ইরানের জনবিক্ষোভের পেছনে ট্রাম্প কি জড়িত?

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
ইরানের জনবিক্ষোভের পেছনে ট্রাম্প কি জড়িত?
গত কয়েকদিন ধরেই ইরানে বিক্ষোভে জনজীবন বিপর্যস্ত। ছবি: রয়টার্স

গত দুই দিনে ইরানের রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে উঠেছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে ইরানি রিয়ালের মান নেমে যাওয়া এবং মূল্যস্ফীতি ৪২ শতাংশের ওপরে ওঠায়, সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির নেতৃত্বাধীন ধর্মীয় শাসনব্যবস্থা গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদের মুখে পড়েছে।

ইরানি-আমেরিকান সাংবাদিক ও লেখক মাসিহ আলিনেজাদ তার এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, “ইরান থেকে এমন অসংখ্য ভিডিও আসছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে মানুষ একযোগে রাস্তায় স্লোগান দিচ্ছে, ‘মোল্লাদের ইরান ছাড়তে হবে’, ‘স্বৈরশাসনের পতন হোক’ ইত্যাদি। মনে হচ্ছে ইরানের জনগণ এখন ইসলামি প্রজাতন্ত্র চায় না।”

৯ কোটির বেশি মানুষের বাস এই দেশে। আর্থিক সংকট ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি এখন ইরানের ধর্মীয় শাসনব্যবস্থার জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েল কর্তৃক পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ম্যাক্সিমাম প্রেসার’ নীতির প্রভাব থেকে দেশটি এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর মধ্যে শাসনব্যবস্থার বিরদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ তাই স্বাভাবিকভাবে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসছে, বর্তমান অস্থিরতা কি কেবল অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া নাকি ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে যে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, তারই ফল?

ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আইআরএনএ বিক্ষোভের কথা স্বীকার করলেও এই অস্থিরতাকে ধর্মতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিদ্রোহ হিসেবে নয়, বরং অর্থনৈতিক দুর্ভোগজনিত ছোটখাটো প্রতিবাদ হিসেবে তুলে ধরেছে। আইআরএনএ জানায়, রিয়ালের অবমূল্যায়নের কারণে ক্ষুব্ধ মোবাইল ফোন বিক্রেতারাই এই প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

জনবিক্ষোভের কারণ কী?

গত রোববার থেকে ইরান বিগত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় গণজমায়েতের সাক্ষী হচ্ছে। এর আগে ২০২২-২৩ সালে মাহশা আমিনির মৃত্যুর পর মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। সেই আন্দোলন ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং দেশজুড়ে বিক্ষোভ দমনে নির্মম প্রতিক্রিয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী তীব্র নিন্দার মুখে পড়েছিল ইরানি সরকার।

সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) তেহরান ও মাশহাদে বিক্ষোভকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, ইরানি কর্তৃপক্ষ লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তেহরানের একটি শপিং কমপ্লেক্সের ভেতরে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিচ্ছে- “ভয় পেও না, আমরা সবাই একসঙ্গে আছি।” তারা নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘নির্লজ্জ’ বলে গালাগালি করে বলে ফক্স নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ইরানের বিধ্বস্ত অর্থনীতি এখন ধর্মতান্ত্রিক শাসনের প্রতি মানুষের রাজনৈতিক ক্ষোভ জাগিয়ে তুলছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে রিয়ালের পতন ইরানের ইতিহাসের সর্বনিম্ন। এর ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে এবং খাদ্য, ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।

বার্তা সংস্থা এপি বলছে, এই বিক্ষোভের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মোহাম্মদ রেজা ফারজিন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং তেহরান, ইস্পাহান, সিরাজ ও মাশহাদের ব্যবসায়ী, দোকানদার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নেমে আসে। তবে ইরানিদের ক্ষোভ শুধু একটা বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মূল্যস্ফীতি আকাশচুম্বী, খাদ্য ও স্বাস্থ্যব্যয় বেড়েই চলেছে, আর অর্থনৈতিক দুর্দশা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অসন্তোষে রূপ নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেন, ভেঙে পড়া অর্থনীতির কারণে ইরানিরা রাস্তায় নেমে আসছে। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তিনি এই পরিস্থিতির জন্য শাসকগোষ্ঠীর চরমপন্থা ও দুর্নীতিকে দায়ী করেন। নিজের এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন, “ইরানি শাসকগোষ্ঠী তাদের চরমপন্থা ও দুর্নীতির মাধ্যমে একটি দেশকে ধ্বংস করেছে, যা হওয়া উচিত ছিল প্রাণবন্ত ও সমৃদ্ধ। ইরানের মানুষ এমন একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার পাওয়ার যোগ্য, যা তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে। মোল্লা ও তাদের ঘনিষ্ঠদের নয়।”

এর পেছনে ট্রাম্পের কি হাত আছে?

ইরানের এই সংকট আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে আলাদা করে দেখা যায় না। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের পর নতুন অনিশ্চয়তা, জাতিসংঘের পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের চাপ–সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে যে, খামেনির শাসনব্যবস্থার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুযোগের পরিসর দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে।

২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়ানো এবং ট্রাম্পের ধারাবাহিক “ম্যাক্সিমাম প্রেসার”-এর কারণে রিয়ালের পতন শরু হয়। ইরানের বৈদেশিক আয় সংকুচিত হয় এবং দেশটি আর্থিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। ইরানের অর্থনীতিতে মার্কিন নীতির ছায়া বৃহৎ আকার ধারণ করছে। এদিকে, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধও ইরানের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। গাজাভিত্তিক সংগঠন হামাস আসলে ইরানের ধর্মতান্ত্রিক শাসনের একটি ‘প্রক্সি’।

সোমবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের সময় ট্রাম্প ইরানের ওপর নতুন হামলার হুঁশিয়ারি দেন এবং বলেন, গাজায় হামাস নিরস্ত্র না হলে তাদের ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে।

অর্থনীতিবিদ আমির হোসেইন মাহদাভি সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, নিষেধাজ্ঞা শিথিল না হলে বা ব্যয়ে বড় ধরনের কাটছাঁট না করলে দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি আরও বাড়বে। সাধারণ ইরানিদের জন্য আয় কমে যাওয়া ও দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় দৈনন্দিন জীবন পরিণত হয়েছে প্রতিনিয়ত হিসাব-নিকাশের লড়াইয়ে। মাহদাভির মতে, এই অস্থিরতা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়, বরং ট্রাম্পের সময়ে নেওয়া নীতিগুলোর দীর্ঘমেয়াদি পরিণতির সমষ্টিগত ফল।

সবশেষে বলা যায়, খামেনির ধর্মতান্ত্রিক শাসনে বছরের পর বছর চাপের নিচে থাকা অর্থনীতি ও বিধ্বস্ত সমাজব্যবিস্থার বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা ও তেহরানের বিরুদ্ধে নতুন সামরিক হুমকি সেই চাপ আরও বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ স্পষ্টভাবেই ইরানি শাসনের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতাকে এমন এক সংকটে রূপ দিয়েছে, যা এখন আলি খামেনি ও তার সরকারের জন্য অস্তিত্বের সংকট বলে মনে হচ্ছে।

সম্পর্কিত