৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ফজলে রাব্বি

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আট মাস দশ দিন পর মিলল বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতি। প্রথমকে ভুটান স্বাধীন দেশে হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সেদিন ভারতও বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদে দাঁড়িয়ে এই ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে লেখা চিঠিতে ইন্দিরা লেখেন, “আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদের জরুরি বৈঠক থেকে ভারতের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনে এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় পাকিস্তান এদিন ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। স্বীকৃতি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান এ ঘোষণা দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতকে সেখান থেকে পণ্য আমদানির জন্য মঞ্জুর করা ৬৫ কোটি ৭০ লাখ টাকার ঋণ এদিন স্থগিত করে। দেশটির পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, ভারতকে সামরিক তৎপরতায় সাহায্য করতে পারে, এমন আর্থিক সাহায্য যুক্তরাষ্ট্র বন্ধ করছে।
যুক্তরাজ্যের সংসদের অধিবেশনে টোরি দলের সদস্য ডানকান স্যান্ডস সোভিয়েত ভেটোর সমালোচনা করেন। তবে, জন স্টোনহাউস মার্কিন প্রস্তাবে বিরত থাকায় সরকারের প্রশংসা করেন।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং দুই দেশের সেনা অপসারণের দাবি জানিয়ে ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাব পেশ করে, এদিন আবার সাবেক সোভিয়েত ভেটোয় তা বাতিল হয়ে যায়।
২৪ ঘণ্টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এ নিয়ে দুবার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে। ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি পেশ করেছিল। প্রস্তাবটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভোট দেয়নি।
অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশে হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীকে আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব তোলে। রাতে নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয়।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ এবং ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনের মধ্যে তীব্র বিতর্ক হয়। জর্জ বুশ পাকিস্তানকে আক্রমণের জন্য ভারতকে দায়ী করেন। সমর সেন বাংলাদেশের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিন্দা না করায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক মুখপত্র ল্যুমানিতে প্রকাশিত ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ পরিস্থিতির জন্য ইয়াহিয়া খানের তীব্র নিন্দা করা হয়। বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সমালোচনা করে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং যুদ্ধসংক্রান্ত রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য আলোচনা শুরু করার দাবি জানানো হয়।
কূটনৈতিক বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে যখন তোলপাড় চলছিল, রণাঙ্গনে তখন একের পর এক এলাকা মুক্ত হচ্ছিল পাকিস্তানের হাত থেকে।
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বিত যৌথ বাহিনী রাতে যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ করে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। সেনানিবাস এলাকা ছাড়া যশোর শহরসহ আশপাশের বেশির ভাগ এলাকা এদিন পাকিস্তানি সেনামুক্ত হয়। এর আগে ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর যশোরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ সময় শহরে থাকা পাকিস্তানি সেনারা সেনানিবাসে সমবেত হয়। এরপর রাতের অন্ধকারে তাদের বেশির ভাগ সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এদিন মুক্ত হয় চাঁদপুরের কচুয়া, নীলফামারীর ডোমার এবং কুড়িগ্রামের রাজারহাট। ৬ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ডোমারকে পাকিস্তানি সেনামুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজারহাট ছেড়ে পালিয়ে যায়।
অন্যদিকে, ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসরণ করছে।
তথ্যসূত্র:
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস
মুক্তিযুদ্ধ ই আর্কাইভ
একাত্তরের দিনপঞ্জি, সাজ্জাদ শরিফ, রাশেদুর রহমান

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আট মাস দশ দিন পর মিলল বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতি। প্রথমকে ভুটান স্বাধীন দেশে হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সেদিন ভারতও বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদে দাঁড়িয়ে এই ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে লেখা চিঠিতে ইন্দিরা লেখেন, “আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদের জরুরি বৈঠক থেকে ভারতের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনে এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় পাকিস্তান এদিন ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। স্বীকৃতি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান এ ঘোষণা দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতকে সেখান থেকে পণ্য আমদানির জন্য মঞ্জুর করা ৬৫ কোটি ৭০ লাখ টাকার ঋণ এদিন স্থগিত করে। দেশটির পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, ভারতকে সামরিক তৎপরতায় সাহায্য করতে পারে, এমন আর্থিক সাহায্য যুক্তরাষ্ট্র বন্ধ করছে।
যুক্তরাজ্যের সংসদের অধিবেশনে টোরি দলের সদস্য ডানকান স্যান্ডস সোভিয়েত ভেটোর সমালোচনা করেন। তবে, জন স্টোনহাউস মার্কিন প্রস্তাবে বিরত থাকায় সরকারের প্রশংসা করেন।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং দুই দেশের সেনা অপসারণের দাবি জানিয়ে ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাব পেশ করে, এদিন আবার সাবেক সোভিয়েত ভেটোয় তা বাতিল হয়ে যায়।
২৪ ঘণ্টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এ নিয়ে দুবার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে। ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি পেশ করেছিল। প্রস্তাবটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভোট দেয়নি।
অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশে হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীকে আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব তোলে। রাতে নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয়।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ এবং ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনের মধ্যে তীব্র বিতর্ক হয়। জর্জ বুশ পাকিস্তানকে আক্রমণের জন্য ভারতকে দায়ী করেন। সমর সেন বাংলাদেশের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিন্দা না করায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক মুখপত্র ল্যুমানিতে প্রকাশিত ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ পরিস্থিতির জন্য ইয়াহিয়া খানের তীব্র নিন্দা করা হয়। বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সমালোচনা করে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং যুদ্ধসংক্রান্ত রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য আলোচনা শুরু করার দাবি জানানো হয়।
কূটনৈতিক বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে যখন তোলপাড় চলছিল, রণাঙ্গনে তখন একের পর এক এলাকা মুক্ত হচ্ছিল পাকিস্তানের হাত থেকে।
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বিত যৌথ বাহিনী রাতে যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ করে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। সেনানিবাস এলাকা ছাড়া যশোর শহরসহ আশপাশের বেশির ভাগ এলাকা এদিন পাকিস্তানি সেনামুক্ত হয়। এর আগে ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর যশোরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ সময় শহরে থাকা পাকিস্তানি সেনারা সেনানিবাসে সমবেত হয়। এরপর রাতের অন্ধকারে তাদের বেশির ভাগ সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এদিন মুক্ত হয় চাঁদপুরের কচুয়া, নীলফামারীর ডোমার এবং কুড়িগ্রামের রাজারহাট। ৬ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ডোমারকে পাকিস্তানি সেনামুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজারহাট ছেড়ে পালিয়ে যায়।
অন্যদিকে, ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসরণ করছে।
তথ্যসূত্র:
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস
মুক্তিযুদ্ধ ই আর্কাইভ
একাত্তরের দিনপঞ্জি, সাজ্জাদ শরিফ, রাশেদুর রহমান