৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

আবারও সোভিয়েত ভেটো, রণাঙ্গনে কোনঠাসা পাকিস্তান

আবারও সোভিয়েত ভেটো, রণাঙ্গনে কোনঠাসা পাকিস্তান
যৌথ বাহিনী প্রথমে দখল করে যশোর বিমানবন্দর। তারপর সেনানিবাস। ছবি: সংগৃহীত

ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতির পরদিন, ডিসেম্বরের ৭ তারিখ বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বেতার ভাষণে বলেন, ঢাকা মুক্ত হতে আর বেশি দেরি নেই। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে মেনে নেওয়ার জন্য দুনিয়ার সব দেশের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য। তিনি পৃথিবীর শান্তিকামী দেশগুলোর কাছে আবার বঙ্গবন্ধুর মক্তির জন্য সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানান।

ভারতের স্বীকৃতির পর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকে স্থির হয়, ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হবে। বাংলাদেশ সরকার হবে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ ভাসানী) প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের নিরপরাধ জনসাধারণের ওপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্যাতন এবং ইয়াহিয়া প্রশাসনকে সমর্থন করার চীনের সরকারি নীতিতে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, যে চীন অত্যাচারকে ঘৃণা করে, তারাই একেবারে চুপ করে আছে, এটি বড়ই দুঃখের বিষয়।

এদিন, পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের ভাষণে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ বাইরের কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার ডাক দেন। বিশেষজ্ঞ কূটনীতিকদের মতে, তিনি বাইরের শক্তি বলতে চীনকেই বুঝিয়েছেন।

এদিকে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে এক জরুরি আলোচনা শুরু হয়। এবার এই প্রস্তাব উত্থাপন করে আর্জেন্টিনা। প্রস্তাবে দুই দেশকে অস্ত্র সংবরণ করে সীমান্তের দুদিকে তাদের সেনা সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়ার কথা বলা হয়।

নিরাপত্তা পরিষদেও অনুরূপ প্রস্তাব তোলা হয়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করে সে প্রস্তাব বাতিল করে দিলে প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে পাঠানো হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন-সমর্থিত ভারতের প্রস্তাবে বলা হয়, বিষয়টি সাধারণ পরিষদের বিচার্য হতে পারে কি না, সেটা পরিষদের কার্যপরিচালনা কমিটিতে বিচার করে দেখতে বলা হোক।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ যুদ্ধের জন্য মুখ্যত ভারতকে দায়ী করে বক্তব্য দেন। এরপর বাংলাদেশ সময় রাত ১টা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি থাকে। আবার অধিবেশন শুরু হলে বর্তমান বিবোধের মানবিক দিক সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট একটি বিবৃতি পেশ করেন।

এরপর ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এটি মানার বাধ্যবাধকতা ছিল না। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ১০৪টি, বিপক্ষে ১১টি। ১০টি রাষ্ট্র ভোট দেয়নি। কয়েকটি দেশ অনুপস্থিত থাকে। সাধারণ পরিষদের সদস্যসংখ্যা ১৩১।

ভারতের আক্রমণের প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে চীন আরেকটি প্রস্তাব আনে। সোভিয়েত ইউনিয়নও একটি প্রস্তাব আনে। কোনোটিই ভোটে দেওয়া হয়নি।

এর আগে ভারত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে এই মর্মে দাবি জানায়, বাংলাদেশকে অবশ্যই রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণ নিয়ে আনা প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য না হলে তা বলবৎ করা যাবে না।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত যশোরের এদিন পতন হয়। ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরাও মুক্ত হয়। পতন হয় সিলেটেরও। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে রাজধানী ঢাকার দিকে।

যৌথবাহিনী প্রথমে দখল করে যশোর বিমানবন্দর। তারপর সেনানিবাস। বয়রা ও বেনাপোল থেকেও যৌথবাহিনী যশোরের দিকে এগোয়। ততক্ষণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা যশোর থেকে পালিয়েছে। শ দুয়েক সেনা ও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা আত্মসমর্পণ করে।

ঝিনাইদহ ছেড়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায় ঢাকার দিকে, সাতক্ষীরার সৈন্যরা পালায় খুলনার দিকে।

সিলেটের পতন হয় যশোরের কিছুক্ষণ পর। যৌথ বাহিনী প্রথমে শালুটিকর বিমানবন্দর দখল করে। সেখানে যৌথ বাহিনীর ছত্রীসেনা অবতরণ করে। এরপর চারদিক থেকে শহরের দিকে অগ্রসর হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকিস্তান সেনারা পিছু হটে মেঘনা নদীর ওপারে ভৈরব বাজারে অবস্থান নেয়।

এদিন আরও মুক্ত হয় চুয়াডাঙ্গা, শেরপুর, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, নেত্রকোনার কেন্দুয়া ও কলমাকান্দা, বাগেরহাটের মোংলা, বরিশালের বাকেরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের দিরাই।

ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় জানান, তিনি কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন। এর প্রধানমন্ত্রী হবেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি এবং দক্ষিণপন্থি জোটের প্রধান নুরুল আমিন। সহকারী প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো।

তথ্যসূত্র—

  • আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস
  • মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ
  • একাত্তরের দিনপঞ্জি, সাজ্জাদ শরিফ, রাশেদুর রহমান

সম্পর্কিত