৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

চৌ এন লাই বলেছিলেন, চীন পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে

চৌ এন লাই বলেছিলেন, চীন পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে
কিলো ফ্লাইটের সদস্যরা। ছবি: বাংলাদেশ বিমান বাহিনী

একাত্তর সালের ৫ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর বিমান ইউনিট ‘কিলো ফ্লাইট’ সিলেট অঞ্চলে বোমা ফেলে কয়েকটি পাকিস্তানি বাংকার উড়িয়ে দেয়। জামালপুরে বিমান হামলায় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো ঢাকাসহ বাংলাদেশের আকাশ দখল করে নেয়। আকাশ থেকে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ চালায়। ফলে ঢাকার তেজগাঁওসহ বিভিন্ন বিমানঘাঁটি ও বন্দর অচল হয়ে যায়।

পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কে অবরোধ তৈরি করে।

ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-সিলেট, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা-রংপুর এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর-রাজশাহীর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকার সঙ্গে যশোর ও খুলনার যোগাযোগ ছিল।

রণাঙ্গনে ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়া পাকিস্তানি সৈন্যদের সম্মান বাঁচানোর শেষ চেষ্টা চলতে থাকে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে। বাংলাদেশকে ঘিরে ঠান্ডা যুদ্ধে লিপ্ত পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়াও চীনও তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে।

৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের কাছে প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোয় বাংলাদেশ সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে একপেশে ও অগ্রহণযোগ্য দাবি করে বাংলাদেশ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আরেকটি প্রস্তাব আনেন। ওই প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলার আগে বাংলাদেশে সামরিক শাসকদের অত্যাচার বন্ধের দাবিও তোলা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে, অবস্থার অবনতির কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার।

একইসঙ্গে বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিকে বিতর্কে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ারও প্রস্তাব করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বিতর্কে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিলে তা জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্রের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হবে দাবি করে তীব্র আপত্তি জানায় চীনা প্রতিনিধি।

এসময় ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টি যথাযথ পটভূমিতে বিবেচনা করতে হলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বিতর্কে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাতে হবে। পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি বলেন, পাকিস্তানকে টুকরা টুকরা করতে ভারত পাকিস্তানে হামলা করেছে।

নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১১টি রাষ্ট্র। বিপক্ষে ভোট দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড। চীন ভোটে অংশ নেয়নি। নিরাপত্তা পরিষদের এই জরুরি অধিবেশন বসে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৫টি রাষ্ট্রের অনুরোধে। ঠিক হয়, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা বিতর্কে অংশ নিলেও তাদের ভোটাধিকার থাকবে না।

চীন তাদের খসড়া প্রস্তাবে বলে, পাকিস্তানি এলাকা থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অবিলম্বে ও বিনা শর্তে প্রত্যাহার করতে হবে। পাকিস্তানকেও সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।

প্রস্তাবে ভারতীয় আক্রমণ রুখতে সংগ্রামে লিপ্ত পাকিস্তানি জনগণকে সমর্থন করতে সদস্যদেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এদিন বিশ্ব শক্তিকে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করে দেয়। সতর্কবাণীতে বলা হয়, সোভিয়েত সীমান্তের একেবারে গায়ে যে অবস্থা চলছে, তাতে তাদের নিরাপত্তা স্বার্থ জড়িত। তারা এতে উদাসীন থাকতে পারে না।

চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই দ্য সানডে টাইমস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলে চীন পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে।

ওয়াশিংটন থেকে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার জন্য ভারতকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র এদিন এক সরকারি বিবরণ প্রকাশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় সত্যের অপলাপ করা হয়েছে বলে দাবি করেন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত ভারতীয় বাষ্ট্রদূত লক্ষ্মীকান্ত ঝা ।

এদিকে, ভারতের প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লাল দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, একটি আলাদা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা ভারত স্বীকার করে নিয়েছে। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির বিষয়েও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শিগগিরই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এর জবাব পাওয়া যাবে।

তথ্যসূত্র:

আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস

মুক্তিযুদ্ধ ই আর্কাইভ

একাত্তরের দিনপঞ্জি, সাজ্জাদ শরিফ, রাশেদুর রহমান

সম্পর্কিত