তরুণ চক্রবর্তী

ভারতীয় রাজনীতিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদে তেমন সাফল্য আসছে না। বরং ভোটের ফলেই প্রমাণিত হচ্ছে, ভারতের মানুষ হিন্দুত্বের বদলে উন্নয়ন ও স্থানীয় সমস্যাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিজেপি ভোটে জিতলেও সেটা শুধু হিন্দুত্ব নির্ভর নয়। নিজেদের পেশাদার ও আক্রমণাত্মক ভোট কৌশল, সরকারি মেশিনারির যথেচ্ছ ব্যবহার এবং দলভাঙানোর ‘বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি’ বিজেপিকে রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতা দখলে সাহায্য করছে।
সদ্য সমাপ্ত বিহার বা মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে সেটাই নজরে আসে। সেটাই দেখা গিয়েছে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনেও। বিজেপির জয়ের রাস্তা প্রশস্ত হওয়ার পিছনে কংগ্রেস অপেশাদার মানসিকতা ও নির্বাচনে মান্ধাতা আমলের সাবেকিয়ানাও অনেকটা দায়ী। অঙ্ক কষে বিজেপি কেন্দ্র ধরে ধরে নিজেদের জয়ের রাস্তা প্রশস্ত করলেও কংগ্রেস এখনো সেই অঙ্কে অনেক দুর্বল।
রাজনীতির একটা নিজস্ব অঙ্ক আছে। সেটা ‘পার্টি গণিত’, পাটিগণিত নয়। সাধারণ অঙ্কে দুয়ে-দুয়ে চার হলেও ‘পার্টি গণিতে’ দুই যোগ দুই চার নয়, পাঁচ বা পঞ্চাশ। এমনকি, শূণ্যও হতে পারে। সেই ‘পার্টি গণিত’টা বিজেপি ভালোই বোঝে। তাই বিরোধীরা যতই কটাক্ষ করুক না কেন, কম ভোট পেয়েও বেশি আসন ছিনিয়ে আনতে পারেন বিজেপির ভোট-ক্যাচাররা। অনেকটা বহুজাতিক সংস্থার বিপণন বাণিজ্যের মতো। উগ্র হিন্দুত্ব দিয়ে ভোটের বৈতরণী পার হতে না পেরে বহুদিন ধরেই বিজেপি নেতারা ‘পার্টি গণিত’টাকেই আঁকড়ে ধরেছেন। ইলেকশন মেশিনারি অনেক আগে থেকেই সেই ‘পার্টি গণিত’ অনুযায়ী বিরোধীদের ঘায়েল করার ছক কষে কাঙ্ক্ষিত জয় নিয়ে আসছে। বিহারের নির্বাচনী ফলাফল সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে।
সদ্য সমাপ্ত বিহার বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির এনডিএ জোট কংগ্রেসের ‘মহাগটবন্ধন’ জোটকে গোহারা হারিয়ে নিজেদের দূর্গ অক্ষত রেখেছে। কিন্তু সত্যিই কি ড্যাং ড্যাং করে জিতেছে? বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বই কি তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি? উত্তর, না। ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় বিজেপির ছয় দলীয় এনডিএ জোট জিতেছে ২০২টিতে। আর কংগ্রেসের ৯ দলীয় মহাগটবন্ধন মাত্র ৩৫টি আসনে জিতেছে। স্বাভাবিক কারণেই মনে হতে পারে বিজেপির জোটের এটা বিরাট জয়। কিন্তু আমরা যদি ভোটের শতকরা হারের দিকে তাকাই তাহলেই বোঝা যাবে আসল জনমত। বিহারের ৬৯.১২ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। সেই ভোটের ৪৬.৫৬ শতাংশ পেয়েছে বিজেপির এনডিএ। আর বিরোধী শিবিরের মহাগটবন্ধন পেয়েছে ৩৭.৯৪ শতাংশ। বিজেপি একা পেয়েছে ২০ শতাংশ এবং কংগ্রেস ৮.৭১। ১০১টি আসনে লড়ে বিজেপি জিতেছে ৮৯টিতে এবং কংগ্রেস ৬১টিতে লড়ে জিতেছে মাত্র ৬টি আসনে। এই সংখ্যাতত্বেও মনে হতে পারে বিহারে তো কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপিরই রমরমা!
কিন্তু এখানেই গল্পের শেষ নয়। বিহার নির্বাচন বিজেপি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজে গুচ্ছ গুচ্ছ সভা করেছেন। অন্য রাজ্যের মন্ত্রীরা ঘাঁটি গেড়ে পড়ে থেকেছেন বিহারে। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন কেন্দ্র ধরে ধরে বিজেপিকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে বলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। টাকার বন্যা বইয়েছে বিজেপি নেতৃত্ব। ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিজেপি নেতারা। সঙ্গে ছিল কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ প্রশাসন। শাসক দলের বাড়তি সুবিধা। এবং অবশ্যই রাহুল গান্ধীর খামখেয়ালিপনা, দীর্ঘ অনুপস্থিতি ও লালুপ্রসাদ যাদবের পারিবারিক কোন্দল।
বিরোধীদের এতো নেতিবাচক দিক তো ছিলই, সঙ্গে ছিল রাজ্যের ৮২ শতাংশেরও বেশি হিন্দু ভোট। সেই ভোটেই তো ভর করে জিতে যেতে পারতো বিজেপির জোট! বিহারে মুসলিম ভোট মাত্র ১৭.১৭ শতাংশ। ২০২০ সালে মুসলিমরা ১৯টি আসনে জিতলেও এবার তাদের জয়ের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১১। শুধু হিন্দুত্বে ভর করে জেতা যাবে না বুঝতে পেরেই বিজেপি নেতারা ভোটের আগে দলবদলে মনোনিবেশ করেন। বিরোধী শিবিরের দাগী বলে পরিচিত বহু নেতাই দলবদলে নিজেদের নিরাপত্তার পাশাপাশি বিজেপির এই জয়যাত্রার পথ প্রশস্ত করেছেন। সঙ্গে ছিল নীতীশকুমারের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিও।

গত লোকসভা ভোটেই বোঝা গিয়েছিল ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির গ্রাফ নিম্নমুখী। আর সেটা ঠেকাতেই উগ্র হিন্দুত্বের পাশাপাশি বিজেপি নেতারা আরও বেশি করে অন্য দলকে ভাঙানোর খেলায় মন দিয়েছেন। ভারতের মোট ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে বিজেপি একক শক্তিতে ১৫টিতে ক্ষমতায় রয়েছেন। আরও পাঁচটিতে রয়েছে তাদের জোটের সরকার। এই কুড়িটির মধ্যে হাফ ডজনেরও বেশি মুখ্যমন্ত্রী অতীতে কংগ্রেস করতেন। প্রতিটি রাজ্য মন্ত্রিসভাতেই দেখা যাবে কংগ্রেসের প্রাক্তন নেতারা সেখানে রয়েছেন। উত্তর পূর্বাঞ্চলের আট রাজ্যের মধ্যে ছয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই অতীতে কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই একসময় দুর্নীতির অভিযোগে সরব ছিলেন বিজেপি নেতারা। যেমন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এক সময় তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও মন্ত্রী ছিলেন। এই দলেরই সাবেক নেতা ও ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী মুকুল রায়কেও বরণ করে নিয়েছিল বিজেপি। অথচ এক সময় তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগে সরব ছিলেন বিজেপি নেতারা। প্রকাশ্যে তাদের টাকা নিতেও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বিজেপিতে নাম লেখানোর পর সব অভিযোগ খারিজ। তাই দাগীরা অনেকেই বিজেপিতে গিয়ে জয়ের পথ প্রশস্ত করেছেন। বিজেপিও ধর্মের ঢাক পেটানোর পাশাপাশি অন্য দলের নেতাদের জন্য লাল কার্পেট পেতে রেখেছে। তবু ভোট বিজেপির কমছে।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখা গিয়েছে গোটা দেশেই হিন্দুত্ব বিকোচ্ছে না। দেশের মাত্র ১৪ শতাংশ মুসলিম ও ৮২ শতাংশ হিন্দু থাকলেও বিজেপি ভোট পেয়েছিল ৩৬.৫৬ শতাংশ। প্রচার যুদ্ধে কোটি কোটি টাকা খরচ করে, বিরোধীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা লেলিয়ে দিয়ে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ বিজেপির সর্বস্তরের নেতারা এবং আরএসএস সক্রিয়ভাবে মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার করেও বিজেপির জোট গোটা ভারতে ৫৪৩টি আসনের মধ্যে পেয়েছে ২৯৩টি আসন। গোটা দেশের ৬৫.৭৯ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। প্রদত্ত ভোটে বিজেপির নেতৃত্বাধীন ২৫ দলীয় এনডিএ জোটের প্রাপ্তির হার ৪৩.৮০ শতাংশ। আর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ২৫ দলীয় ইন্ডিয়া জোট পায় ৪১.৪৮ শতাংশ। বিজেপি একা ৪৪১টি কেন্দ্রে লড়ে পায় ৩৬.৫৬ শতাংশ ভোট এবং ২৪০ জন এমপি। তাদের এমপি সংখ্যা কমেছে ৬৩টি। আর কংগ্রেস ৩২৬ কেন্দ্রে লড়ে ২১.১৯ শতাংশ ভোট এবং ৯৯টি সংসদের আসন লাভ করে। গতবারের তুলনায় কংগ্রেসের আসন বাড়ে ৪৭টি। মাথায় রাখতে হবে, বিজেপির বিশাল নির্বাচনী মেশিনারি এবং অর্থবলকেও। রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবিধাও তারা পেয়েছিল সেই ভোটে। বিভাজনের রাজনীতিও ছিল পুরোমাত্রায়। তবু ভর করতে হয় দলবদলের রাজনীতিকে।

সামনেই আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু, কেরালা ও পুদুচেরিতে বিধানসভা ভোট। বিজেপি বিভাজনের রাজনীতিকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগাচ্ছে। সঙ্গে থাকছে দলবদলের অংকও। কারণ বিজেপি নেতারা জানেন, ভারতের সাধারণ মানুষ মন থেকেই অসাম্প্রদায়িক। তারা সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করেন। তাই অন্যদের কাঁধে বন্দুক রেখে ক্ষমতা দখলে মরিয়া বিজেপি।
তবে অন্য দল থেকে আমদানি করা নেতাদের অবশ্য অতীতে অসাম্প্রদায়িক ও বিজেপি বিরোধী রাজনীতিতে নিজেদের পরিচিতি তৈরি করলেও এখন তারা সবচেয়ে বেশি মুসলিম বিদ্বেষী। যেমন আসামের হিমন্ত বিশ্বশর্মা, পশ্চিমবঙ্গের শুভেন্দু অধিকারী। দলের নতুনদের দিয়েই বিজেপি উগ্রসাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে। আরও স্পষ্ট করছে বিভাজন রেখাকে। বিজেপির ক্ষমতা বাড়লেও বিপদ বাড়ছে ভারতের।
তরুণ চক্রবর্তী: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলকাতা (ভারত)

ভারতীয় রাজনীতিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদে তেমন সাফল্য আসছে না। বরং ভোটের ফলেই প্রমাণিত হচ্ছে, ভারতের মানুষ হিন্দুত্বের বদলে উন্নয়ন ও স্থানীয় সমস্যাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিজেপি ভোটে জিতলেও সেটা শুধু হিন্দুত্ব নির্ভর নয়। নিজেদের পেশাদার ও আক্রমণাত্মক ভোট কৌশল, সরকারি মেশিনারির যথেচ্ছ ব্যবহার এবং দলভাঙানোর ‘বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি’ বিজেপিকে রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতা দখলে সাহায্য করছে।
সদ্য সমাপ্ত বিহার বা মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে সেটাই নজরে আসে। সেটাই দেখা গিয়েছে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনেও। বিজেপির জয়ের রাস্তা প্রশস্ত হওয়ার পিছনে কংগ্রেস অপেশাদার মানসিকতা ও নির্বাচনে মান্ধাতা আমলের সাবেকিয়ানাও অনেকটা দায়ী। অঙ্ক কষে বিজেপি কেন্দ্র ধরে ধরে নিজেদের জয়ের রাস্তা প্রশস্ত করলেও কংগ্রেস এখনো সেই অঙ্কে অনেক দুর্বল।
রাজনীতির একটা নিজস্ব অঙ্ক আছে। সেটা ‘পার্টি গণিত’, পাটিগণিত নয়। সাধারণ অঙ্কে দুয়ে-দুয়ে চার হলেও ‘পার্টি গণিতে’ দুই যোগ দুই চার নয়, পাঁচ বা পঞ্চাশ। এমনকি, শূণ্যও হতে পারে। সেই ‘পার্টি গণিত’টা বিজেপি ভালোই বোঝে। তাই বিরোধীরা যতই কটাক্ষ করুক না কেন, কম ভোট পেয়েও বেশি আসন ছিনিয়ে আনতে পারেন বিজেপির ভোট-ক্যাচাররা। অনেকটা বহুজাতিক সংস্থার বিপণন বাণিজ্যের মতো। উগ্র হিন্দুত্ব দিয়ে ভোটের বৈতরণী পার হতে না পেরে বহুদিন ধরেই বিজেপি নেতারা ‘পার্টি গণিত’টাকেই আঁকড়ে ধরেছেন। ইলেকশন মেশিনারি অনেক আগে থেকেই সেই ‘পার্টি গণিত’ অনুযায়ী বিরোধীদের ঘায়েল করার ছক কষে কাঙ্ক্ষিত জয় নিয়ে আসছে। বিহারের নির্বাচনী ফলাফল সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে।
সদ্য সমাপ্ত বিহার বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির এনডিএ জোট কংগ্রেসের ‘মহাগটবন্ধন’ জোটকে গোহারা হারিয়ে নিজেদের দূর্গ অক্ষত রেখেছে। কিন্তু সত্যিই কি ড্যাং ড্যাং করে জিতেছে? বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বই কি তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি? উত্তর, না। ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় বিজেপির ছয় দলীয় এনডিএ জোট জিতেছে ২০২টিতে। আর কংগ্রেসের ৯ দলীয় মহাগটবন্ধন মাত্র ৩৫টি আসনে জিতেছে। স্বাভাবিক কারণেই মনে হতে পারে বিজেপির জোটের এটা বিরাট জয়। কিন্তু আমরা যদি ভোটের শতকরা হারের দিকে তাকাই তাহলেই বোঝা যাবে আসল জনমত। বিহারের ৬৯.১২ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। সেই ভোটের ৪৬.৫৬ শতাংশ পেয়েছে বিজেপির এনডিএ। আর বিরোধী শিবিরের মহাগটবন্ধন পেয়েছে ৩৭.৯৪ শতাংশ। বিজেপি একা পেয়েছে ২০ শতাংশ এবং কংগ্রেস ৮.৭১। ১০১টি আসনে লড়ে বিজেপি জিতেছে ৮৯টিতে এবং কংগ্রেস ৬১টিতে লড়ে জিতেছে মাত্র ৬টি আসনে। এই সংখ্যাতত্বেও মনে হতে পারে বিহারে তো কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপিরই রমরমা!
কিন্তু এখানেই গল্পের শেষ নয়। বিহার নির্বাচন বিজেপি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজে গুচ্ছ গুচ্ছ সভা করেছেন। অন্য রাজ্যের মন্ত্রীরা ঘাঁটি গেড়ে পড়ে থেকেছেন বিহারে। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন কেন্দ্র ধরে ধরে বিজেপিকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে বলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। টাকার বন্যা বইয়েছে বিজেপি নেতৃত্ব। ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিজেপি নেতারা। সঙ্গে ছিল কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ প্রশাসন। শাসক দলের বাড়তি সুবিধা। এবং অবশ্যই রাহুল গান্ধীর খামখেয়ালিপনা, দীর্ঘ অনুপস্থিতি ও লালুপ্রসাদ যাদবের পারিবারিক কোন্দল।
বিরোধীদের এতো নেতিবাচক দিক তো ছিলই, সঙ্গে ছিল রাজ্যের ৮২ শতাংশেরও বেশি হিন্দু ভোট। সেই ভোটেই তো ভর করে জিতে যেতে পারতো বিজেপির জোট! বিহারে মুসলিম ভোট মাত্র ১৭.১৭ শতাংশ। ২০২০ সালে মুসলিমরা ১৯টি আসনে জিতলেও এবার তাদের জয়ের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১১। শুধু হিন্দুত্বে ভর করে জেতা যাবে না বুঝতে পেরেই বিজেপি নেতারা ভোটের আগে দলবদলে মনোনিবেশ করেন। বিরোধী শিবিরের দাগী বলে পরিচিত বহু নেতাই দলবদলে নিজেদের নিরাপত্তার পাশাপাশি বিজেপির এই জয়যাত্রার পথ প্রশস্ত করেছেন। সঙ্গে ছিল নীতীশকুমারের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিও।

গত লোকসভা ভোটেই বোঝা গিয়েছিল ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির গ্রাফ নিম্নমুখী। আর সেটা ঠেকাতেই উগ্র হিন্দুত্বের পাশাপাশি বিজেপি নেতারা আরও বেশি করে অন্য দলকে ভাঙানোর খেলায় মন দিয়েছেন। ভারতের মোট ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে বিজেপি একক শক্তিতে ১৫টিতে ক্ষমতায় রয়েছেন। আরও পাঁচটিতে রয়েছে তাদের জোটের সরকার। এই কুড়িটির মধ্যে হাফ ডজনেরও বেশি মুখ্যমন্ত্রী অতীতে কংগ্রেস করতেন। প্রতিটি রাজ্য মন্ত্রিসভাতেই দেখা যাবে কংগ্রেসের প্রাক্তন নেতারা সেখানে রয়েছেন। উত্তর পূর্বাঞ্চলের আট রাজ্যের মধ্যে ছয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই অতীতে কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই একসময় দুর্নীতির অভিযোগে সরব ছিলেন বিজেপি নেতারা। যেমন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এক সময় তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও মন্ত্রী ছিলেন। এই দলেরই সাবেক নেতা ও ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী মুকুল রায়কেও বরণ করে নিয়েছিল বিজেপি। অথচ এক সময় তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগে সরব ছিলেন বিজেপি নেতারা। প্রকাশ্যে তাদের টাকা নিতেও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বিজেপিতে নাম লেখানোর পর সব অভিযোগ খারিজ। তাই দাগীরা অনেকেই বিজেপিতে গিয়ে জয়ের পথ প্রশস্ত করেছেন। বিজেপিও ধর্মের ঢাক পেটানোর পাশাপাশি অন্য দলের নেতাদের জন্য লাল কার্পেট পেতে রেখেছে। তবু ভোট বিজেপির কমছে।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখা গিয়েছে গোটা দেশেই হিন্দুত্ব বিকোচ্ছে না। দেশের মাত্র ১৪ শতাংশ মুসলিম ও ৮২ শতাংশ হিন্দু থাকলেও বিজেপি ভোট পেয়েছিল ৩৬.৫৬ শতাংশ। প্রচার যুদ্ধে কোটি কোটি টাকা খরচ করে, বিরোধীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা লেলিয়ে দিয়ে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ বিজেপির সর্বস্তরের নেতারা এবং আরএসএস সক্রিয়ভাবে মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার করেও বিজেপির জোট গোটা ভারতে ৫৪৩টি আসনের মধ্যে পেয়েছে ২৯৩টি আসন। গোটা দেশের ৬৫.৭৯ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। প্রদত্ত ভোটে বিজেপির নেতৃত্বাধীন ২৫ দলীয় এনডিএ জোটের প্রাপ্তির হার ৪৩.৮০ শতাংশ। আর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ২৫ দলীয় ইন্ডিয়া জোট পায় ৪১.৪৮ শতাংশ। বিজেপি একা ৪৪১টি কেন্দ্রে লড়ে পায় ৩৬.৫৬ শতাংশ ভোট এবং ২৪০ জন এমপি। তাদের এমপি সংখ্যা কমেছে ৬৩টি। আর কংগ্রেস ৩২৬ কেন্দ্রে লড়ে ২১.১৯ শতাংশ ভোট এবং ৯৯টি সংসদের আসন লাভ করে। গতবারের তুলনায় কংগ্রেসের আসন বাড়ে ৪৭টি। মাথায় রাখতে হবে, বিজেপির বিশাল নির্বাচনী মেশিনারি এবং অর্থবলকেও। রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবিধাও তারা পেয়েছিল সেই ভোটে। বিভাজনের রাজনীতিও ছিল পুরোমাত্রায়। তবু ভর করতে হয় দলবদলের রাজনীতিকে।

সামনেই আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু, কেরালা ও পুদুচেরিতে বিধানসভা ভোট। বিজেপি বিভাজনের রাজনীতিকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগাচ্ছে। সঙ্গে থাকছে দলবদলের অংকও। কারণ বিজেপি নেতারা জানেন, ভারতের সাধারণ মানুষ মন থেকেই অসাম্প্রদায়িক। তারা সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করেন। তাই অন্যদের কাঁধে বন্দুক রেখে ক্ষমতা দখলে মরিয়া বিজেপি।
তবে অন্য দল থেকে আমদানি করা নেতাদের অবশ্য অতীতে অসাম্প্রদায়িক ও বিজেপি বিরোধী রাজনীতিতে নিজেদের পরিচিতি তৈরি করলেও এখন তারা সবচেয়ে বেশি মুসলিম বিদ্বেষী। যেমন আসামের হিমন্ত বিশ্বশর্মা, পশ্চিমবঙ্গের শুভেন্দু অধিকারী। দলের নতুনদের দিয়েই বিজেপি উগ্রসাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে। আরও স্পষ্ট করছে বিভাজন রেখাকে। বিজেপির ক্ষমতা বাড়লেও বিপদ বাড়ছে ভারতের।
তরুণ চক্রবর্তী: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলকাতা (ভারত)