২০২৬ সালে কোন পথে এগোবে চীন?

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
২০২৬ সালে কোন পথে এগোবে চীন?
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং। ছবি: রয়টার্স

শেষ হতে যাওয়া বছরটি চীনের জন্য তুলনামূলকভাবে সফল ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থাকেই দুর্বল করে ফেলছে, তখন চীন তুলনামূলকভাবে সংযত কূটনীতি অবলম্বন করেছে। বাণিজ্যযুদ্ধে হিসেবি প্রতিক্রিয়া, অর্থনীতিকে বড় ধাক্কা থেকে রক্ষা এবং প্রয়োজনে নীরব থাকা-এই কৌশল ২০২৫ সালে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

তবে এ বছরের সাফল্য আগামী বছর চীনের ভূমিকাকে কীভাবে প্রভাবিত করবে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে এই বিষয়ে লিখেছেন সংবাদমাধ্যমটির পররাষ্ট্র বিষয়ক সম্পাদক প্যাট্রিক ফোউলিস।

তার ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান শুল্কযুদ্ধ, সম্পত্তি খাতের দীর্ঘস্থায়ী সংকট এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও দেশটির অর্থনীতি প্রায় ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। শেয়ারবাজারে চীনা কোম্পানির উত্থান, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) রেকর্ড মূলধন সংগ্রহ এবং প্রযুক্তি খাতে দ্রুত অগ্রগতি-সব মিলিয়ে বেইজিংয়ের আত্মবিশ্বাস বাড়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

প্যাট্রিক মনে করেন, আত্মবিশ্বাস বেশি হয়ে গেলে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের প্রলোভন আরও বেড়ে যেতে পারে। চীনা প্রেসিডেন্ট যদি কোনো আগ্রাসী সিদ্ধান্ত নেন তা তিনটি ক্ষেত্রে চীনকে প্রভাবিত করতে পারে। এরমধ্যে রয়েছে- বাণিজ্য, তাইওয়ান ও চীনের পরিচালিত বিশ্বনীতি।

প্যাট্রিক বলেন, এই সাফল্যের ভিত্তি তৈরি হয়েছে সি চিনপিংয়ের দীর্ঘদিনের আত্মনির্ভরতা নীতির মাধ্যমে। দেশীয় চিপ উৎপাদন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উচ্চপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ইউয়ানের ব্যবহার বেড়েছে ৩০ শতাংশ। ফলে চীন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর পথে এগোচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ১২০০ মিলিয়ন ব্যারেল তেলের বিশাল মজুত গড়ে তুলে বেইজিং কৌশলগত সুবিধা অর্জন করেছে।

এদিকে, ২০২৫ সালের অক্টোবরে, ছয় বছর পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে সি জিনপিং ‘মাগা’ (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) ঘরানার জন্য গ্রহণযোগ্য কিছু প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে ছিল ফেন্টানিল নিয়ন্ত্রণ ও সয়াবিন আমদানির মতো বিষয়। তবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক প্রযুক্তি ও শিল্প নেতৃত্বের যে স্বপ্ন বেইজিং লালন করে, সে বিষয়ে কোনো ছাড় দেননি তিনি। ২০২৬ সালের মার্চে প্রকাশিত নতুন পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় এই লক্ষ্য আরও জোরালোভাবে তুলে ধরা হবে।

দেশীয় চিপ উৎপাদন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উচ্চপ্রযুক্তি খাতে চীনের বিনিয়োগ বেড়েছে। ছবি: রয়টার্স
দেশীয় চিপ উৎপাদন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উচ্চপ্রযুক্তি খাতে চীনের বিনিয়োগ বেড়েছে। ছবি: রয়টার্স

তবে ইতিহাস বলছে, সাফল্যের পরই সি জিনপিংয়ের শাসনামলে অতিআত্মবিশ্বাসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ‘উলফ ওয়ারিয়র’ কূটনীতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। ‘কমন প্রসপারিটি’ অভিযানে উদ্যোক্তাদের আস্থা নষ্ট হয়। আর ‘জিরো কোভিড’ নীতি বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে চালু থাকায় অর্থনীতি ও সমাজে গভীর ক্ষত তৈরি হয়।

প্যাট্রিক বলেন, একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কর্মকর্তারা নেতার ভুল বা অস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু বলার সাহস পান না। এর পরিবর্তে তারা নেতার সব নির্দেশনা বাস্তবায়নে লেগে পড়ে।

২০২৬ সালে এই অতিআত্মবিশ্বাসের প্রবণতা আবারও মাথাচাড়া দিতে পারে তিনটি ক্ষেত্রে। প্রথমত, বাণিজ্য। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমে যাওয়ায় ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলে চীনা পণ্যের ঢল নেমেছে। ২০২৫ সালের প্রথম নয়মাসে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চীনের রপ্তানি ১১ শতাংশ বেড়েছে। বছরের শেষ দিকে জার্মানির সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলারে।

প্যাট্রিকের মতে, চীনের এই সাফল্যের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে শিল্পহীনতার আশঙ্কা বাড়তে পারে এবং নতুন শুল্ক আরোপের জন্য রাজনৈতিক চাপ তৈরি হতে পারে। তাই চীন যদি অতিরিক্ত উৎপাদন বিশ্ববাজারে ঠেলে দেয়, তবে সেটি বেইজিংয়ের জন্য উল্টো বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

দ্বিতীয়ত, তাইওয়ান। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, ২০২৭ সালের মধ্যে তাইওয়ান আক্রমণের সক্ষমতা অর্জনের নির্দেশ পেয়েছে চীনের সেনাবাহিনী। ওই বছরই আবার কমিউনিস্ট পার্টিকে আবার পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য কংগ্রেসে জিততে হবে। যে কারণে চীনা প্রেসিডেন্টের অনেক উপদেষ্টা মনে করেন, ২০২৬ সালেই দ্বীপটির ওপর চাপ বাড়ানো উচিত।

প্যাট্রিক বলেন, তাইওয়ান রক্ষায় ট্রাম্পের তেমন আগ্রহ নেই, আবার তাইওয়ানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন রয়েছে, সেই সঙ্গে তাইওয়ান ইস্যুতে প্রায় ৭০টি দেশের চীনের নীতির প্রতি সমর্থন-সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অনেক বেশি স্পর্শকাতর। এই উত্তেজনা ট্রাম্পের সময়ে আরও বাড়তে পারে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সঙ্গে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়তে পারে চীন।

তৃতীয় ঝুঁকি হলো, চীনের নেতৃত্বে নতুন বৈশ্বিক নিয়ম তৈরির চেষ্টা। অর্থনীতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জলবায়ু ও মহাকাশ নিয়ে চীনের ‘গ্লোবাল গর্ভন্যান্স ইনিশিয়েটিভ’ এবং বিরল খনিজ নিয়ে চীনের প্রস্তাবগুলো অনেক দেশের কাছে প্রভাব বিস্তারের কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে এসব নিয়মে অতিনির্ভরতা নিয়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর উদ্বেগ বাড়ছে।

এই প্রেক্ষাপটে সি জিনপিংয়ের সামনে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ হতে পারে সংযম। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো, রপ্তানির চাপ কমানো, তাইওয়ান প্রশ্নে অপেক্ষা করা এবং বিশ্বকে জোর না করে সহযোগিতার বার্তা দেওয়া-এই কৌশল চীনের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষা করতে পারে বলে মনে করেন প্যাট্রিক।

কারণ বাস্তবতা হলো, পশ্চিমা বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে চীনের চেয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পই বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ঝুঁকি না নিয়ে অপেক্ষা করাই হয়তো ২০২৬ সালে চীনের সবচেয়ে বড় কৌশলগত জয় হতে পারে বলে এই সাংবাদিকের পরামর্শ।

সম্পর্কিত