১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ফজলে রাব্বি

১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যুদ্ধে পরাজয় মেনে না নেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি তার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার জন্য দায়ী করেন এবং এই ‘লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ’ মেনে নিতে অস্বীকার করেন।
সংক্ষিপ্ত অধিবেশনে পোল্যান্ডের প্রস্তাবে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলা হয়। একই সঙ্গে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আদেশ দিতেও বলা হয়।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, “আজ আমার দেশের ইতিহাসে এক গুরুতর মুহূর্তে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি এবং আমি পরিষদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি তারা যেন আমার সঙ্গে থাকেন এবং সত্য শোনেন, সেই তিক্ত সত্য।...আমি পাকিস্তানের এই লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের অংশীদার হব না। আপনারা আপনাদের নিরাপত্তা পরিষদ রাখুন। আমি চললাম।”
ক্ষোভে উন্মত্ত ভুট্টো একপর্যায়ে তার সামনে থাকা খসড়া প্রস্তাবের কাগজপত্রগুলি ছিঁড়ে ফেলেন এবং নিরাপত্তা পরিষদের এজেন্ডাকে ‘শেমফুল ক্যাপিচুলেশন (লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ)’ বলে আখ্যায়িত করে তার প্রতিনিধি দল নিয়ে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দেশে ফিরে গিয়ে তিনি ‘লড়াই করবেন’।
কিন্তু রণাঙ্গনের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য শেষবারের মতো নির্দেশ দেন। এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হারটি ডি স্পিভাকের মাধ্যমে দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যুদ্ধবিরতির আরজি পাঠান।
নিয়াজির বার্তায় সাক্ষী হিসেবে সই করেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। দিল্লির যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস সেটি ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ’র কাছে পাঠায়। জেনারেল মানেকশ সঙ্গে সঙ্গে বিকেল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকায় বিমান হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে তার উত্তরে মানেকশ যুদ্ধবিরতির বদলে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তিনি জানান, বিমানবাহিনীর আক্রমণ বন্ধ থাকলেও ভারতীয় স্থলবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অভিযান চলবে। সকাল ৯টার মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে আবার বিমান হামলা শুরু হবে। তারা আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনের পূর্ণ সুযোগ প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
ওদিকে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই দিন পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের একাংশ বঙ্গোপসাগরে আসে। বহরে ছিল আক্রমণক্ষম হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ ট্রিপল ই-সহ কয়েকটি রণতরি। ট্রিপল ই-তে ছিল ২৩টি হেলিকপ্টার, অন্য জাহাজে ছিল ডেস্ট্রয়ার এবং উপকূলে অবতরণের বঙ্গোপসাগরে আসে।
সপ্তম নৌবহরের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে এই দিন ২০টি সোভিয়েত রণতরি ভারত মহাসাগরে এসে জড়ো হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্ররা বলেন, ৯ ডিসেম্বর সুসিমা প্রণালির ভেতর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী একটি সোভিয়েত ফ্রিগেট এবং পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণক্ষম ডুবোজাহাজও বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা দিয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে সোভিয়েত রণতরি ভারত মহাসাগরে অবস্থান নিলে সপ্তম নৌবহর তার দিক পরিবর্তন করে। এর মধ্য দিয়েই মূলত আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং পরাশক্তিগুলোর মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে ভারত এবং পাকিস্তানের পক্ষে বিপক্ষের তৎপরতার যবনিকা পড়ে।
তথ্যসূত্র:
United Nations Security Council (UNSC) Records: Proceedings of the 1621st and 1622nd meetings concerning the India-Pakistan situation, December 15, 1971.
দ্যা ডন সংবাদপত্র আর্কাইভ: From The Past Pages Of Dawn: 1971: Fifty Years Ago: Bhutto walks out of UN (ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১ সংখ্যা)।
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত
একাত্তরের দিনপঞ্জি, সাজ্জাদ শরিফ ও রাশেদুর রহমান

১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যুদ্ধে পরাজয় মেনে না নেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি তার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার জন্য দায়ী করেন এবং এই ‘লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ’ মেনে নিতে অস্বীকার করেন।
সংক্ষিপ্ত অধিবেশনে পোল্যান্ডের প্রস্তাবে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলা হয়। একই সঙ্গে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আদেশ দিতেও বলা হয়।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, “আজ আমার দেশের ইতিহাসে এক গুরুতর মুহূর্তে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি এবং আমি পরিষদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি তারা যেন আমার সঙ্গে থাকেন এবং সত্য শোনেন, সেই তিক্ত সত্য।...আমি পাকিস্তানের এই লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের অংশীদার হব না। আপনারা আপনাদের নিরাপত্তা পরিষদ রাখুন। আমি চললাম।”
ক্ষোভে উন্মত্ত ভুট্টো একপর্যায়ে তার সামনে থাকা খসড়া প্রস্তাবের কাগজপত্রগুলি ছিঁড়ে ফেলেন এবং নিরাপত্তা পরিষদের এজেন্ডাকে ‘শেমফুল ক্যাপিচুলেশন (লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ)’ বলে আখ্যায়িত করে তার প্রতিনিধি দল নিয়ে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দেশে ফিরে গিয়ে তিনি ‘লড়াই করবেন’।
কিন্তু রণাঙ্গনের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য শেষবারের মতো নির্দেশ দেন। এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হারটি ডি স্পিভাকের মাধ্যমে দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যুদ্ধবিরতির আরজি পাঠান।
নিয়াজির বার্তায় সাক্ষী হিসেবে সই করেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। দিল্লির যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস সেটি ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ’র কাছে পাঠায়। জেনারেল মানেকশ সঙ্গে সঙ্গে বিকেল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকায় বিমান হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে তার উত্তরে মানেকশ যুদ্ধবিরতির বদলে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তিনি জানান, বিমানবাহিনীর আক্রমণ বন্ধ থাকলেও ভারতীয় স্থলবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অভিযান চলবে। সকাল ৯টার মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে আবার বিমান হামলা শুরু হবে। তারা আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনের পূর্ণ সুযোগ প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
ওদিকে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই দিন পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের একাংশ বঙ্গোপসাগরে আসে। বহরে ছিল আক্রমণক্ষম হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ ট্রিপল ই-সহ কয়েকটি রণতরি। ট্রিপল ই-তে ছিল ২৩টি হেলিকপ্টার, অন্য জাহাজে ছিল ডেস্ট্রয়ার এবং উপকূলে অবতরণের বঙ্গোপসাগরে আসে।
সপ্তম নৌবহরের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে এই দিন ২০টি সোভিয়েত রণতরি ভারত মহাসাগরে এসে জড়ো হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্ররা বলেন, ৯ ডিসেম্বর সুসিমা প্রণালির ভেতর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী একটি সোভিয়েত ফ্রিগেট এবং পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণক্ষম ডুবোজাহাজও বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা দিয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে সোভিয়েত রণতরি ভারত মহাসাগরে অবস্থান নিলে সপ্তম নৌবহর তার দিক পরিবর্তন করে। এর মধ্য দিয়েই মূলত আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং পরাশক্তিগুলোর মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে ভারত এবং পাকিস্তানের পক্ষে বিপক্ষের তৎপরতার যবনিকা পড়ে।
তথ্যসূত্র:
United Nations Security Council (UNSC) Records: Proceedings of the 1621st and 1622nd meetings concerning the India-Pakistan situation, December 15, 1971.
দ্যা ডন সংবাদপত্র আর্কাইভ: From The Past Pages Of Dawn: 1971: Fifty Years Ago: Bhutto walks out of UN (ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১ সংখ্যা)।
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত
একাত্তরের দিনপঞ্জি, সাজ্জাদ শরিফ ও রাশেদুর রহমান