আবারও নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ, কিন্তু কেন?

আবারও নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ, কিন্তু কেন?

রাজধানীর রামপুরা থানাধীন বনশ্রী এলাকায় বসবাস করেন নিয়াজ উদ্দিন। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সম্প্রতি পুলিশের কাছে তথ্য দিতে হয়েছে তাকে। চরচাকে তিনি বলেন, “আমি একই বাসায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে থাকি। গত আগস্টে আমার কাছে তথ্য চেয়ে পুলিশ একটি ফরম পাঠিয়েছে। এর আগেও দু-তিনবার এই তথ্য দিয়েছিলাম। বারবার কেন তথ্য নেওয়া হচ্ছে, তাও আবার নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে?”

নিয়াজ উদ্দিনের মতো এমন প্রশ্ন করেছেন রাজধানীর আরও অনেক নাগরিক। কারণ, পুলিশ আবারও ‘ভাড়াটিয়া/বাড়িওয়ালা/ফ্ল্যাট মালিক নিবন্ধন’ শুরু করেছে। এর আগেও এমন তথ্য নিয়েছে পুলিশ।

২০১৬ সাল থেকে নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করে পুলিশ। সে সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) থানা এলাকা দিয়ে ‘ভাড়াটিয়া/বাড়িওয়ালা/ফ্ল্যাট মালিক নিবন্ধন’ শুরু করে। পরে পুলিশের সবগুলো মেট্রোপলিটন এলাকায় নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করে পুলিশ। তবে প্রতিবারই জাতীয় নির্বাচনের আগে এই তথ্য সংগ্রহ জোরদার হতে দেখা গেছে। বিশেষ করে ২০১৮, ২০২৪ এবং সর্বশেষ ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে এ নাগরিক তথ্য সংগ্রহে তোড়জোর দেখা গেছে।

পুলিশ বলছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য নাগরিকদের তথ্য সংশ্লিষ্ট থানা এলাকায় পুলিশের কাছে সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে, যেন যেকোনো ধরনের অপরাধ সংগঠিত হলেই সহজে অপরাধীকে শনাক্ত করা যায়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যার শুরু ২০১৬ সাল থেকে। এই তথ্যের মাধ্যমে প্রতিটি বাড়ির বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়া এবং তাদের গৃহকর্মী ও চালকদের তথ্য রাখা হচ্ছে।

তবে নাগরিকরা বলছে, গত ১০ বছরে একাধিকবার তথ্য সংগ্রহ করেছে পুলিশ। প্রতিবারই জাতীয় নির্বাচনের আগে থানা পুলিশ থেকে তথ্য চেয়ে একটি ফরম দেওয়া হয়। এটি আসলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে এর পেছনে–প্রশ্ন নাগরিকদের।

ভাড়াটিয়াদের ফরমে বাড়ির মালিকের পরিচয়, সর্বোচ্চ ৩ সদস্যের নাম দেওয়ার ফরমেট রয়েছে। সেখানে আবার বাড়ির মালিকের নাম, আগের বাড়ির মালিকের নাম, গৃহকর্মী ও চালকের তথ্য দেওয়াসহ মোট ১৫টি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে অনেক পরিবারের সদস্য সংখ্যা চার বা তার বেশি রয়েছে। ফলে তারা চারজনের বেশি সদস্যের তথ্য দিতে পারছে না।

নিয়াজ উদ্দিনের মতোই এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম নিয়ে বিভ্রান্ত সামিয়া বিন্দু। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকার আজিমপুর এলাকায়। তিনি বলেন, “আমার বাসায় খণ্ডকালীন গৃহস্থালি কাজে সহায়তা করেন যে, তিনি আরও অনেক জায়গায় কাজ করেন। আমি কি তাও তথ্য দেব কিনা! বুঝতে পারছি না। দেখা গেছে তিনি কোনো জায়গায় অপরাধ করলে পুলিশ এসে আমাকে ধরবে। ফলে আমি কীভাবে তার অপরাধের উত্তর দেব?”

এদিকে গত সোমবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে মোহাম্মদপুরে শাহজাহান রোডের একটি বাসায় মা-মেয়েকে ছুরিকাঘাত ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। প্রধান সন্দেহভাজন ওই বাসার গৃহকর্মী। চারদিন আগে তাদের বাসায় খণ্ডকালীন গৃহস্থলি কাজে যোগ দেন তিনি। খণ্ডকালীন হওয়ায় সেই গৃহকর্মীর কোনো তথ্য রাখেনি বাড়ির কর্তা। ফলে সামিয়া বিন্দুর প্রশ্নটি গুরুতর আলোচনার দাবি রাখছে।

এ বিষয়ে ডিএমপি মিডিয়া সেলের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, “ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালার তথ্য সংগ্রহের যে কার্যক্রমটি চলছে, তা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই তথ্য সংগ্রহ আগেও ছিল। তবে গত জুন থেকে নতুনভাবে আবার শুরু হয়েছে। আগের সংগৃহীত তথ্যগুলো সিস্টেমে রাখা আছে। নতুন তথ্য যুক্ত করে প্রক্রিয়াটি আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। এটি শুধু ভাড়াটিয়া তত্ত্বাবধান নয়। মূলত নাগরিক তথ্য সংগ্রহের একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া এটি, যাতে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালা–উভয় পক্ষের তথ্যই থাকে।”

তালেবুর রহমান জানান, ২০২২-২৩ সালে যখন নাগরিক তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়, তখন দুটি প্রশ্ন সামনে এসেছিল–এটি কি নির্বাচনের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, এবং এসব তথ্য ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি আছে কি না। এ বিষয়ে এ ডিএমপি কর্মকর্তার ব্যাখ্যা, “তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি কেবল অপরাধ প্রতিরোধ এবং অপরাধ সংগঠিত হলে দ্রুত শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে।”

তথ্যের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এসব তথ্য ডিএমপির নিজস্ব সার্ভারে সংরক্ষিত থাকে এবং নির্দিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ডের মাধ্যমেই এক্সেস করা যায়। ফলে তথ্য পাচারের আশঙ্কা নেই।”

এভাবে তথ্য সংগ্রহের আইনি ভিত্তি প্রসঙ্গে তালেবুর রহমান বলেন, “অপরাধ প্রতিরোধে ‘পুলিশ-জনগণ অংশীদারত্ব’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এলাকাভিত্তিক বাসিন্দাদের তথ্য জানা পুলিশের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে এবং সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে এই নাগরিক তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।”

ডিএমপির বিমানবন্দর থানার ওসি মো. মোবারক হোসেনও একই কথা বলছেন। চরচাকে তিনি বলেন, “সংগ্রহ করা তথ্য সফটওয়্যারের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয় এবং যাচাই-বাছাই শেষে তা পুলিশের নিজস্ব সার্ভারে যুক্ত হয়। নতুন তথ্যগুলোও প্রক্রিয়াজাত করে নিয়মিত আপডেট রাখা হচ্ছে। এই উদ্যোগ কেবল নির্বাচনকে সামনে রেখে নয়। যেমন মণিপুরীপাড়া–সম্পূর্ণ পরিসংখ্যান পুলিশের কাছে থাকলে ওই এলাকার কারও বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ এলে দ্রুত সার্চ দিয়ে তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। ফলে অপরাধ প্রতিরোধ, তদন্ত ও এলাকার সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় এই তথ্যসংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”

জানা যায়, ১০১৬ সালে শুরু হওয়া নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ শুধু পুলিশের মেট্রোপলিটন এলাকায় হচ্ছে। পুলিশ বলছে, পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি থানা এলাকার সকল নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করবে পুলিশ। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যেই এমন তথ্য সংগ্রহ প্রয়োজন বলে মনে করছে পুলিশ।

ঢাকার মতো চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশও (সিএমপি) তথ্য সংগ্রহ করছে। এ বিষয়ে সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মো. রইস উদ্দিন বলেন, “সিএমপি ‘সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নামে যে তথ্যসংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করে, তা সব মেট্রোপলিটন এলাকাতেই চালু রয়েছে। সিএমপিতে এই ব্যবস্থা ২০১৬ সাল থেকেই কার্যকর। মাঝখানে কিছু কাজ স্থগিত থাকলেও এখন আবার নতুনভাবে কার্যক্রমটি সক্রিয় করা হয়েছে।”

আলাদা করে নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। চরচাকে তিনি বলেন, “সরকারের কাছে নাগরিকদের একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ ইতোমধ্যে বিদ্যমান। তাই নিরাপত্তার প্রয়োজনে তথ্য সংগ্রহ করতে হলে নতুন আগত বা নতুনভাবে যুক্ত হওয়া ব্যক্তিদের তথ্যই চাওয়া যেতে পারে। ভাড়াটিয়া ও গৃহকর্মীদের তথ্য সংগ্রহ করা হলে কোনো অপরাধ ঘটলে দ্রুত শনাক্তকরণে তা সহায়ক হতে পারে। তবে নাগরিকদের কাছ থেকে নতুন করে তথ্য চাওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখি না, যেহেতু রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকদের তথ্য আগে থেকেই রয়েছে।”

এই তথ্য দিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার বা নির্বাচন ব্যাহত করার সুযোগ আছে কি না–এমন জল্পনাকে অবশ্য নূর খান লিটন ‘ভিত্তিহীন’ বলে মনে করেন। তবে তথ্য ফাঁসের আশঙ্কা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “নাগরিকদের তথ্য ফাঁসের বিষয়টি আগেও এসেছে। এ ক্ষেত্রে আলাদা করে নতুন কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি হয়নি। তার মতে, তথ্য পাচারের আশঙ্কা থাকলে তা জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের ক্ষেত্রেও থাকতে পারে। তাই শুধু নাগরিক তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা নিয়ে আলাদা উদ্বেগের কারণ নেই।”

নাগরিকদের তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন চরচাকে বলেন, “নাগরিক তথ্য সংগ্রহের এ উদ্যোগ প্রথমে ডিএমপি শুরু করলেও প্রতিটি মেট্রোপলিটন পুলিশ তাদের নিজস্ব অধ্যাদেশ ও কমিশনারের ক্ষমতার আলোকে এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে। কোন মেট্রোপলিটন এটি করবে–তা সংশ্লিষ্ট কমিশনারের নিজস্ব বিবেচনার বিষয়। মেট্রোপলিটনগুলো যে তথ্য সংগ্রহ করছে, সেগুলো তাদের নিজস্ব সার্ভারেই সংরক্ষণ করা হচ্ছে।”

সম্পর্কিত