ইউরোফাইটার আসছে, জে-১০সিইও কী আসবে?

চরচা প্রতিবেদক
চরচা প্রতিবেদক
ইউরোফাইটার আসছে, জে-১০সিইও কী আসবে?

অত্যাধুনিক মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান ইউরোফাইটার টাইফুন কেনার জন্য ইতালির প্রতিষ্ঠান লিওনার্দো এসপিএর সঙ্গে একটি সম্মতিপত্র সই করেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। খুব শিগগিরই হয়তো ৪.৫ প্রজন্মের এই অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সংযুক্ত হতে যাচ্ছে। সংখ্যায় কতটি ইউরোফাইটার টাইফুন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যুক্ত হতে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু জানা না গেলেও আকাশ প্রতিরক্ষা বিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য এভিয়নিস্টের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ইতালির লিওনার্দো এসপিএ ১০ থেকে ১৬টি ইউরোফাইটার সরবরাহের দায়িত্ব পাচ্ছে।

২০০০ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে চতুর্থ প্রজন্মের ৮টি মিগ-২৯ মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান সংযুক্ত হয়েছিল। এই ৮টি মিগ-২৯ বাদ দিলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী আকাশ প্রতিরক্ষায় পুরোপুরি নির্ভরশীল চীনের তৈরি এফ-৭ বিজি যুদ্ধবিমানের ওপর। তৃতীয় প্রজন্মের এই এফ-৭বিজির একাধিক সংস্করণ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে থাকলেও আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার হিসেবে এই এফ-৭বিজি যুদ্ধবিমান মান্ধাতা আমলেরই। সে হিসেবে ২৫ বছর কোনো মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে সংযুক্ত হয়নি। ওয়ারপাওয়ার ডটকমের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে এই মুহূর্তে ২১২টি আকাশযান আছে, যার মধ্যে ৪৪টি যুদ্ধবিমান।

জে–১০সিই মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কী কিনবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। ছবি: রয়টার্স
জে–১০সিই মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কী কিনবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। ছবি: রয়টার্স

কিছুদিন আগেই চীনের তৈরি ২০টি জে-১০সিই মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার কথা উঠেছিল। গত মাসে বিমানবাহিনী প্রধানের দুবাই এয়ার শো সফরকালে চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক-৩ মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে একটা গুঞ্জনও চাউর হয়েছিল। পাকিস্তান বিমানবাহিনী জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান বিক্রির ব্যাপারে একটি ‘বন্ধুপ্রতীম দেশে’র সঙ্গে চুক্তির কথা উল্লেখ করেছিল। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় গুঞ্জন ছিল এই নাম উল্লেখ না করা দেশটি বাংলাদেশ। তবে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য জানা যায়নি বাংলাদেশের দিক থেকে। এমনকি ২০টি জে-১০সিই যুদ্ধবিমান কেনা নিয়েও পরে কিছু শোনা যায়নি। এর মধ্যেই মঙ্গলবার ইউরোফাইটার টাইফুন কেনার ব্যাপারে সম্মতিপত্রে সই করল বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। এটি মূলত বাংলাদেশের যুদ্ধবিমান কেনার নানা গুঞ্জন ও জল্পনা-কল্পনার মধ্যে একমাত্র আনুষ্ঠানিক খবর।

২০টি জে-১০সিই কিনতে ২.২ বিলিয়ন ডলার খরচের কথা এসেছিল। ইউরোফাইটার টাইফুন চীনের জে-১০সিই যুদ্ধবিমানের চেয়ে অনেক আধুনিক ও দামী যুদ্ধবিমান। তবে কি জে-১০সিই কেনার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী? এ ব্যাপারে এখনো কিছু জানা যাচ্ছে না। চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগের জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক-৩ নিয়েও কিছু জানা যাচ্ছে না।

এমনও হতে পারে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ইউরোফাইটার টাইফুন কেনার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য আনতে কিছু জে-১০সিই ও জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক-৩ কিনতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সেটা বাংলাদেশের জন্য কতটা চাপ হয়ে দাঁড়াবে, সে ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হবে।

ইউরোফাইটার কেনার ব্যাপারে ইতালির লিওনার্দো এসপিএর সঙ্গে সম্মতিপত্র সই হলো মঙ্গলবার। ছবি: আইএসপিআর
ইউরোফাইটার কেনার ব্যাপারে ইতালির লিওনার্দো এসপিএর সঙ্গে সম্মতিপত্র সই হলো মঙ্গলবার। ছবি: আইএসপিআর

ইউরোফাইটার টাইফুন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বহরে সংযুক্ত হলে বাংলাদেশ হতে যাচ্ছ অত্যাধুনিক এই যুদ্ধবিমান ব্যবহারকারী ১০ম দেশ। ইউরোফাইটার মূলত ইউরোপের চারটি দেশের যৌথ উদ্যোগের ফসল। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি ও স্পেন মিলে কনসোর্টিয়াম গড়ে এই যুদ্ধবিমান উৎপাদন করে। এদের মধ্যে ইতালির লিওনার্দো এসপিএ কনসোর্টিয়ামের ২১ শতাংশ শেয়ারের মালিক। বাংলাদেশে যুদ্ধবিমান সরবরাহ করবে এই প্রতিষ্ঠানই। যে নয়টি দেশ ইউরোফাইটার টাইফুন ব্যবহার করে, তারা হলো–যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, অস্ট্রিয়া, সৌদি আরব, ওমান, কুয়েত ও কাতার। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বাংলাদেশই প্রথম দেশ হিসেবে ইউরোফাইটার ব্যবহার করতে যাচ্ছে।

ইউরোফাইটার টাইফুন জে–১০সিই’র চেয়ে শক্তিশালী। ছবি: রয়টার্স
ইউরোফাইটার টাইফুন জে–১০সিই’র চেয়ে শক্তিশালী। ছবি: রয়টার্স

ইউরোফাইটার টাইফুন দুই ইঞ্জিন ও ক্যানার্ড ডেল্টা উইং-বিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। এটি একটি সুইংরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট। আকাশ থেকে আকাশে, আর আকাশ থেকে ভূমিতে লড়াইয়ে ইউরোফাইটারের দক্ষতা দুর্দান্ত। শত্রুর বিমানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাজিমাত করার জন্য টাইফুনে শক্তিশালী সেন্সর আছে। ডগফাইটিংয়ের জন্য এর গতি যুদ্ধের সময় বাড়তি শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়াও টাইফুনের উন্নতমানের রাডার ব্যবস্থা, মিসাইল ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম এটিকে এ যুগের আকাশ যুদ্ধের অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ধরা হচ্ছে।

আকাশ থেকে ভূমিতে আক্রমণে টাইফুন বিশ্বের অন্যতম সেরা যুদ্ধবিমান। গাইডেড বোমা, প্রিসিশন স্ট্রাইকের অস্ত্র তো আছেই। এটি যুদ্ধের সময় রিয়েল টাইম ব্যাটলফিল্ড ডেটা প্রক্রিয়ার কারণে শত্রুকে খুব সহজেই ঘায়েল করতে পারে।

টাইফুন যুদ্ধক্ষেত্রে নজরদারি করে অন্য যুদ্ধবিমানকেও সাহায্য করতে পারে। এটি নির্ভুলভাবে তথ্য সংগ্রহ করে, শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আকাশ প্রতিরক্ষার সামগ্রিক ছবি সংগ্রহ করে।

যুদ্ধবিমানটির কাঠামোর ১৫ শতাংশই ধাতব। ফলে রাডারের আড়ালে থাকতে পারে। এটি সাবসনিক গতিতে উচ্চমানের ম্যানুভারিং ও সুপারসনিক গতিতে কার্যকর যুদ্ধক্ষমতা বজায় রাখতে পারে।

ইউরোফাইটার ফ্রান্সের রাফাল পর্যায়ের শক্তিশালী যুদ্ধবিমান। ছবি: রয়টার্স
ইউরোফাইটার ফ্রান্সের রাফাল পর্যায়ের শক্তিশালী যুদ্ধবিমান। ছবি: রয়টার্স

ইউরোফাইটার টাইফুনের নকশায় শক্তিশালী কিন্তু হালকা কম্পোজিট উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী উপকরণের তুলনায় এয়ারফ্রেমের ওজন ৩০ শতাংশ কম। এতে রেঞ্জ বৃদ্ধি, পারফরম্যান্সে উন্নতি এবং রাডার সিগনেচার হ্রাস—সবই সম্ভব হয়েছে। ইউরোফাইটার টাইফুনে বর্তমানে বাজারের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইঞ্জিনগুলোর একটি ইজে২০০ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৬০০ কেজি জ্বালানি বহন করতে পারে।

ফ্রান্সের দাসো রাফাল, সুইডেনের সাব গ্রিপেন ই/এফ, আমেরিকার এফ/এ-১৮ সুপার হর্নেট এবং এফ-১৬ ব্লক ৭০/৭২ জাতীয় মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফটের সঙ্গেই ইউরোফাইটারের তুলনা চলে।

কয়টি ইউরোফাইটার কিনবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী? ছবি: রয়টার্স
কয়টি ইউরোফাইটার কিনবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী? ছবি: রয়টার্স

উল্টো দিকে জে-১০সিই যুদ্ধবিমান এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান। এই আধুনিক যুদ্ধবিমান দামে তুলনামূলক সাশ্রয়ী। ইউরোফাইটারের মতো এই জে-১০ সিই যুদ্ধবিমানও অগ্রসর এভিয়নিকস ও প্রিসিশন স্ট্রাইক সক্ষমতাসমৃদ্ধ। জে–১০সিইর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে আছে কানার্ড-ডেল্টা উইং ডিজাইন। এর ককপিটের পেছনে আছে দুটি ছোট পাখা, যে কারণে এই যুদ্ধবিমান নিয়ন্ত্রণ করা পাইলটের পক্ষে সহজ। এ দুই পাখা এর গতিও বাড়িয়ে দেয়।

জে-১০সিই যুদ্ধবিমান ১১টি অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। বিমানের গায়ে ৫টি ও প্রতিটি ডানায় ৫টি করে অস্ত্র বহনের ব্যবস্থা আছে। জে-১০সিই আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপের ক্ষেপণাস্ত্র পিএল-৮, পিএল-১১, পিএল-১২ ও পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে। ইলেকট্রনিক ওয়্যারফেয়ার ও লেজার-গাইডেড পড প্রযুক্তি চীনা এই ফাইটার জেটকে শত্রুর রাডার থেকে লুকোতে এবং নিখুঁত আঘাত হানতে সাহায্য করে।

ইউরোফাইটার টাইফুনের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সম্মতিপত্রে সই করেছে বাংলাদেশ। জে-১০সিইর একই সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বহরে যুক্ত হবে কিনা, সে ব্যাপারে সবকিছুই এখনো জল্পনার স্তরেই। তবে এ ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও বাংলাদেশ বিমানবাহিনী সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। সেক্ষেত্রে কী ধরে নেওয়া যায়, ইউরোফাইটার টাইফুন কেনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে জে-১০সিইর প্রক্রিয়াও চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী?

সম্পর্কিত