কীভাবে ইলেকট্রোস্টেট হতে হয়

নোয়াহ গর্ডন
নোয়াহ গর্ডনদেবান মঙ্গলমূর্তি
কীভাবে ইলেকট্রোস্টেট হতে হয়
ভোক্তা ইলেকট্রোস্টেট হওয়ার অনেক সুবিধা আছে। বৈদ্যুতিক শক্তি জ্বালানির তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

‘ইলেকট্রোস্টেট’ শব্দটি এই বছরের ভূ-রাজনৈতিক আলোচনার মূল কেন্দ্রে থাকতে পারে। একাধিক বিশ্লেষক চীনকে বিশ্বের প্রথম ‘ইলেকট্রোস্টেট’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন।

তারা বলছেন, চীন একদিকে যেমন পরিচ্ছন্ন শক্তি (ইলেক্ট্রিসিটি) প্রযুক্তির প্রধান রপ্তানিকারক, একইভাবে দেশটি দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর যন্ত্রপাতি বদলে বিদ্যুৎ-চালিত বিকল্প ব্যবহার করা শুরু করেছে।

বিশ্লেষকরা ঠিকই বলছেন। তবে তারা যে শব্দটি ব্যবহার করছেন, তার দুটি স্পষ্ট অর্থ রয়েছে। এই দ্ব্যর্থতা কেবল একটি তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় নয়। কোনো দেশের নীতিনির্ধারকরা বিভ্রান্ত হলে তাদের দেশের জন্য কোন ধরনের ‘ইলেকট্রোস্টেট’ হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে ভুল শিক্ষা গ্রহণ করার ঝুঁকি তৈরি হয়।

চীনকে ইলেকট্রোস্টেট বলার মূলত দুটি কারণ আছে। প্রথমটা হলো, ২০২৪ সালে দেশটির জিডিপির ১০ শতাংশেরও বেশি এসেছে বিদ্যুৎ খাত থেকে এবং সোলার প্যানেল ও ব্যাটারির রপ্তানি বাজারে এর আধিপত্য।

দ্বিতীয়টি হলো, চীনের অভ্যন্তরীণ বিদ্যুতের ব্যবহার। চীনে চূড়ান্ত জ্বালানি ব্যবহারে বিদ্যুতের অংশ প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ছাড়িয়ে গেছে এবং জাপানের সমান হয়েছে।

অর্থাৎ চীন প্রস্ততকারক এবং ভোক্তা-এই দুই হিসাবেই একটা ইলেকট্রোস্টেট। তবে কোনো দেশের পক্ষে টেকসই জ্বালানি প্রযুক্তির প্রধান প্রস্তুতকারক না হয়েও নিজস্ব অর্থনীতিকে বিদ্যুতায়িত করার লক্ষ্য রাখা সম্ভব। এর একটি উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশে চূড়ান্ত শক্তি খরচে বিদ্যুতের একক অংশীদারত্ব অনেক বেশি আর তা ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশটি যদিও খুব বেশি টেকসই প্রযুক্তির পণ্য উৎপাদন করে না, তবে সেগুলো ব্যবহার বাড়াচ্ছে, যেমন, হাসপাতাল ও স্কুলের মতো সরকারি ভবনগুলোতে সৌর প্যানেল বসানো বাধ্যতামূলক করছে। যদিও বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত বিদ্যুৎ আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে, তবুও চূড়ান্ত শক্তি খরচে বিদ্যুতের অংশীদারত্বের নিরিখে দেশটি একটি ভোক্তা ইলেক্ট্রোস্টেটে পরিণত হচ্ছে।

পাকিস্তান এখন বিদ্যুৎ ব্যবহারে গুরুত্ব দিচ্ছে। গত ছয় বছরে দেশটি চীন থেকে এত বেশি সৌর প্যানেল আমদানি করেছে যে, এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কার্যত দ্বিগুণ করা সম্ভব। পাশাপাশি, অনেক পাকিস্তানি নাগরিক এখন সৌরবিদ্যুৎ সংরক্ষণের জন্য চীনা ব্যাটারিও আনছেন, যাতে প্রাকৃতিক আলো না থাকলেও সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়।

ফলে দেশটি আর আগের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির দামের ওঠানামা বা বিদ্যুৎ সংকটের ঝুঁকিতে নেই। ২০২২ সালে ইউরোপের দেশগুলো যখন রাশিয়া থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ করে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি দামে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস কিনে নেয়, তখন পাকিস্তানে ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি বদলেছে।

অন্যদিকে, তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত সৌদি আরবও ২০২৪ সালে চীনা সৌর প্যানেলের চতুর্থ বৃহত্তম ক্রেতা ছিল। দেশটি নিজ অর্থনীতিকে বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে আরও বেশি তেল-গ্যাস রপ্তানির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।

আসলে, বেশিরভাগ দেশের জন্য এখন ‘ভোক্তা ইলেকট্রোস্টেট’ হওয়াই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বড় উন্নয়নশীল দেশগুলো, যেমন ভিয়েতনাম বা ভারত, যদি সৌর খাত আরও একত্রিত হয়, তাহলে তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে।

কিন্তু বেশিরভাগ দেশের জন্য চীনের বাজারে সরাসরি প্রতিযোগিতা করাটা খুবই কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, সৌর প্যানেল তৈরি করতে ব্যবহৃত পলিসিলিকন ওয়েফারের বাজারে চীনের অবস্থান বিশ্বে প্রায় অদম্য।

সৌর প্যানেল এখন ক্রমেই সস্তা হচ্ছে। লাভের পরিমাণও খুব কম। তাই চীনের অভ্যন্তরীণ মূল্যযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য দেশগুলোর জন্য নিজস্ব উৎপাদনশিল্প শুরু করা সহজ হবে না।

ভোক্তা ইলেকট্রোস্টেট হওয়ার অনেক সুবিধা আছে। বৈদ্যুতিক শক্তি জ্বালানির তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর। এটি পরিষ্কার, বায়ু দূষণ কমায় এবং কার্বন নিঃসরণও হ্রাস করে। সবচেয়ে বড় কথা, এটি নিরাপদ। সূর্যের তাপ আর বাতাসের চাপ হয়ত একইরকম থাকে না। তেল বা গ্যাসের আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা বা অর্থনৈতিক সংকট দিয়ে আলো-বাতাসকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ালে মানুষ তাদের দক্ষতা আরও ভালভাবে কাজে লাগাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকার গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া বা ১৯৭০-এর দশকে ব্রাজিলে জলবিদ্যুৎ চালিত বিদ্যুতায়ন মানুষকে দক্ষতা আরও ভালোভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ দিয়েছিল।

যদি কোনো দেশের নীতিনির্ধারকদের প্রধান লক্ষ্য হয় কার্বন নিঃসরণ কমানো, তাহলেও বিদ্যুতায়ন ফসিল জ্বালানির চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাজনক। আবার, চীন দেখিয়েছে যে বিদ্যুতায়ন এবং কয়লার ব্যবহার একসাথে বৃদ্ধি পেতেও কোনো সমস্যা নেই।

যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এখনো ফসিল জ্বালানি ব্যবহার করা হয়, তাই কোনো দেশ যদি ভোক্তা ইলেকট্রোস্টেট হয়, তবে তা জলবায়ুর জন্য উপকারী। উদাহরণস্বরূপ, গ্যাস ফার্নেসের বদলে হিট পাম্প ব্যবহার করলেও, এমনকি আমেরিকার সবচেয়ে দূষিত বিদ্যুৎ মিশ্রণ থাকা রাজ্যগুলিতেও কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়। একইভাবে, বৈদ্যুতিক গাড়ি, ফসিল জ্বালানি-নির্ভর গ্যাস গাড়ির তুলনায় কম কার্বন নিঃসরণ করে।

কিছু পরিচ্ছন্ন শক্তি-প্রযুক্তি উৎপাদন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু প্রযুক্তি, যেমন ব্যাটারি উৎপাদন সৌর প্যানেলের তুলনায় বেশি চাকরি সৃষ্টি করে ও বেশি লাভজনক। এছাড়া, পরিচ্ছন্ন শক্তি প্রযুক্তি এবং অন্যান্য প্রধান শিল্পের মধ্যে এতটা সংযোগ আছে যে, ঠিক কোনটিতে গুরুত্ব দিতে হবে তা বেছে নেওয়া বেশ কঠিন। যদি কোনো দেশ বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি না করে, তাহলে তার দেশের ব্যাটারি শিল্পও সম্ভবত যথেষ্ট শক্তিশালী হবে না, যা সামরিক ড্রোন তৈরি করার জন্য প্রয়োজন।

চীনের টেকসই শক্তি প্রযুক্তি উৎপাদন তাকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট, সেমিকন্ডাক্টর এবং স্মার্টফোনের মতো অন্যান্য খাতেও এগিয়ে তুলছে। গবেষক কাইল চ্যান এই সমন্বিত শিল্পনীতিকে ‘জিগস পাজল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

কিন্তু এমন ক্ষেত্রগুলোতেও মূল পার্থক্য আসে কীভাবে ইলেকট্রোটেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতিতে সেটা কতটা যুক্ত করা হয়েছে তার ওপর। বিদ্যুতায়ন বাড়ানো অর্থনৈতিক কার্যক্ষমতা এবং সুযোগ বাড়ায়। পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা বাড়িয়ে সামাজিক সুফল দেয়। উদাহরণস্বরূপ, চীনা সৌর প্যানেলের প্রধান আমদানিকারক দক্ষিণ আফ্রিকা ব্ল্যাকআউট এড়াচ্ছে এবং জীবনরক্ষাকারী যন্ত্রপাতি চালু রাখছে।

কেন ‘পেট্রোস্টেট’ শব্দটি এতটা পরিষ্কার, কিন্তু নতুন ‘ইলেকট্রোস্টেট’-এর ক্ষেত্রে তা নয়? কারণ পেট্রোস্টেট বোঝায় এমন একটি দেশ যেটির অর্থনীতি মূলত তেল ও গ্যাস রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। ভোক্তা পেট্রোস্টেট হওয়ার সুবিধা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেকদিন ধরে স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, ১৯১২ সালে উইনস্টন চার্চিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে কয়লার বদলে তেল ব্যবহারের নির্দেশ দেন, যা জার্মানদের বিপদে ফেলে দেয়। একইভাবে, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকা কেবল তেল রপ্তানি করেই নয়, নিজের দেশ চালানোর জন্যও তেল ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বিদের তুলনায় এগিয়ে ছিল।

ইলেকট্রোস্টেট হওয়া অবশ্যই একটি বড় সুযোগ। তবে নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই পরিষ্কারভাবে জানা উচিত তারা ঠিক কী অর্জন করতে চাচ্ছেন। চীনা জায়ান্টদের সঙ্গে সামান্য রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা করা হয়তো প্রস্ততকারী ইলেকট্রোস্টেট হওয়ার একটি কৌশলী উপায় মনে হতে পারে। কিন্তু নিজেদের অর্থনীতি বিদ্যুতায়িত করা এবং অনেক বড় অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দরজা খোজার চেষ্টা করা সম্ভবত সবার জন্য আরও ভালো পথ।

** কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত লেখা অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো। **

নোয়াহ গর্ডন

ফেলো, সাসটেইনেবিলিটি, ক্লাইমেট অ্যান্ড জিও পলিটিক্স এবং ইউরোপ প্রোগ্রাম

কার্নেগি এনডাওমেন্ট

দেবান মঙ্গলমূর্তি

সাবেক জেমস সি গাইথার জুনিয়র ফেলো সাসটেইনেবিলিটি, ক্লাইমেট অ্যান্ড জিও পলিটিক্স

সম্পর্কিত