স্টার্টআপ কি ভারতকে অস্ত্রে স্বনির্ভর করে তুলতে পারবে?

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
স্টার্টআপ কি ভারতকে অস্ত্রে স্বনির্ভর করে তুলতে পারবে?
প্রতিরক্ষা খাতের সক্ষমতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার। ছবি: রয়টার্স

মহাকাশ প্রকৌশলে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০২০ সালে ‘দিগন্তরা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র অনিরুদ্ধ শর্মা। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো স্যাটেলাইটের গতিবিধি বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা।

বর্তমানে ভারত, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্র মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে ১৫০ জন কর্মী কর্মরত আছেন। এর বাজারমূল্য ৬৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি। পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় এই অঙ্ক ছোট হলেও, এটি ভারতের দ্রুত বিকাশমান প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ খাতের স্টার্টআপ জগতের অন্যতম বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ভারতের আরেকটি স্যাটেলাইট প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গ্যালাক্সআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা সুযশ সিংয়ের মতে, এই সাফল্যের কারণ হলো, ভারতের স্টার্টআপ পরিবেশ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। ভোক্তাপণ্যভিত্তিক অ্যাপের বাইরে গিয়ে ভারতের ধনীরা এখন নতুন খাতে বিনিয়োগ করছেন।

তাছাড়া ভারত সরকার দীর্ঘদিন ধরেই অস্ত্র উৎপাদনে স্বনির্ভরতা চাইছে। যে কারণে সরকারের পরিকল্পনা, প্রতিরক্ষা খাতে ব্যবহৃত অস্ত্র ও তার যন্ত্রাংশের বড় অংশ যেন দেশেই ডিজাইন ও উৎপাদন করা হয়।

চলতি বছরের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধও এই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

গত ২২ এপ্রিল ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপরে বন্দুকধারীদের হামলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় ভারত।

ওয়াশিংটনের থিংকট্যাঙ্ক জার্মান মার্শাল ফান্ডের সমির লালওয়ানি বলেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে চালানো ওই অভিযানে ভারতের উন্নত মানের ক্ষেপণাস্ত্র ভালো পারফরম্যান্স দেখালেও, ড্রোনের ব্যাপক আক্রমণে ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চাপে পড়ে। সেই সঙ্গে আসল অস্ত্র ও ভুয়া লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে পার্থক্য করাও কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে সস্তা ড্রোন ঠেকাতে ভারতকে ব্যয়বহুল ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছে।

এরপর প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই প্রতিরক্ষা খাতের সক্ষমতা বাড়াতে ৫ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ঘোষণা দেয় ভারত। এই অর্থ ভারতের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেটের ২৫ শতাংশ।

ওই অর্থের বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে যুদ্ধ চলাকালে ব্যবহৃত গোলাবারুদ, ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রতিরোধমূলক অস্ত্রের মজুত পুনর্গঠনে। পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকেও নতুন করে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

অপারেশন সিঁদুর দেখিয়েছে, ভারতের আরও উন্নত ড্রোন এবং ড্রোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রেই বড় প্রতিষ্ঠানের তুলনায় স্টার্টআপগুলো এগিয়ে। গোয়েন্দা প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক যুদ্ধব্যবস্থা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও এখন ভারতের অগ্রাধিকার খাত।

প্রায় সব ভারতীয় প্রতিরক্ষা স্টার্টআপই দাবি করছে, তারা এই যুদ্ধে কোনো না কোনোভাবে অবদান রেখেছে এবং তার বিনিময়ে নতুন বিনিয়োগও পেয়েছে।

দিগন্তারার প্রধান অনিরুদ্ধ শর্মা বলেন, “আমরা নিয়মিত সেনাবাহিনীকে রিপোর্ট পাঠিয়েছি।”

তারা চীন ও পাকিস্তানের গুপ্তচর স্যাটেলাইট কোন কোন এলাকায় নজরদারি করতে পারে কি না- সে সম্পর্কেও তথ্য দেওয়ার দাবি করেন তিনি। এই যুদ্ধের কারণে প্রতিরক্ষা খাত থেকে তাদের আয় দ্রুত বেড়েছে বলেও মন্তব্য করেন।

ড্রোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আইডিয়াফোর্জের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অঙ্কিত মেহতা বলেন, ২০২০ সালে চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিরক্ষা খাতের বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। এরপর চলতি বছরের পাকিস্তানের যুদ্ধ আরও সুযোগ এনে দিয়েছে।

এখন অনেক কোম্পানি সামনের সারির সামরিক ইউনিটে গিয়ে তাদের পণ্য পরীক্ষা করছে। বিশেষত উত্তর সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় তারা পরীক্ষা চালাতে পেরেছে, যেখানে হালকা বাতাস ও তীব্র ঠান্ডার কারণে ড্রোনের ব্যাটারি দ্রুত শেষ হয়ে যায় এবং যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এমন সুযোগ ২০১৮ সালেই এসেছিল। যখন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইনোভেশনস ফর ডিফেন্স এক্সিলেন্স (আইডিইএক্স) নামে একটি প্রকল্প চালু করে। এর লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীর নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানে স্টার্টআপ ও প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোকে যুক্ত করা।

আইডিইক্সের কিছু প্রকল্পে প্রোটোটাইপ সফল হলে সরকার ন্যূনতম অর্ডারের প্রতিশ্রুতি দেয়, যাতে স্টার্টআপগুলোর আয় নিশ্চিত হয়। এই প্রকল্পের বাজেট ধীরে ধীরে বড় হওয়ায় পুরো খাতের প্রবৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হয়।

২০২১ সালে যেখানে সর্বোচ্চ সরকারের অনুদান ছিল ১ লাখ ৭৮ হাজার ডলার, ২০২৪ সালে তা বেড়ে প্রায় ৩০ লাখ ডলারে পৌঁছেছে। এখন পর্যন্ত ৬০০টিরও বেশি কোম্পানি এই প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে।

সরকারের এই উদ্যোগের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল অস্ত্র উৎপাদনে স্বনির্ভরতা। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ ভারত।

ফলে গোলাবারুদ ও যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে তারা বিদেশি নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে থাকে, বিশেষ করে আমেরিকার। এখন সরকার চায়, অস্ত্র ও তার যন্ত্রাংশের বড় অংশ যেন দেশেই ডিজাইন ও উৎপাদন করা হয়। এই তালিকা প্রতি বছরই দীর্ঘ হচ্ছে।

একজন উদ্যোক্তা বলেন, টাকার থেকেও বড় বিষয় হলো সেনাবাহিনীকে এখন খুব ইতিবাচকভাবে দেখছে স্টার্টআপগুলো।

এতদিন ধরে ভারতের আমলাতন্ত্র ও জটিল ক্রয়প্রক্রিয়ার জন্য যে বদনাম ছিল, তাও এখন অনেকটা কমে এসেছে। কারণ প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপগুলোর অভিজ্ঞতায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে উঠছে।

তবে এখনও অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ফ্যাবহেডস নামে একটি স্টার্টআপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা দীনেশ কানাগরাজ বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর কোম্পানিগুলো ডুয়াল-ইউজ যন্ত্রাংশ (যেসব যন্ত্রাংশ সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়) বিক্রিতে দ্বিধায় থাকে, বিশেষ করে যদি সেগুলো ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দেশীয় উৎপাদন এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। আবার ভারতের নিজস্ব রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইনও অনেক সম্ভাবনাকে সীমিত করছে বলে উদ্যোক্তারা অভিযোগ করছেন।

দীনেশের ভাষ্য, সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন বড় অঙ্কের বেসরকারি বিনিয়োগের অভাব। প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ খাতের জন্য বিশেষ তহবিল তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ভোক্তা প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের তুলনায় তা অনেক কম।

অনিরুদ্ধ শর্মা বলেন, আগের থেকে বিনিয়োগ বেড়েছে। কিন্তু বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য যে পরিমাণ পুঁজি দরকার, তা এখনও পর্যাপ্ত নয়।

সম্পর্কিত