আরমান ভূঁইয়া

গত ১৪ নভেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর উলন এলাকায় চোর সন্দেহে ১৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ বাপ্পি নামের এক কিশোরকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। ওই কিশোরকে প্রথমে চুরির অপবাদ দিয়ে একদিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। হাতুড়ি ও এসএস পাইপ দিয়ে মাথায় আঘাতের পর তার সারা শরীরে হলুদ ও লবণ মাখিয়ে উল্লাস করে একদল ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’।
গত ৫ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ‘তৌহিদি জনতা’ পরিচয়ে এক দল মানুষ আধ্যাত্মিক সাধক নুরুল হক ওরফে ‘নুরাল পাগলা’র কবর, বাড়ি ও দরবারে হামলা চালায়। কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন করে মহাসড়কের পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
গত ১৮ ডিসেম্বর হাদির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহের ভালুকায় দিপু চন্দ্র দাস (২৮) নামে এক হিন্দু পোশাক শ্রমিককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংঘবদ্ধভাবে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, এ ঘটনায় ধর্ম অবমাননার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২০২৫ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে চুরি, ছিনতাই কিংবা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংঘবদ্ধ হামলা, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বাংলাদেশে গত দেড় বছরে ছড়িয়ে পড়েছে, যা পরিচিতি পেয়েছে ‘মব’ নামে। তবে ‘মব সন্ত্রাস’ বাংলাদেশে নতুন নয়। বাংলাদেশে এর সবশেষ শিকার দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকা। কখনো ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’, কখনো ‘তৌহিদি জনতা’র নামে সংঘটিত হচ্ছে এ অপরাধ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে ব্যক্তিগত কারণে ঘটেছে এসব ঘটনা। এর হাত থেকে রক্ষা পাননি বাউলরাও।
গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে হাদির মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর শাহবাগে জড়ো হওয়া কয়েক শতাধিক মানুষ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর প্রধান কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় তারা দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ভবনে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব ঘটনাকে দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
মবের পরিসংখ্যান
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মব সহিংসতায় অন্তত ১৮৪ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ৭৮ জন। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। সেখানে নিহত হয়েছে ৩২ জন।
আসকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে ঢাকায় ৫৭ জনসহ সারাদেশে ১২৮ জন মব সহিংসতায় নিহত হয়েছেন। আর ২০২০ থেকে ২০২৩-এই চার বছরে মবের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৫০ জন।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি-নভেম্বর সময়ে দেশের ১৫টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে অন্তত ২৭৬টি মব সহিংসতার ঘটনায় অন্তত ১৫৬ জন নিহত এবং ২৪২ জন আহত হয়েছে।
দেশজুড়ে আলোচিত কিছু মবের ঘটনা
গত ২২ জুন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে হেনস্তা ও জুতার মালা পরানোর ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ঢাকা মহানগর বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক দলসহ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ১৬ জুন লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে চোর সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। ১৩ মে নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে যুবলীগ কর্মী জাকির হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এ ছাড়া গত ৪ মার্চ রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ইরানি নাগরিককে গণপিটুনি দিয়ে আহত করা; ৩ মার্চ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নে মাইকে ডাকাত ঘোষণা দিয়ে দুই জামায়াত কর্মীকে হত্যা করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে ডাকাত সন্দেহে পিটুনিতে পাঁচজন নিহত হয়।
হবিগঞ্জের বাহুবলে জাহেদ মিয়াকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতনের একপর্যায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পাবনার ঈশ্বরদীতে এক নারীকে লোহার খুঁটিতে বেঁধে মারধর ও জুতার মালা পরানোর ঘটনাও ঘটে। ২২ আগস্ট চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে তিন কিশোরকে পিটিয়ে আহত করা হয়, যার মধ্যে একজন নিহত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে এক মানসিক প্রতিবন্ধী যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২১ অক্টোবর গাজীপুরের টঙ্গীতে নিহত এক যুবকের মরদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করে জনতা।
দেশে ‘মব সন্ত্রাসের’ নামে সংঘবদ্ধভাবে সন্ত্রাসী হামলা করা হচ্ছে উল্লেখ করে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন চরচাকে বলেন, “৫ আগস্টের পর থেকেই দেশে একটি ভয়াবহ বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। সংঘবদ্ধভাবে মানুষকে নির্যাতন, সম্পদ দখল, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা প্রমাণ করে এগুলো পরিকল্পিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।”

এই মানাবধিকার কর্মী বলেন, “এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেশের গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের অর্জনের জন্য মারাত্মক হুমকি। আরও উদ্বেগজনক হলো–কিছু রাজনৈতিক দল এসব হামলাকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করছে, যা কার্যত সন্ত্রাসকে উসকে দিচ্ছে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জনগণের ঐক্যই একমাত্র ভরসা।”
সাম্প্রতিক মব সন্ত্রাস নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব সেবাস্টিন রেমা চরচাকে বলেন, “জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ভেঙে দেওয়ার পর থেকে আমরা কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারিনি। যেহেতু কোনো কমিশন নেই, তাই প্রকাশ করা যায়নি। আবার কমিশন গঠন হলে আমরা নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করব।”
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন চরচাকে বলেন, “মব সহিংসতার পেছনে থাকা অনেক উসকনিদাতা বিদেশ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া ও গোপন আইডির মাধ্যমে উসকানি দেয়। পুলিশ এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করেছে।”
আইন না মানার প্রবণতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে মব সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “এই সমস্যা মোকাবিলার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সামাজিক সচেতনতার ঘাটতি এবং আইন মানার প্রবণতা কমে যাওয়া। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এককভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। মব সহিংসতা প্রতিরোধে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। সমাজ সচেতন হলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।”
মব সহিংসতা নিয়ে যা বলছেন ছাত্র নেতারা
মব সহিংসতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও উদ্বেগ বাড়ছে। তরুণ রাজনৈতিক নেতারা এই সহিংসতার কারণ, দায় এবং উত্তরণের পথ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। ছাত্র সংগঠন ও নবীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের বক্তব্যে উঠে এসেছে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা, রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন।
ছাত্রদল: সহিংসতার অভ্যস্ততা থেকেই মব প্রবণতা
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির চরচাকে বলেন, “বাংলাদেশে মব কালচার নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে ৫ আগস্টের পর ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এই প্রবণতা আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ওই সময় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, সহিংসতা, প্রাণহানি ও ব্যাপক আহতের ঘটনা মানুষকে সহিংসতার সঙ্গে এক ধরনের অভ্যস্ত করে তুলেছে। এর ফলেই পরবর্তীকালে সমাজে মব সহিংসতার প্রবণতা কিছুটা স্বাভাবিক রূপ পেয়েছে।”
নাছির আরও বলেন, “৫ আগস্টের পর একটি শ্রেণি পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য মব তৈরির অপচেষ্টা করছে। আন্দোলনের সময় মানুষ যে সহিংস চরিত্র প্রত্যক্ষ করেছে, তারই একটি বিকৃত প্রতিফলন পরবর্তীকালে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে।”
মব নিয়ে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে নাছির উদ্দীন বলেন, “বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি ঘটনা ঘটতে পারে। তবে সংগঠিত বা সামগ্রিকভাবে ছাত্রদলের কোনো মব-সংশ্লিষ্টতা নেই। মব কালচার তরুণদের ধ্বংসাত্মক পথে ঠেলে দেয় এবং আইনের শাসন দুর্বল করে। এ কারণে ছাত্রদল ইতোমধ্যে সারাদেশে নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছে এবং জেলা ও বিভাগীয় ইউনিটগুলোকে লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনোভাবেই বিশৃঙ্খলা বা মব তৈরি না হয়।”
এনসিপি: উসকানিমূলক বক্তব্যই সহিংসতার বড় কারণ
জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন চরচাকে বলেন, “মব সহিংসতা কোনো নির্দিষ্ট সাংগঠনিক বা সাংস্কৃতিক কাঠামোর অংশ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তির ইচ্ছা ও তাৎক্ষণিক উগ্র মানসিকতা থেকেই এসব সহিংস ঘটনা ঘটে। যদিও এতে সমষ্টিগত উসকানি থাকে, তবে হামলার সময় প্রত্যেকেই আলাদা ব্যক্তি হিসেবেই ভূমিকা রাখে।”
নিজের দলের বিষয়ে তুলে ধরে সামান্তা বলেন, “এনসিপি একটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। দলের কোনো নেতা বা কর্মীর বিরুদ্ধে যদি ভাঙচুর, অগ্নিসন্ত্রাস বা সহিংসতায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে কোনো ছাড় না দিয়ে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। এ বিষয়ে দলীয়ভাবে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতার নামে সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
ইসলামী ছাত্র শিবিরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে এনসিপির এই নেতা বলেন, “বিএনপি এ বিষয়ে তুলনামূলকভাবে শক্ত অবস্থান নিলেও জামায়াতের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। তাদের কেন্দ্রীয় ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা নিয়মিত উসকানিমূলক বক্তব্য দেন, যার ফলেই মাঠে সহিংসতা ঘটে। পরে আবার কেন্দ্র থেকে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হয়।”
এনসিপি নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য প্রসঙ্গে সামান্তা বলেন, তাদের দলসহ বিভিন্ন দলের অনেক নেতাই মাঝে মাঝে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন, যা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পরিপন্থী।
ছাত্রশিবির: শাহবাগের পর থেকেই মব সংস্কৃতির বিস্তার
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশে মব সহিংসতা নতুন নয়। তবে শাহবাগ আন্দোলনের পর থেকে এটি বৃহৎ পরিসরে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে একটি সংস্কৃতিতে রূপ নেয়। ওই সময় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কিংবা বড় পরিসরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা, সম্পাদকদের ওপর আক্রমণ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটতে থাকে।”
জাহিদুল বলেন, “৫ আগস্টের পর কিছু ঘটনায় মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেলেও তা ধীরে ধীরে মব কালচারে রূপ নিয়েছে। ছাত্রশিবির এ ধরনের সহিংসতার সঙ্গে কোনোভাবেই একমত নয় এবং কখনোই এর সমর্থন করে না। যেকোনো বিষয়ে বিরোধ থাকলে তা নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই মোকাবিলা করা উচিত।”
তার দাবি তাদের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ যেন মব সহিংসতায় জড়িত না হয়, সে বিষয়ে দলীয়ভাবে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চলছে।
ছাত্র ইউনিয়ন: রাষ্ট্রীয় বৈধতাই মব সহিংসতার বড় কারণ
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি মেঘমল্লার বসু মবের পক্ষে রাষ্ট্রের অবস্থান নেওয়াকে দায়ী করে বলেন, “দেশে সহিংসতা ও নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কিছু বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য এবং রাষ্ট্রক্ষমতার বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান এই বৈধতা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।”
মেঘমল্লার বলেন, “বইমেলা, গণমাধ্যম অফিস কিংবা সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণে প্রকাশ্য হামলাকে ‘মব’ না বলে ‘স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেখানে দ্ব্যর্থহীন নিন্দা প্রয়োজন ছিল, সেখানে সহিংসতার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে। এর ফলে অপরাধী ও উগ্র গোষ্ঠীগুলো এক ধরনের আশকারা পেয়ে গেছে।”
মব সহিংসতা বন্ধের উপায় নিয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। যে মতাদর্শের মানুষই হোক, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে জড়ালে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের বাস্তব সুযোগ তৈরি করতে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার জরুরি বলেও মন্তব্য করেন মেঘমল্লার।

গত ১৪ নভেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর উলন এলাকায় চোর সন্দেহে ১৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ বাপ্পি নামের এক কিশোরকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। ওই কিশোরকে প্রথমে চুরির অপবাদ দিয়ে একদিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। হাতুড়ি ও এসএস পাইপ দিয়ে মাথায় আঘাতের পর তার সারা শরীরে হলুদ ও লবণ মাখিয়ে উল্লাস করে একদল ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’।
গত ৫ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ‘তৌহিদি জনতা’ পরিচয়ে এক দল মানুষ আধ্যাত্মিক সাধক নুরুল হক ওরফে ‘নুরাল পাগলা’র কবর, বাড়ি ও দরবারে হামলা চালায়। কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন করে মহাসড়কের পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
গত ১৮ ডিসেম্বর হাদির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহের ভালুকায় দিপু চন্দ্র দাস (২৮) নামে এক হিন্দু পোশাক শ্রমিককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংঘবদ্ধভাবে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, এ ঘটনায় ধর্ম অবমাননার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২০২৫ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে চুরি, ছিনতাই কিংবা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংঘবদ্ধ হামলা, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বাংলাদেশে গত দেড় বছরে ছড়িয়ে পড়েছে, যা পরিচিতি পেয়েছে ‘মব’ নামে। তবে ‘মব সন্ত্রাস’ বাংলাদেশে নতুন নয়। বাংলাদেশে এর সবশেষ শিকার দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকা। কখনো ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’, কখনো ‘তৌহিদি জনতা’র নামে সংঘটিত হচ্ছে এ অপরাধ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে ব্যক্তিগত কারণে ঘটেছে এসব ঘটনা। এর হাত থেকে রক্ষা পাননি বাউলরাও।
গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে হাদির মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর শাহবাগে জড়ো হওয়া কয়েক শতাধিক মানুষ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর প্রধান কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় তারা দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ভবনে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব ঘটনাকে দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
মবের পরিসংখ্যান
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মব সহিংসতায় অন্তত ১৮৪ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ৭৮ জন। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। সেখানে নিহত হয়েছে ৩২ জন।
আসকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে ঢাকায় ৫৭ জনসহ সারাদেশে ১২৮ জন মব সহিংসতায় নিহত হয়েছেন। আর ২০২০ থেকে ২০২৩-এই চার বছরে মবের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৫০ জন।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি-নভেম্বর সময়ে দেশের ১৫টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে অন্তত ২৭৬টি মব সহিংসতার ঘটনায় অন্তত ১৫৬ জন নিহত এবং ২৪২ জন আহত হয়েছে।
দেশজুড়ে আলোচিত কিছু মবের ঘটনা
গত ২২ জুন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে হেনস্তা ও জুতার মালা পরানোর ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ঢাকা মহানগর বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক দলসহ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ১৬ জুন লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে চোর সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। ১৩ মে নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে যুবলীগ কর্মী জাকির হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এ ছাড়া গত ৪ মার্চ রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ইরানি নাগরিককে গণপিটুনি দিয়ে আহত করা; ৩ মার্চ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নে মাইকে ডাকাত ঘোষণা দিয়ে দুই জামায়াত কর্মীকে হত্যা করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে ডাকাত সন্দেহে পিটুনিতে পাঁচজন নিহত হয়।
হবিগঞ্জের বাহুবলে জাহেদ মিয়াকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতনের একপর্যায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পাবনার ঈশ্বরদীতে এক নারীকে লোহার খুঁটিতে বেঁধে মারধর ও জুতার মালা পরানোর ঘটনাও ঘটে। ২২ আগস্ট চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে তিন কিশোরকে পিটিয়ে আহত করা হয়, যার মধ্যে একজন নিহত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে এক মানসিক প্রতিবন্ধী যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২১ অক্টোবর গাজীপুরের টঙ্গীতে নিহত এক যুবকের মরদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করে জনতা।
দেশে ‘মব সন্ত্রাসের’ নামে সংঘবদ্ধভাবে সন্ত্রাসী হামলা করা হচ্ছে উল্লেখ করে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন চরচাকে বলেন, “৫ আগস্টের পর থেকেই দেশে একটি ভয়াবহ বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। সংঘবদ্ধভাবে মানুষকে নির্যাতন, সম্পদ দখল, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা প্রমাণ করে এগুলো পরিকল্পিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।”

এই মানাবধিকার কর্মী বলেন, “এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেশের গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের অর্জনের জন্য মারাত্মক হুমকি। আরও উদ্বেগজনক হলো–কিছু রাজনৈতিক দল এসব হামলাকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করছে, যা কার্যত সন্ত্রাসকে উসকে দিচ্ছে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জনগণের ঐক্যই একমাত্র ভরসা।”
সাম্প্রতিক মব সন্ত্রাস নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব সেবাস্টিন রেমা চরচাকে বলেন, “জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ভেঙে দেওয়ার পর থেকে আমরা কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারিনি। যেহেতু কোনো কমিশন নেই, তাই প্রকাশ করা যায়নি। আবার কমিশন গঠন হলে আমরা নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করব।”
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন চরচাকে বলেন, “মব সহিংসতার পেছনে থাকা অনেক উসকনিদাতা বিদেশ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া ও গোপন আইডির মাধ্যমে উসকানি দেয়। পুলিশ এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করেছে।”
আইন না মানার প্রবণতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে মব সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “এই সমস্যা মোকাবিলার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সামাজিক সচেতনতার ঘাটতি এবং আইন মানার প্রবণতা কমে যাওয়া। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এককভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। মব সহিংসতা প্রতিরোধে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। সমাজ সচেতন হলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।”
মব সহিংসতা নিয়ে যা বলছেন ছাত্র নেতারা
মব সহিংসতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও উদ্বেগ বাড়ছে। তরুণ রাজনৈতিক নেতারা এই সহিংসতার কারণ, দায় এবং উত্তরণের পথ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। ছাত্র সংগঠন ও নবীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের বক্তব্যে উঠে এসেছে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা, রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন।
ছাত্রদল: সহিংসতার অভ্যস্ততা থেকেই মব প্রবণতা
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির চরচাকে বলেন, “বাংলাদেশে মব কালচার নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে ৫ আগস্টের পর ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এই প্রবণতা আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ওই সময় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, সহিংসতা, প্রাণহানি ও ব্যাপক আহতের ঘটনা মানুষকে সহিংসতার সঙ্গে এক ধরনের অভ্যস্ত করে তুলেছে। এর ফলেই পরবর্তীকালে সমাজে মব সহিংসতার প্রবণতা কিছুটা স্বাভাবিক রূপ পেয়েছে।”
নাছির আরও বলেন, “৫ আগস্টের পর একটি শ্রেণি পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য মব তৈরির অপচেষ্টা করছে। আন্দোলনের সময় মানুষ যে সহিংস চরিত্র প্রত্যক্ষ করেছে, তারই একটি বিকৃত প্রতিফলন পরবর্তীকালে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে।”
মব নিয়ে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে নাছির উদ্দীন বলেন, “বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি ঘটনা ঘটতে পারে। তবে সংগঠিত বা সামগ্রিকভাবে ছাত্রদলের কোনো মব-সংশ্লিষ্টতা নেই। মব কালচার তরুণদের ধ্বংসাত্মক পথে ঠেলে দেয় এবং আইনের শাসন দুর্বল করে। এ কারণে ছাত্রদল ইতোমধ্যে সারাদেশে নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছে এবং জেলা ও বিভাগীয় ইউনিটগুলোকে লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনোভাবেই বিশৃঙ্খলা বা মব তৈরি না হয়।”
এনসিপি: উসকানিমূলক বক্তব্যই সহিংসতার বড় কারণ
জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন চরচাকে বলেন, “মব সহিংসতা কোনো নির্দিষ্ট সাংগঠনিক বা সাংস্কৃতিক কাঠামোর অংশ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তির ইচ্ছা ও তাৎক্ষণিক উগ্র মানসিকতা থেকেই এসব সহিংস ঘটনা ঘটে। যদিও এতে সমষ্টিগত উসকানি থাকে, তবে হামলার সময় প্রত্যেকেই আলাদা ব্যক্তি হিসেবেই ভূমিকা রাখে।”
নিজের দলের বিষয়ে তুলে ধরে সামান্তা বলেন, “এনসিপি একটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। দলের কোনো নেতা বা কর্মীর বিরুদ্ধে যদি ভাঙচুর, অগ্নিসন্ত্রাস বা সহিংসতায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে কোনো ছাড় না দিয়ে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। এ বিষয়ে দলীয়ভাবে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতার নামে সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
ইসলামী ছাত্র শিবিরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে এনসিপির এই নেতা বলেন, “বিএনপি এ বিষয়ে তুলনামূলকভাবে শক্ত অবস্থান নিলেও জামায়াতের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। তাদের কেন্দ্রীয় ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা নিয়মিত উসকানিমূলক বক্তব্য দেন, যার ফলেই মাঠে সহিংসতা ঘটে। পরে আবার কেন্দ্র থেকে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হয়।”
এনসিপি নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য প্রসঙ্গে সামান্তা বলেন, তাদের দলসহ বিভিন্ন দলের অনেক নেতাই মাঝে মাঝে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন, যা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পরিপন্থী।
ছাত্রশিবির: শাহবাগের পর থেকেই মব সংস্কৃতির বিস্তার
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশে মব সহিংসতা নতুন নয়। তবে শাহবাগ আন্দোলনের পর থেকে এটি বৃহৎ পরিসরে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে একটি সংস্কৃতিতে রূপ নেয়। ওই সময় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কিংবা বড় পরিসরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা, সম্পাদকদের ওপর আক্রমণ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটতে থাকে।”
জাহিদুল বলেন, “৫ আগস্টের পর কিছু ঘটনায় মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেলেও তা ধীরে ধীরে মব কালচারে রূপ নিয়েছে। ছাত্রশিবির এ ধরনের সহিংসতার সঙ্গে কোনোভাবেই একমত নয় এবং কখনোই এর সমর্থন করে না। যেকোনো বিষয়ে বিরোধ থাকলে তা নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই মোকাবিলা করা উচিত।”
তার দাবি তাদের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ যেন মব সহিংসতায় জড়িত না হয়, সে বিষয়ে দলীয়ভাবে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চলছে।
ছাত্র ইউনিয়ন: রাষ্ট্রীয় বৈধতাই মব সহিংসতার বড় কারণ
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি মেঘমল্লার বসু মবের পক্ষে রাষ্ট্রের অবস্থান নেওয়াকে দায়ী করে বলেন, “দেশে সহিংসতা ও নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কিছু বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য এবং রাষ্ট্রক্ষমতার বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান এই বৈধতা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।”
মেঘমল্লার বলেন, “বইমেলা, গণমাধ্যম অফিস কিংবা সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণে প্রকাশ্য হামলাকে ‘মব’ না বলে ‘স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেখানে দ্ব্যর্থহীন নিন্দা প্রয়োজন ছিল, সেখানে সহিংসতার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে। এর ফলে অপরাধী ও উগ্র গোষ্ঠীগুলো এক ধরনের আশকারা পেয়ে গেছে।”
মব সহিংসতা বন্ধের উপায় নিয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। যে মতাদর্শের মানুষই হোক, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে জড়ালে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের বাস্তব সুযোগ তৈরি করতে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার জরুরি বলেও মন্তব্য করেন মেঘমল্লার।