কিছু আসনে তারা প্রার্থী ঘোষণা করেনি এখনো। ফলে তারা মিত্রদের এসব আসন ছাড়ছে বলেই একটা ধারণা বদ্ধমূল।

নতুন বন্দোবস্ত বা নয়া রাজনীতির কথা বলে সবাইকে আশ্বস্ত করা তরুণদের দলও তুলনায় পুরোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে। তারা বলছে সংস্কারের পক্ষের সব ভোটকে তারা এক বাক্সে আনতে চায়। অর্থাৎ, তারা বাকি জোট ও দলগুলোকে ঠিক সংস্কারের পক্ষের মনে করছে না। জামায়াতে ইসলামী জোট করেছে ইসলামি দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে। তারাও ইসলামের পক্ষের সব ভোট এক বাক্সে আনতে চায়।

বাংলাদেশে জোট-মহাজোটের রাজনীতি বা রাজনীতির ময়দানে জোট নতুন নয়। এমনকি বাংলাদেশ নামে আজ যে ব-দ্বীপটি পরিচিত, তা স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই এই ভূমিতে জোটের রাজনীতি চলছে। স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের কথা। তারপর ১৯৭৯ সালের নির্বাচন বা তারপরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে জোট হয়েছে। কিছু হয়েছে পরিবর্তনকামী অবস্থান থেকে। তবে অধিকাংশই হয়েছে নির্বাচনকে সামনে রেখে। অবশ্য এবার গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ বা আরপিও সংশোধনের কারণে অর্থ ও জনবল এবং সমর্থকগোষ্ঠী বিবেচনায় বড় দলগুলোর প্রতীক ব্যবহার করে ছোট দলগুলোর নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার বিকল্প নেই। তারপরও জোট কেন?

উত্তর খুঁজতে গেলে কিছুটা বিভ্রান্ত হতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলো কি তবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে? তারা কি পরস্পরকে আর বিশ্বাস করছে না? প্রশ্ন আসতে পারে–জোট তো আগেও হয়েছে। হ্যাঁ, আগেও হয়েছে। চারদলীয় জোট, মহাজোট, ১৪ দলীয় জোট, ২০ দলীয় জোট ইত্যাদি বহু অভিধায় নানা জোট হয়েছে। প্রশ্নগুলো সেসব ক্ষেত্রেও একই।

১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় চলতে শুরু করার পর থেকেই এ জোটকাব্য আমাদের সঙ্গী বলা যায়। কখনো ভোটের পর, কখনো ভোটের আগে–এই যা তফাৎ। ২০০১ সাল বা তারপর থেকে ভোটের আগে জোটই দস্তুর। এ যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে যুযুধান দুই প্রধান পক্ষের মিত্র খোঁজার অভিযান। বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে তাকালে অন্তত তেমনটিই চোখে পড়বে।

কথা হলো বড় শক্তিগুলো না হয় যুদ্ধে জয়ের জন্য মিত্র খোঁজে। কিন্তু সেইসব মিত্ররা মৈত্রী করে কেন? তার চাওয়া কী? ক্ষমতার ভাগ? নাকি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকে মুক্তি? রাজনীতির ময়দানে ক্ষমতাই মোক্ষ–সন্দেহ কী! আর দ্বিতীয় প্রশ্ন? তার কী মীমাংসা হবে?

হ্যাঁ, দ্বিতীয় প্রশ্নটিই গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার দাবি রাখে। ‘উইনার টেকস অল’ নীতিতে চলা একটি দেশের রাজনীতিতে খর্বশক্তির পক্ষগুলো অনিরাপত্তাবোধে আক্রান্ত হবে–এটা স্বাভাবিক। আর এর কারণেই তারা বড়দের সাথে জোট বাঁধে, যদিও সে জানে ‘বড়র পীরিতি বালির বাঁধ’, যেকোনো সময় তা ধ্বসে যেতে পারে। কিন্তু ওই যে বিজিত পক্ষে থাকলেও সংখ্যার বিচারে সে তবুও কিছুটা ধর্তব্যে থাকার সম্ভাবনা থাকে, সে চিন্তাই তাকে তার রাজনৈতিক প্রকল্পকে পাশ কাটিয়ে জোট বাঁধতে প্ররোচিত করে।

আর এই জোট সংস্কৃতি তাকে ক্রমশ নিয়ে যায় খাদের কিনারায়। দিনে দিনে সে আরও খর্বশক্তির হতে থাকে। একসময় সে জোট ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না। কোনো গত্যন্তর থাকে না তার। এর অভিঘাত গিয়ে লাগে সমাজে। কে না জানে সমাজ ও রাজনীতি হলো সেই সহোদর, যারা একজন আরেকজনকে টেনে নিয়ে চলে।

রাজনৈতিক জোটের প্রভাব সমাজে কীভাবে পড়ে? এই প্রভাব আসে রাজনৈতিক প্রচারের হাত ধরেই। মাঠে রাজনৈতিক জোটগুলো নিজেদের প্রচার চালাতে গিয়ে বুঝে বা না বুঝেই একটা মেরুকরণের জন্ম দেয়। প্রতিপক্ষ জোটগুলো সম্পর্কে বিষোদ্‌গার করেই হোক কিংবা নিজ জোটের পক্ষগুলোকে একটা অভিন্ন স্বর দিতে গিয়েই হোক–এ কাণ্ডটি তারা ঘটিয়ে ফেলে। প্রতিপক্ষকে কূপোকাত করতে গিয়ে তাকে দানব হিসেবে মঞ্চায়িত করে বসে হরহামেশাই।রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে করা বাগাড়ম্বরের মধ্য দিয়ে তা চলে যায় একেবারে সাধারণ মানুষের কাছে। জোটের বাইরে থাকা ছোট ছোট স্বরগুলো তখন অনুল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে।

অর্থাৎ, শুরুতে বলা সেই দানব বধের মন্ত্রে সবাইকে দীক্ষিত করতে গিয়ে গোটা সমাজকে ‘আমি-তুমি’তে ভাগ করে বসে রাজনৈতিক জোটগুলো। এই বাস্তবতার কারণেই ছোট হয়ে আর কেউ থাকতে চায় না। অনুল্লেখযোগ্য হয়ে পড়ার চেয়ে ‘আমি বা তুমি’র কোনো একটিতে ভাগ বসাতে সবাই তৎপর হয়। এই তৎপরতা একইসঙ্গে এক ভীষণ অনিরাপত্তাবোধের জন্ম দেয়।

জোট ঘোষণার সময় তিন দলের নেতারা। ছবি: চরচা
জোট ঘোষণার সময় তিন দলের নেতারা। ছবি: চরচা

রাজনীতির ময়দানের এই অনিরাপত্তাবোধ সমাজের ভেতরে আরেক অনিরাপত্তাবোধের জন্ম দেয়। কিংবা উল্টে বলা যায়–রাজনীতির এই পেশিপ্রেম সমাজেও আরেক পেশিপ্রেমের জন্ম দেয়। এই পেশির উৎস রয়েছে সংখ্যায়। গোটা ব্যবস্থায় থাকা সংখ্যার রাজত্বই, ব্যক্তি থেকে সমাজ সর্বস্তরে সংখ্যাকেই একমাত্র তুল্যমূল্য করে তোলে। কারণ এ ব্যবস্থা বলছে–যারা সংখ্যায় বেশি, সেই রাজ করবে। এই যে প্রবণতা, তা সমাজের ভেতরে থাকা একলা কণ্ঠগুলোকে রীতিমতো রুদ্ধ করে ফেলে। আমার বা আমার জোটের ভাষার সঙ্গে না মিললেই তা আর গ্রহণযোগ্য নয়–এমন এক ধারণা প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

এই সম্প্রসারণ এক ভয়াবহ কাণ্ড ঘটায়। সমাজে থাকা তুলনামূলক স্বতন্ত্র কণ্ঠগুলোও তখন জোটের সন্ধানে নেমে পড়ে। তুলনায় কম অস্বস্তিকর ভিড়ে নিজেকে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এটা ব্যক্তিপর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগেই বলা হয়েছে জোটের খেলা অনেক পুরোনো। দীর্ঘ সময় ধরে এ খেলা চলতে থাকার ফল আমরা দেখি সমাজের নানা স্তরে। পেশি বিবেচনায় নারীকে খর্ব মনে হওয়ায়, নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ধুলায় আশ্রয় খোঁজে; বাঙালি বাদে অন্য জাতিগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ট্যাগ সেঁটে দেওয়া হয় গায়ে; অমুসলিম, এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী মুসলমানদের বাইরে থাকা গোষ্ঠীকেও হুমকি-ধমকি শুনতে হয় নিয়মিত বিরতীতে; বাউল-পালাকারদের আক্রান্ত হতে হয়; মাজার ভেঙে ফেলা হয়। আর এই আক্রান্ত গোষ্ঠী ক্রমশ কণ্ঠহীন হয়ে পড়তে থাকে। এই প্রতিটি ক্ষেত্রে সামাজিক জোট কখনো লিঙ্গ পরিচয়ে, কখনো ধর্ম পরিচয়ে, কখনো জাতিগোষ্ঠী পরিচয়ে, কখনো ভাষা পরিচয়ে, কখনো আচরিক বিবেচনায় প্রকাশিত হয়। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই খর্বশক্তি মার খায় বা মার খাওয়ার ভয়ে চুপ হয়ে যায়।

বলা হতে পারে যে, রাজনীতিতে জোট তো স্বাস্থ্যকরও। হ্যাঁ, যদি তা পরমতসহিষ্ণুতাকে আমলে নেয়, তবেই। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় একাধিক পথ ও মতের রাজনীতিকেরা একসঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে একটি কর্মসূচি নিচ্ছে–এটা তো সুচর্চাই হওয়ার কথা। কিন্তু মুশকিল হলো–রাজনৈতিক জোট সাধারণত হয় সমরূপ গোষ্ঠীগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার মাধ্যমে। যুদ্ধজয়ের লক্ষ্যে ন্যূনতম সমঝোতাকে কাজে লাগিয়ে এমন জোটের জন্ম হয়। আর যুদ্ধ তো প্রতিপক্ষ ছাড়া হয় না। ফলে প্রায় সমরূপ দলগুলোর মধ্যে হওয়া জোট সাধারণত মেরুকরণের জন্ম দেয়, যার কথা আগেই বলা হয়েছে।

মেরুকরণ কী ঘটাতে পারে? ব্রায়ান্ট ইউনিভার্সিটির ২০১৮ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক মেরুকরণ এমনকি তথাকথিত ‘উদারবাদী’ নামে পরিচিত গোষ্ঠীকেও অসহনশীল করে তোলে। রাজনৈতিকভাবে তারা উদারবাদী হলেও তাদের কাজের মধ্যে অসহনশীলতার পরিচয় প্রকট হয়ে ওঠে। হিদার লেসির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ গবেষণা বলছে, এ ধরনের মেরুকরণ সমাজে সহিংসতা বাড়াতে পারে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধির নজিরকে সামনে রাখলে এ গবেষণাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতেই হয়। ২০০১ সালের পর থেকে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোটের স্বাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। এবার একটু তথ্যে চোখ বোলানো যাক। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, ২০০২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় বাংলাদেশে ২৪০০ লোক মারা গেছে। আর আহত হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ।

এ ঘটনা ঘটেছে শুধু প্রতিপক্ষ জোটকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার কারণে। জোটে জোটে লড়াই ব্যক্তি মানুষকে বধযোগ্য করে তোলে। আর এটা তারা করেছে একটা ভীতির কারণে। এটা অনেকটা এমন যে, ‘আমি না মারলে, ও আমাকে মেরে ফেলবে’। অর্থাৎ, সমাজ ও রাজনীতিতে ক্রমশ মানুষের বিমানবিকীকরণ ঘটতে থাকে। জোটই মুখ্য, আর সব মিছা–এ ধারণা প্রবল হতে থাকে। আর এতে বিরোধী জোট বা জোটগুলো শত্রুস্থানের মর্যাদা পায়। এ ক্ষেত্রে বারবার করে এই ভাষ্যকেই সামনে আনা হয় যে, বিরোধী পক্ষগুলো যা বলছে, তা শুধু আলাদা মত নয়, বরং তোমার জন্য হুমকি, যাকে ‘আউটগ্রুপ বায়াস’ বলা হয়।

এই ‘আউটগ্রুপ বায়াস’ ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, জোট গঠনের স্বার্থেই সঙ্গে নেওয়া দল-উপদলগুলোকে ন্যুনতম সমরূপতার ভিত্তিতে নেওয়া হয় বলে সেখানে তুলনায় কট্টরপন্থী বা উগ্রপন্থীরা স্থান করে নিতে পারে সহজে। ফ্রান্সে লে পেনের উত্থান ঠিক এ পথেই হয়েছে। কিংবা বলা যায় মার্কিন রাজনীতিতে ক্লু ক্লাক্স ক্ল্যানের পুনরুত্থানও একই ধারা মেনে হয়েছে। বাংলাদেশেও তেমন নজির বিরল নয়। শুধু জোটের স্বার্থে এমন সব কট্টরপন্থার দলকে রাজনীতির ময়দানে পুনরায় সচল হতে দেখা গেছে, যারা বড় দলগুলোর কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে তাদের তত্ত্ব ও ক্রিয়া সমাজে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। জোট মোটাদাগে রাজনীতির সূত্র ধরে সমাজে কট্টরপন্থর গ্রহণযোগ্যতা নির্মাণে কাজে লাগে অনেক ক্ষেত্রেই।

যে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতার বাইরে থাকা পক্ষগুলো চিহ্নিত হয় ‘পরাজিত’ পক্ষ হিসেবে, সেখানে নিজ নিজ রাজনৈতিক প্রকল্পকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে জোট গড়ার পেছনে মূলত কাজ করে ‘পরিচয়বাদী রাজনীতি’। আর এই পরিচয়বাদী রাজনীতির কেন্দ্রে থাকে ‘বাদ পড়ে যাওয়ার ভীতি’। মসনদে বসা পক্ষটি তাকে পীড়ন করবে, তার পাওনা থেকে তাকে বঞ্চিত করবে–এমন বদ্ধমূল ধারণার সঙ্গে যে অবিশ্বাসের প্রেক্ষাপট যুক্ত থাকে, তাই তাকে যুদ্ধংদেহী হতে বাধ্য করে। ঠিক একই কথা খাটে ক্ষমতাসীন পক্ষটির ক্ষেত্রেও। তারাও মসনদ হারালে ‘পরাজিত’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার শঙ্কায় থাকে। সুতরাং রাষ্ট্রীয় সকল অঙ্গকে সে কাজে লাগায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে। এটি যে চক্রের জন্ম দেয় তা সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে দেয় অসহনশীলতার বীজ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিচয়বাদী রাজনীতি যেমন, তেমনি প্রতিশোধের রাজনীতিও বর্তমান। এর ইতিহাসও পুরোনো। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোট, মহাজোট ইত্যাদি আসলে রাজনৈতিক বিভাজনকেই গাঢ় করেছে, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে বিভাজনকে বাস্তব করে তুলেছে।

এই বিভাজনের রেখায় দাঁড়িয়ে নানা পরিচয়সূত্র খুঁজে সমাজের নানা স্তরের মানুষেরা সংখ্যা গুনে সংঘ করছে ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে। এই সংঘপ্রয়াসে যাদের বিস্তৃতি কম, তারা আক্রান্ত হওয়ার ভবিতব্য ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না। এর বড় উদাহরণ হিসেবে চোখের সামনে আছে বাউলরা, নারীরা, অবাঙালি জাতিগোষ্ঠী, অমুসলিম, অ-সুন্নি, মাজারপন্থীসহ অসংখ্য পরিচয়, যারা শাসনব্যবস্থার পরিচালক হিসেবে চিহ্নিত পক্ষগুলোর তুলনায় খর্বশক্তির। অনিরাপত্তাবোধ থেকে জোট বাঁধার এ ধারা সমাজের একলা কণ্ঠগুলোকে আরও একলা করে দিচ্ছে। অভিনব কিছু তো দূর, কেউ একটু ভিন্নমত দিলেই তাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সকল পরিসরে আক্রমণ করা হচ্ছে। বার্তাটি পরিষ্কার যে, যদি উল্লেখ করার মতো সংঘ না থাকে, যদি তুমি একলা হও এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের বাইরে তোমার ভিন্নমত থাকে, তবে চুপ করে থাকো। এই বার্তা সমাজের সর্বস্তরে রাজনৈতিক পরিসর থেকেই বিস্তৃত হচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে এক তীব্র অসহনশীলতার চর্চা ছড়িয়ে পড়ছে সবদিকে।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চরচা

সম্পর্কিত