চরচা ডেস্ক

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়াকে কেন্দ্র করে একটি বিকল্প জোট তৈরির ইঙ্গিত দিয়েছে পাকিস্তান, যেখানে ভারতকে রাখা হবে না। তবে চীন যুক্ত হবে।
গত জুনে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কূটনীতিকরা একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন, সেখানে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানুষের জীবনমান বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সময় তারা বলেন যে, এই সহযোগিতা তৃতীয় কোনো পক্ষকে উদ্দেশ্য করে নয়।
এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, বাংলাদেশ, চীন ও ইসলামাবাদের মধ্যে সাম্প্রতিক ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগটি বিস্তৃত করে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশকেও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
দারের মন্তব্য এমন সময়ে এসেছে, যখন এই অঞ্চলে ক্রমাগত উত্তেজনা বাড়ছে। এমনিতেও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের রয়েছে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশ গত মে মাসে একটি বিমানযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, যা সম্পর্ককে আরও খারাপ করেছে। অন্যদিকে, গত বছর আগস্টে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কেরও অবনতি ঘটেছে।
কিন্তু অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো, যার মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান ও আফগানিস্তান। তারা কি এমন একটি নতুন আঞ্চলিক জোটে যোগ দিতে সম্মত হবে? যেখানে ভারত থাকবে না বা তার প্রভাব খুব সীমিত।
পাকিস্তানের প্রস্তাবটা কী?
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো, অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো, এবং এই ধারণাকে আরও দেশ ও অঞ্চলে বিস্তৃত করা।
ইসলামাবাদে কনক্লেভ ফোরামে তিনি বলেন, “আমাদের নিজেদের ব্যাপার অন্য কোনো দেশের কাছে বন্দী থাকতে পারে না এবং থাকা উচিতও নয়। আপনারা জানেন, আমি কোন দেশের কথা বলছি।’’ এতে ভারতের দিকেই আঙুল তুলেছেন তিনি।
ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যে উত্তেজনা প্রসঙ্গে দার বলেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংলাপ ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্থবির হয়ে আছে। বাকি দেশগুলোর সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক ভালো নয়। তিনি বলেন, ‘‘পাকিস্তান এমন একটি দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখে, যেখানে বিভাজনের পরিবর্তে সংযোগ ও সহযোগিতা আসবে। অর্থনীতি পরস্পর সমন্বয়ে বিকশিত হবে, কোনো দ্বন্দ্ব আবির্ভূত হলে আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হবে। এ ছাড়া সব দেশের মর্যাদা ও সম্মান বজায় রেখেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ-এর পরিচালক রাবেয়া আখতার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, “প্রস্তাবটি অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী। কিন্তু এটি এমন সময়ে পাকিস্তানের আঞ্চলিক সহযোগিতা ব্যবস্থাকে বৈচিত্র্যময় ও পুনর্গঠনের ইচ্ছাকে প্রকাশ করছে, যখন সার্ক কার্যত অচল হয়ে আছে।”
সার্কের কী হলো?
১৯৮৫ সালে ঢাকায় একটি সম্মেলনের মাধ্যমে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সার্কের উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধন করা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়মিতভাবে সম্মেলন আয়োজিত হতে থাকে। সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে। এরপর ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি।
২০২৫ সালের হিসেবে, দুই বিলিয়নেরও বেশি মানুষ দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করে এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। তা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অত্যন্ত কম। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী এটি মোট আঞ্চলিক বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে আছে আসিয়ান, যেখানে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মানুষের বসবাস, অথচ এর সদস্য দেশগুলোর পারস্পরিক বাণিজ্য তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ।
বিশ্ব ব্যাংকের অনুমান অনুযায়ী, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা কমাতে পারলে পণ্য বিনিময় বাড়িয়ে ৬৭ বিলিয়ন ডলারে নিতে পারত, যা বর্তমান বাণিজ্যের তিন গুণ। আঞ্চলিক সংযোগের অভাবকে এই অঞ্চলের দুর্বল বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০১৪ সালে সার্ক একটি মোটরগাড়ি চুক্তি সই করার দ্বারপ্রান্তে ছিল, যেটা কার্যকর হলে ইউরোপের মতো দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে গাড়ি ও ট্রাক চলাচল করতে পারত। কিন্তু পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনার কারণে সেই চুক্তি এবং আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা সংক্রান্ত আরেকটি চুক্তি শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষরিত হয়নি।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সাউথ এশিয়া ইনিশিয়েটিভসের পরিচালক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ফারওয়া আমির আল জাজিরাকে বলেন, “যদি দুই দেশ (ভারত ও পাকিস্তান) বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থে সহযোগিতার ক্ষেত্র শনাক্ত করতে সক্ষম হতো, তাহলে সার্ক নীতিগতভাবে পুনরুজ্জীবিত হতে পারত। তবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেটা একপ্রকার অসম্ভব বলে মনে হয়।’’
কিন্তু পাকিস্তানই প্রথম দেশ নয় যারা সার্ককে পাশ কাটিয়ে এমন আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব গড়ার চেষ্টা করেছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল (যাদের সম্মিলিত নাম বিবিআইএন) নিজেদের মধ্যে একই ধরনের একটি আঞ্চলিক চুক্তি স্বাক্ষর করে।
আমির আরও বলেন যে ভারত অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনেরও সদস্য, যেমন বিমসটেক। যেখানে ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড রয়েছে। তবু দ্বিপক্ষীয় ও ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থাই আঞ্চলিক বহুপাক্ষিকতার তুলনায় স্বল্পমেয়াদে প্রাধান্য পাবে। কারণ এক বা দুই দেশের সঙ্গে আলাদাভাবে কাজ করা স্পষ্ট প্রণোদনা এবং বাস্তবসম্মত ফল পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায় বলে উল্লেখ করেন আমির।
পাকিস্তানের এই প্রস্তাব কি কাজ করবে?
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলছেন, ‘প্রস্তাবটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও অত্যন্ত জরুরি। দক্ষিণ এশিয়া বারবার বাস্তবধর্মী আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান গড়তে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ অঞ্চলটি নিরাপত্তাকেন্দ্রিক সংকীর্ণ রাজনৈতিক ধারণায় আটকে রয়েছে।”
তাত্ত্বিকভাবে একটি নতুন আঞ্চলিক সংস্থার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রবীণ দোঁঠি। তিনি বলেন, “ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অচলাবস্থার কারণে সার্কের নীরব পতন দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে একটি শূন্যতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি চীনের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার পথ সুগম করেছে।”
এটি সফল করতে দেশগুলোকে একত্রে কাজ করার ক্ষমতা দেখাতে হবে এবং ছোট রাষ্ট্রগুলোর চাহিদাকেও গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন শাহাব এনাম খান। তিনি বলেন, “দেশগুলোকে পুরোনো ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে চিন্তা করতে হবে। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ ক্রমশ উপলব্ধি করছে যে তারা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থে আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন। শুধু বৃহৎ শক্তির উদ্বেগ মেটানোর জন্য নয়। আমি মনে করি অঞ্চলটির দেশ ও বাইরের অংশীদারদের জন্য এমন বিকল্প উদ্যোগে যোগ দেওয়ার যথেষ্ট ভিত্তি রয়েছে।”
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের দোঁঠি বলেন, “পাকিস্তানের প্রস্তাব এগিয়ে গেলে এটি ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়াতে পারে, এবং ভারতের সঙ্গে চীনের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতাও তীব্র করতে পারে।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সাউথ এশিয়া ইনিশিয়েটিভসের পরিচালক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ফারওয়া আমির বলছেন, ‘‘পাকিস্তানের প্রস্তাবটি কৌশলগতভাবে সুসংগত। দেশটি এখন কূটনৈতিক চাতুর্যের এমন পর্যায়ে রয়েছে যেখানে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রেখেছে, একই সঙ্গে আমেরিকা ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। এই দ্বি-মুখী কূটনীতি ইসলামাবাদকে একটি আত্মবিশ্বাস ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়েছে, যা মূলত আঞ্চলিক কূটনীতির কেন্দ্রস্থলে নিজের আসন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা।”
সার্ক অকার্যকর হওয়ার পরে নতুন আঞ্চলিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে সবাই। সেটা সফল হবে কি না–তা নির্ভর করছে পাকিস্তানের কূটনৈতিক কৌশলের ওপর।

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়াকে কেন্দ্র করে একটি বিকল্প জোট তৈরির ইঙ্গিত দিয়েছে পাকিস্তান, যেখানে ভারতকে রাখা হবে না। তবে চীন যুক্ত হবে।
গত জুনে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কূটনীতিকরা একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন, সেখানে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানুষের জীবনমান বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সময় তারা বলেন যে, এই সহযোগিতা তৃতীয় কোনো পক্ষকে উদ্দেশ্য করে নয়।
এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, বাংলাদেশ, চীন ও ইসলামাবাদের মধ্যে সাম্প্রতিক ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগটি বিস্তৃত করে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশকেও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
দারের মন্তব্য এমন সময়ে এসেছে, যখন এই অঞ্চলে ক্রমাগত উত্তেজনা বাড়ছে। এমনিতেও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের রয়েছে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশ গত মে মাসে একটি বিমানযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, যা সম্পর্ককে আরও খারাপ করেছে। অন্যদিকে, গত বছর আগস্টে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কেরও অবনতি ঘটেছে।
কিন্তু অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো, যার মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান ও আফগানিস্তান। তারা কি এমন একটি নতুন আঞ্চলিক জোটে যোগ দিতে সম্মত হবে? যেখানে ভারত থাকবে না বা তার প্রভাব খুব সীমিত।
পাকিস্তানের প্রস্তাবটা কী?
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো, অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো, এবং এই ধারণাকে আরও দেশ ও অঞ্চলে বিস্তৃত করা।
ইসলামাবাদে কনক্লেভ ফোরামে তিনি বলেন, “আমাদের নিজেদের ব্যাপার অন্য কোনো দেশের কাছে বন্দী থাকতে পারে না এবং থাকা উচিতও নয়। আপনারা জানেন, আমি কোন দেশের কথা বলছি।’’ এতে ভারতের দিকেই আঙুল তুলেছেন তিনি।
ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যে উত্তেজনা প্রসঙ্গে দার বলেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংলাপ ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্থবির হয়ে আছে। বাকি দেশগুলোর সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক ভালো নয়। তিনি বলেন, ‘‘পাকিস্তান এমন একটি দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখে, যেখানে বিভাজনের পরিবর্তে সংযোগ ও সহযোগিতা আসবে। অর্থনীতি পরস্পর সমন্বয়ে বিকশিত হবে, কোনো দ্বন্দ্ব আবির্ভূত হলে আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হবে। এ ছাড়া সব দেশের মর্যাদা ও সম্মান বজায় রেখেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ-এর পরিচালক রাবেয়া আখতার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, “প্রস্তাবটি অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী। কিন্তু এটি এমন সময়ে পাকিস্তানের আঞ্চলিক সহযোগিতা ব্যবস্থাকে বৈচিত্র্যময় ও পুনর্গঠনের ইচ্ছাকে প্রকাশ করছে, যখন সার্ক কার্যত অচল হয়ে আছে।”
সার্কের কী হলো?
১৯৮৫ সালে ঢাকায় একটি সম্মেলনের মাধ্যমে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সার্কের উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধন করা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়মিতভাবে সম্মেলন আয়োজিত হতে থাকে। সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে। এরপর ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি।
২০২৫ সালের হিসেবে, দুই বিলিয়নেরও বেশি মানুষ দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করে এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। তা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অত্যন্ত কম। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী এটি মোট আঞ্চলিক বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে আছে আসিয়ান, যেখানে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মানুষের বসবাস, অথচ এর সদস্য দেশগুলোর পারস্পরিক বাণিজ্য তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ।
বিশ্ব ব্যাংকের অনুমান অনুযায়ী, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা কমাতে পারলে পণ্য বিনিময় বাড়িয়ে ৬৭ বিলিয়ন ডলারে নিতে পারত, যা বর্তমান বাণিজ্যের তিন গুণ। আঞ্চলিক সংযোগের অভাবকে এই অঞ্চলের দুর্বল বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০১৪ সালে সার্ক একটি মোটরগাড়ি চুক্তি সই করার দ্বারপ্রান্তে ছিল, যেটা কার্যকর হলে ইউরোপের মতো দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে গাড়ি ও ট্রাক চলাচল করতে পারত। কিন্তু পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনার কারণে সেই চুক্তি এবং আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা সংক্রান্ত আরেকটি চুক্তি শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষরিত হয়নি।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সাউথ এশিয়া ইনিশিয়েটিভসের পরিচালক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ফারওয়া আমির আল জাজিরাকে বলেন, “যদি দুই দেশ (ভারত ও পাকিস্তান) বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থে সহযোগিতার ক্ষেত্র শনাক্ত করতে সক্ষম হতো, তাহলে সার্ক নীতিগতভাবে পুনরুজ্জীবিত হতে পারত। তবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেটা একপ্রকার অসম্ভব বলে মনে হয়।’’
কিন্তু পাকিস্তানই প্রথম দেশ নয় যারা সার্ককে পাশ কাটিয়ে এমন আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব গড়ার চেষ্টা করেছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল (যাদের সম্মিলিত নাম বিবিআইএন) নিজেদের মধ্যে একই ধরনের একটি আঞ্চলিক চুক্তি স্বাক্ষর করে।
আমির আরও বলেন যে ভারত অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনেরও সদস্য, যেমন বিমসটেক। যেখানে ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড রয়েছে। তবু দ্বিপক্ষীয় ও ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থাই আঞ্চলিক বহুপাক্ষিকতার তুলনায় স্বল্পমেয়াদে প্রাধান্য পাবে। কারণ এক বা দুই দেশের সঙ্গে আলাদাভাবে কাজ করা স্পষ্ট প্রণোদনা এবং বাস্তবসম্মত ফল পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায় বলে উল্লেখ করেন আমির।
পাকিস্তানের এই প্রস্তাব কি কাজ করবে?
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলছেন, ‘প্রস্তাবটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও অত্যন্ত জরুরি। দক্ষিণ এশিয়া বারবার বাস্তবধর্মী আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান গড়তে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ অঞ্চলটি নিরাপত্তাকেন্দ্রিক সংকীর্ণ রাজনৈতিক ধারণায় আটকে রয়েছে।”
তাত্ত্বিকভাবে একটি নতুন আঞ্চলিক সংস্থার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রবীণ দোঁঠি। তিনি বলেন, “ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অচলাবস্থার কারণে সার্কের নীরব পতন দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে একটি শূন্যতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি চীনের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার পথ সুগম করেছে।”
এটি সফল করতে দেশগুলোকে একত্রে কাজ করার ক্ষমতা দেখাতে হবে এবং ছোট রাষ্ট্রগুলোর চাহিদাকেও গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন শাহাব এনাম খান। তিনি বলেন, “দেশগুলোকে পুরোনো ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে চিন্তা করতে হবে। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ ক্রমশ উপলব্ধি করছে যে তারা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থে আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন। শুধু বৃহৎ শক্তির উদ্বেগ মেটানোর জন্য নয়। আমি মনে করি অঞ্চলটির দেশ ও বাইরের অংশীদারদের জন্য এমন বিকল্প উদ্যোগে যোগ দেওয়ার যথেষ্ট ভিত্তি রয়েছে।”
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের দোঁঠি বলেন, “পাকিস্তানের প্রস্তাব এগিয়ে গেলে এটি ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়াতে পারে, এবং ভারতের সঙ্গে চীনের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতাও তীব্র করতে পারে।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সাউথ এশিয়া ইনিশিয়েটিভসের পরিচালক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ফারওয়া আমির বলছেন, ‘‘পাকিস্তানের প্রস্তাবটি কৌশলগতভাবে সুসংগত। দেশটি এখন কূটনৈতিক চাতুর্যের এমন পর্যায়ে রয়েছে যেখানে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রেখেছে, একই সঙ্গে আমেরিকা ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। এই দ্বি-মুখী কূটনীতি ইসলামাবাদকে একটি আত্মবিশ্বাস ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়েছে, যা মূলত আঞ্চলিক কূটনীতির কেন্দ্রস্থলে নিজের আসন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা।”
সার্ক অকার্যকর হওয়ার পরে নতুন আঞ্চলিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে সবাই। সেটা সফল হবে কি না–তা নির্ভর করছে পাকিস্তানের কূটনৈতিক কৌশলের ওপর।