আসছে চার দলের ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’, উদ্দেশ্য কী?

আসছে চার দলের ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’, উদ্দেশ্য কী?
এক হতে পারে চারটি রাজনৈতিক দল। ছবি: চরচা

গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী চারটি দল মিলে একটি নতুন জোটের ঘোষণা আসছে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বড় দুই দলের নির্বাচনী সমীকরণের বাইরে বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে চায় দলগুলো। নির্বাচন–পরবর্তী প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র সংস্কারের রাজনীতিতেও প্রধান শক্তি হয়ে ওঠা লক্ষ্য তাদের।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), রাষ্ট্র সংষ্কার আন্দোলন ও আপ বাংলাদেশের উদ্যোগে আগামীকাল বিকেল নাগাদ জোটটি আত্মপ্রকাশ করবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গড়ে ওঠা ও এর পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিভিন্ন এজেন্ডায় এ দলগুলোর মধ্যে নৈকট্য ছিল ও আছে। ফলে নতুন জোটের নাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য পাচ্ছে সংস্কার শব্দটি।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার শহীদ আবু সাঈদ কনভেনশন সেন্টারে জোট নিয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।

জোট গঠনের আলোচনায় অংশ নেওয়া একাধিক নেতা চরচাকে জানিয়েছেন, “গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট” নামটি তাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। জোটের আঙ্গিক ও নামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে আজ (বুধবার) সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সভায়।

এ বিষয়ে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপিত হাসনাত কাইয়ুম চরচাকে বলেন, ‘‘বিএনপি ও জামায়াত জোটের বাইরে একটা তৃতীয় ইন্ডিপেন্ডেন্ট জোট করতে চাই আমরা। ফরমেশন এবং নাম নিয়ে আমাদের আজ একটা বৈঠক হবে। আগামীকাল ৩টায় গণমাধ্যমে এর আত্মপ্রকাশের বিষয়ে অবহিত করা হবে বলে আশা প্রকাশ করছি।’’

‘সংস্কারের পক্ষে তৃতীয় শক্তি’

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এক সময়ের জোট সঙ্গী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী মুখোমুখী অবস্থানে। নির্বাচনের মাঠে থাকছে না গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত এবং পরে নির্বাহী আদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় তৃতীয় একটি শক্তি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংষ্কার আন্দোলন।

একটি জোট গঠনের প্রচেষ্টায় গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় দল এবং গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা চলে। দলগুলো জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনেও বিভিন্ন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ ছিল তারা। জোট গঠনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য ছিল ভোটের মাঠে স্বতন্ত্র বিকল্প হিসেবে নিজেদের হাজির করা।

জোট গঠনের বিষয়টি চলতি মাসের শুরুতেই চরচাকে নিশ্চিত করেছিলেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। জানিয়েছিলেন, ‘‘পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর যে জোট, তার বাইরে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী নতুন বন্দোবস্তের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আমরা একটি জোট গঠনের চেষ্টা করছি।’’

দীর্ঘ আলোচনার পর চার দল মিলে জোট গঠনের সিদ্ধান্তটি প্রকাশ্যে আনেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। গত ২৫ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘শিগগিরই দেশবাসী একটি নতুন অ্যালায়েন্স দেখতে পাবে, যা বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে থাকা দলগুলোর নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। তাদের উদ্দেশ্য হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন।’’

জোট গঠনের লক্ষ্যে চার দলের শেষ সভা অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল সকাল ১১টায়। সভা শেষে বিকেল ৩টায় জোটের ঘোষণা আসবে জানিয়ে আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ চরচাকে বলেন, ‘‘জোট গঠনের ক্ষেত্রে মেজর (মুখ্য) নজর রাখা হয়েছে জুলাই সংস্কার উদ্যোগকে। সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে এই জোটের একটা স্বতন্ত্র পরিচয় দাঁড় করানো আমাদের লক্ষ্য।’’

নতুন জোটকে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ ও চাঁদাবাজবিরোধী অ্যাখ্যা দিয়ে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। বিষয়টি নিয়ে চরচাকে হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘‘আমরা একদমই এককভাবে স্বাধীনভাবে নির্বাচন করার জন্য জোট গঠন করেছি।’’

নির্বাচন ঘিরে বড় দুটি দলের সঙ্গে কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা থাকবে কি না–এমন প্রশ্নের জবাবে হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘‘না এখন পর্যন্ত আমরা কোনো আসন সমঝোতার জন্য চিন্তা করছি না।’’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিপির এক যুগ্ম সদস্যসচিব চরচাকে বলেন, ‘‘জোট হচ্ছে জুলাই, সংস্কার ও গণভোটকে সামনে রেখে। কেউ যদি নির্বচান সামনে রেখে জোটের বাইরের কোনো দলের সঙ্গে সমঝোতা করতে চায়, ততটুকু ফ্লেক্সিবিলিট (নমনীয়তা) হয়তো থাকবে।’’

গণতন্ত্র মঞ্চ অনুপস্থিত

শুরুতে গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলোর সঙ্গে এ জোট গঠনের আলোচনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত দলগুলো থাকছে অনুপস্থিত। ২০২২ সালের ৮ আগস্ট এ জোট আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সমান্তরালে গঠিত হয়েছিল।

দীর্ঘদিনের যুগপৎ আন্দোলনের পর গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দলের শীর্ষ নেতাদের আসন সমঝোতার মাধ্যমে সংসদে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে বিএনপি। দলটির সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায়ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতাদের আসনগুলো ফাঁকা রাখা হয়েছে। আবার মধ্য ও মধ্যবামপন্থী দল হওয়ায় মঞ্চের দলগুলো এবি পার্টি, আপ বাংলাদেশর মতো ডানপন্থী দলের সঙ্গে জোটে আগ্রহী নয় বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ–রব) সাধারণ সম্পাদক শহীদউদ্দিন মাহমুদ স্বপন চরচাকে বলেন, ‘‘জোটের বিষয়ে আমাদের একাধিক আলাপ হয়েছিল। তবে আমরা মনে করি গণতন্ত্র মঞ্চকে সাথে নিয়েই আমাদের লড়াইটা সামনে এগিয়ে নিতে হবে।’’

গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হোসেন রুবেল চরচাকে বলেন, ‘‘আমরা মঞ্চেই আছি। প্রথম থেকে তো ওদের সঙ্গে একটা (জোটের) কথা চলছিলই। কিন্তু কিছু বিষয়ে আমরা প্রথম থেকেই ক্ল্যারিফিকেশন চেয়ে আসছিলাম। কারণ, আসলে রাজনৈতিকভাবে আপনি একটা জোটে যাবেন বা ইয়ে হবেন—পলিটিক্যালি যদি আপনি ক্লিয়ার না হন, তাহলে তো আসলে জোট করা সম্ভব হয় না। ওইটা তারা ক্লিয়ার করতে পারে নাই। ফলে এখন আমরা আমাদের যে পজিশন, সেই পজিশনেই আছি।”

জোট নাকি প্রক্সি?

জোট গঠনের খবর প্রকাশের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা গুঞ্জন শুরু হয়। এমনকি এনসিপির একাধিক সদস্য জোটটিকে জামায়াতে ইসলামীর ‘প্রক্সি’ বলে অভিহিত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেন। জামায়াতে ইসলামী ও কার্যত এর ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতাদের নিয়ে গঠিত এবি পার্টি এবং আপ বাংলাদেশ এ জোটে থাকায় এটি নিয়ে এমন সমালোচনা বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন এনসিপির একাধিক নেতা।

সম্প্রতি কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, আগামী নির্বাচন ঘিরে এনসিপির একাংশ জামায়াতের সঙ্গে বৃহত্তর বিএনপিবিরোধী সমঝোতার পক্ষে। আর বিএনপির সঙ্গে জোটের পক্ষে অবস্থান করছে ছাত্র উপদেষ্টাসহ আরেকাংশ।

জোটের বিষয়ে এ দুই মতের পক্ষে থাকা একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলেছে চরচা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, জোট বিষয়ক আলোচনায় অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে শীর্ষ পাঁচ নেতা (নাহিদ ইসলাম, আখতার হোসেন, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও তাসনীম জারা) অংশ নেন। আলোচনা শেষে দলের সাধারণ সভায় আপডেট জানানো হয়। সভায় বিএনপি অথবা জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়ার পক্ষে নেতাদের কেউ কেউ বক্তব্য রাখেন। তবে শীর্ষ পাঁচ নেতা জোটের বিষয়ে আপডেট জানানোর পরই অন্যান্য নেতারা কিছু জানতে পারেন।

শীর্ষ পাঁচ নেতার বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদিন শিশির চরচাকে বলেন, ‘‘সব সিদ্ধান্তই আমরা গণতান্ত্রিকভাবে নিয়ে থাকি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তাবায়নকে সামনে রেখেই জোটটি হবে।’’

এ বিষয়ে হাসনাত কাইয়ুমের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘‘এমন আলোচনা–সমালোচনা হয়ে থাকে। যেমন আমরা যতদিন গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে ছিলাম, ততদিন বলা হতো বিএনপির সঙ্গে আছেন।’’

সম্পর্কিত