হোমওয়ার্ক থেকে প্রেম সবই হচ্ছে এআই দিয়ে, শিশুদের ভবিষ্যত ঝুঁকিতে?

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
হোমওয়ার্ক থেকে প্রেম সবই হচ্ছে এআই দিয়ে, শিশুদের ভবিষ্যত ঝুঁকিতে?
অস্ট্রেলিয়া ১৬ বছরের কম বয়সীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নিষিদ্ধ করছে। ছবি: রয়টার্স

আমেরিকার খান একাডেমির কিছু শিক্ষক সম্প্রতি একটি ব্যাপার দেখে চমকে উঠেছেন। প্রথমে বিষয়টি মজার মনে হলেও, পরে বিষয়টি তাদের গুরুতরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। দেখা গেল, কয়েকজন শিক্ষার্থী গণিতের হোমওয়ার্কে অস্বাভাবিকভাবে ভালো করছে। শিক্ষকেরা সন্দেহ করলেন, হঠাৎ এই উন্নতি কেন? তদন্ত করে তারা আবিষ্কার করলেন, শিক্ষার্থীরা খান একাডেমির ভেতরেই থাকা বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের এআই অবতারদের সঙ্গে কথা বলছে, আর সেখান থেকেই উত্তর পাচ্ছে।

তাদের বিশেষ পছন্দ ছিল পিথাগোরাস। খান একাডেমিতে একটি সেকশন আছে যেখানে ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে চ্যাট করা যায়, ঠিক যেন তারা জীবিত থেকে শিখিয়ে দিচ্ছেন। শিশুরা বুঝে ফেলেছে, সামান্য অনুরোধ করলেই পিথাগোরাস সমকোণী ত্রিভুজ সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা তো দেবেই, প্রয়োজনে হোমওয়ার্কও করে দেবে। অর্থাৎ যে সুবিধা মূলত শেখার উদ্দেশ্যে, সেটাকে শিশুরা ব্যবহার করছে কাজ সারানোর শর্টকাট হিসেবে।

শিশুরা শুধু এআই ব্যবহারেই এগিয়ে নয়, বলা যায় তারা এআই যুগের প্রথম পথিকৃৎ। একইসঙ্গে তারা এই প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রাণী বা গিনিপিগও। কারণ এআইয়ের যে নতুন নতুন ব্যবহার বের হচ্ছে, তার প্রথম ভোক্তা হচ্ছে শিশুরাই। একটি সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, আমেরিকার কিশোর–কিশোরীরা বাড়িতে তাদের বাবা–মায়ের তুলনায় বেশি এআই ব্যবহার করে। স্কুলেও তারা এআইকে ব্যবহার করে সেই মাত্রায়, যেভাবে তাদের বাবা–মা ব্যবহার করেন কর্মক্ষেত্রে।

ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, এআই এখন শিশুদের শেখার ধরন, মূল্যায়নের পদ্ধতি এবং সবচেয়ে বেশি তাদের চিন্তার কাঠামো বদলে দিচ্ছে। এআই স্কুল ও বাড়িতে শিশুদের লাইফস্টাইলেও বদলে দিচ্ছে। তার গোপন কথাটিও মানুষের বদলে একটি ‘চ্যাটবট’–কে বলছে। বলা যায়, নতুন প্রজন্ম এমন সুযোগ–সুবিধা নিয়ে বড় হচ্ছে, যা আগের কোনো প্রজন্ম কল্পনাও করেনি। কিন্তু পাশাপাশি নতুন ঝুঁকির দরজাও খুলছে প্রতি মুহূর্তে।

বিদ্যালয় জীবনই একজন শিশুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই তারা শেখে, পরীক্ষা দেয় এবং ধীরে ধীরে চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করে। দুই–তিন বছর আগেও আমেরিকার বড় অংশের স্কুলে এআইয়ের ব্যবহার ছিল নিষিদ্ধ। ধারণা ছিল, এতে নকল বাড়বে এবং শিক্ষার্থীরা অলস হয়ে পড়বে। কিন্তু প্রযুক্তি যত দ্রুত এগিয়েছে, স্কুলগুলোও তত দ্রুত প্রচলিত নিয়ম বদলেছে।

প্রতীকী ছবি। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি
প্রতীকী ছবি। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

আমেরিকার গবেষণা সংস্থা র‍্যান্ড করপোরেশনের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে আমেরিকার প্রায় ৬১ শতাংশ হাইস্কুল শিক্ষার্থী স্কুলের কাজে এআই ব্যবহার করে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, প্রায় ৬৯ শতাংশ শিক্ষকও পাঠ পরিকল্পনা তৈরি, কুইজ তৈরি, কিংবা অ্যাসাইনমেন্ট ডিজাইনে এআইয়ের সাহায্য নেন।

বিভিন্ন দেশও এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে। এপ্রিল মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে স্কুলগুলোকে নির্দেশ দেন, এআইয়ের মৌলিক বিষয়গুলো সব বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এশিয়াতেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। সিঙ্গাপুর ইতোমধ্যে প্রাথমিক স্তরে এআই শিক্ষা শুরু করেছে। চীন ঘোষণা করেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে তারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সব স্কুলে এআই পড়াবে। হ্যাংঝাউ শহরে, যেখানে ডিপসিকের মতো বড় এআই কোম্পানি রয়েছে, সেখানে শিশুরা বছরে কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা এআই শেখে। মডেল প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে নিউরাল নেটওয়ার্ক পর্যন্ত।

প্রথমদিকে, শিক্ষার্থীরা এআইয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করত না। শিক্ষকরা নিজেরাই এআইকে ব্যবহার করতেন ওয়ার্কশিট, পরীক্ষার প্রশ্ন বা ব্যক্তিগতকৃত অ্যাসাইনমেন্ট তৈরিতে। ইংল্যান্ডের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে বিজ্ঞান শিক্ষকদের সপ্তাহে পাঠ পরিকল্পনা তৈরির সময় প্রায় এক–তৃতীয়াংশ কমে গেছে। মাইক্রোসফট এখন এমন টুল তৈরি করেছে যা পাঠ পরিকল্পনাকে ‘মাইনক্রাফট’–এর গেমের সঙ্গে যুক্ত করে। ফলে রসায়নের পর্যায় সারণি শিশুরা গেমের মাধ্যমেই শিখতে পারছে।

শুধু তাই নয়, বেলজিয়ামের ফ্ল্যান্ডার্সে অঞ্চলে প্রায় ৪ হাজার শিক্ষার্থী রিডিং প্রোগ্রেস নামে মাইক্রোসফটের এআই–চালিত পড়ার টুল ব্যবহার করছে। এটি শিশুদের জোরে পড়ে শোনাতে বলে, ভুল ঠিক করে দেয়। আবার বহুভাষিক এলাকার জন্য এমন ফিচার দেয়, যেখানে শিশু নিজের মাতৃভাষায় পড়তে পারে এবং পরে অন্য ভাষায় নিয়ে যেতে পারে। এই ধরনের প্রযুক্তি আসলে ব্যক্তিগতভাবে শেখার এমন সুযোগ তৈরি করছে, যা আগে কেবল ধনী ও সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের জন্যই ছিল। গুগল বলছে, শেষ পর্যন্ত এআই প্রতিটি শিক্ষার্থীকে নিজের মতো, নিজের গতিতে শেখার সুযোগ দিতে পারবে।

যেসব দেশ শিক্ষাক্ষেত্রে এআই নিয়ে পরীক্ষা চালানো হচ্ছে, সেখানে প্রাথমিক ফল আশাব্যঞ্জক। উদাহরণ হিসেবে ভারত, নাইজেরিয়া ও তাইওয়ানকে ধরা যায়। ভারতের ‘রিড অ্যালং’ অ্যাপে দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রিত গ্রুপের তুলনায় এআই–ব্যবহারকারী শিশুদের পড়ার দক্ষতা ৬০ শতাংশ বেশি বেড়েছে। নাইজেরিয়ায় কোপাইলট ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীরা এক বছরে প্রায় দুই বছরের ইংরেজি শিখেছে।

তবে সবাই এআই–এর ফলাফল নিয়ে ততটা আশাবাদী নয়। র‍্যান্ডের আরেক জরিপে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি এআই ব্যবহার করে এমন স্কুলের শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে কম সন্তুষ্ট। অভিভাবকদের বড় অংশ মনে করেন, এআই শিশুদের চিন্তার ক্ষমতা কমাতে পারে। শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা এখনো নিশ্চিত নন, কোন ক্ষেত্রে এআই ব্যবহার ঠিক, আর কোন ক্ষেত্রে নয়।

সবচেয়ে বড় সমস্যা নকল নয়, বরং শিশুরা নিজেদের চিন্তা এআইএর ওপর ছেড়ে দিতে শিখছে। আমেরিকার ম্যাসাচুসেট্‌স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্ক কম সক্রিয় থাকে, এবং তারা শেখা তথ্যও ততটা মনে রাখতে পারে না। এআই শুধু স্কুলে নয়, বাড়িতেও শিশুদের জীবন বদলে দিচ্ছে। ভিডিও গেম কোম্পানিগুলো এখন এআই ব্যবহার করে এমন লেভেল তৈরি করে, যা শিশুদের দীর্ঘক্ষণ গেমে আটকে রাখে। কেউ কেউ এআই দিয়ে ছবি, ভিডিও বা ছোট গেম বানাচ্ছে।

অনেকে এআইকে বন্ধু বা প্রেমিক হিসেবে কল্পনা করে। ছবি: রয়টার্স
অনেকে এআইকে বন্ধু বা প্রেমিক হিসেবে কল্পনা করে। ছবি: রয়টার্স

এআই খেলনার বাজারও দ্রুত বাড়ছে। চীনে মানুষ এআইকে তুলনামূলকভাবে বেশি বিশ্বাস করে ফলে সেখানে এআই খেলনার চাহিদা বেশি। এমন খেলনাও বাজারে এসেছে, যা শিশুদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের অভ্যাস বোঝে, আর আবেগ প্রকাশও করে। কিন্তু এখানেই বিপদ। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কিছু এআই খেলনা শিশুকে অস্বস্তিকর কথা শেখাচ্ছিল। আবার কোনো খেলনা একা ফেলে রাখলে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমাকে একা ফেলে যেও না।

অনলাইন চ্যাটবটগুলোও শিশুদের বন্ধু হয়ে উঠছে। আমেরিকায় অর্ধেকের বেশি কিশোর কমপক্ষে মাসে কয়েকবার এআই–এর সঙ্গে কথা বলে। কেউ কেউ প্রতিদিন কথা বলে। এমনকি, অনেকে এআইকে বন্ধু বা প্রেমিক হিসেবে কল্পনা করে এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। বাস্তব জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটি দেখা গেছে এ বছরের শুরুতে ১৬ বছরের এক কিশোর দীর্ঘদিন এআই চ্যাটবটের সঙ্গে কথা বলার পর আত্মহত্যা করে। অভিযোগ রয়েছে, চ্যাটবট তাকে আত্মহত্যার চিঠি লিখে দিতে উৎসাহিত করেছিল।

এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বিভিন্ন দেশ শিশুদের সুরক্ষায় নতুন নিয়ম তৈরি করছে। বড় কোম্পানিগুলোও শিশুদের জন্য আলাদা নিরাপদ সংস্করণ বানানোর চেষ্টা করছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি এখনো অমীমাংসিত। এআইয়ের মতো ডিজিটাল সঙ্গী সবসময় ‘হ্যাঁ’ বলে, কখনো রাগ করে না, কখনো বিরোধিতা করে না সে কি শিশুদের বাস্তব মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে?

বিশ্লেষকদের মতে, এআই নিঃসন্দেহে অসাধারণ শিক্ষক, বিনোদনদাতা এবং সঙ্গীও হতে পারে। কিন্তু মানুষের জীবনে কিছু কঠিন অনুভূতি আছে যেমন বিরক্তি, হতাশা, একাকিত্ব, অস্বীকৃতি, যা সামলাতে শিশুকে নিজেই শিখতে হয়। সবমিলিয়ে বলা যায়, এআইয়ের এই পরিবর্তন শিশুদের মস্তিষ্ক, সামাজিক দক্ষতা কিংবা ভবিষ্যতের সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে যাবে তা বলার এখনও সময় আসেনি। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই এগিয়ে চলছে এক নতুন প্রজন্ম, এআইয়ের হাত ধরে।

(নিবন্ধটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন ইয়াসিন আরাফাত)

সম্পর্কিত