১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১।
বিজয়ের দুদিন পর রায়েরবাজারের কাঁটাসুর ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ি নামের জায়গায় খুঁজে পাওয়া যায় মানব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস বধ্যভূমি। মুক্তির আনন্দ আর বিজয়ের উচ্ছ্বাস মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায় অনির্বচনীয় এক শোকানুভূতিতে। কোনো সভ্য দেশে এমন নৃশংসতা কী সম্ভব? মুক্তির আনন্দকে গ্রাস করল কান্নার রোল।
রায়েরবাজার আর মিরপুরের শিয়ালবাড়ির পরিত্যক্ত জলাভূমি থেকে আবিষ্কৃত হলো অনেক পরিচিত মানুষের বিকৃত মরদেহ। তাদের কেউ অধ্যাপক, কেউ চিকিৎসক, সাংবাদিক কিংবা সাহিত্যিক। সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ। সবাই সমর্থন দিয়ে গেছেন বাঙালির স্বাধিকারের দাবিকে। ১৬ ডিসেম্বরের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই তো এঁরা সবাই নিখোঁজ ছিলেন। অনেকের ক্ষেত্রেই বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার সময় বলা হয়েছিল ‘সরকারি দায়িত্বের’ কথা। আল বদরের সদস্যরা তাদেরই প্রিয়জনদের আশ্বাস দিয়েছিল, ‘ভয় পাবেন না। ওনার সরকারি দায়িত্বের ডাক পড়েছে। আমাদের বলা হয়েছে নিয়ে যেতে। কাজ শেষ হলে শিগগিরই ফিরবেন তারা।’
তারা কেউই ফেরেননি। ১৬ থেকে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে এই মানুষদের অনেকেরই মৃতদেহ বিকৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায় রায়েরবাজার ও শিয়ালবাড়ির বধ্যভূমিতে। প্রিয়জনেরা যখন মরদেহ শনাক্ত করেছেন, তখন দেখা দেছে কী অত্যাচার-ই না করা হয়েছে তাদের ওপর। কারও দুই চোখ ওপড়ানো, কারও শরীরে অসংখ্য বেয়োনেটের আঘাত, কারও শরীরে অজস্র কাটার দাগ। যেন বেয়োনেট বা ধারালো কোনো কিছু দিয়ে ফালা ফালা করা হয়েছে তাদের শরীর। দেশের বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফজলে রাব্বীর চোখ বাঁধা মরদেহে ‘হৃদয়’ ছিল না। নরপশুরা হার্টের চিকিৎসক ফজলে রাব্বীর হৃদযন্ত্র কেটে বের করে নিয়েছিল। চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, নিজামউদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক রশীদুল হাসানদের মতো অনেককেই বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিজয়ের আগ মুহূর্তে—এঁদের অনেকের মরদেহও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিনমুক্তিযুদ্ধের সময় খবর সংগ্রহ করতে এদেশে এসেছিলেন ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিন। তিনি ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে যান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের ঘটনা কাভার করার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ এই ব্রিটিশ সাংবাদিকের লেখাতেও রায়েরবাজার বধ্যভূমি নিয়ে এক ধরনের হতবিহ্বলতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি রায়েরবাজার বধ্যভূমি দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে সানডে টাইমসে ঢাকা থেকে একটা প্রতিবেদন পাঠান।
সেখানে তিনি লেখেন, “…..এখানে এই বুদ্ধিজীবীরা শুয়ে আছেন। তাঁদের শরীরের ওপর ধুলো-কাদা, দেহগুলো গলতে শুরু করেছে। একটি বাঁধের ওপর একটি কঙ্কাল পড়ে রয়েছে। ঢাকার কুকুরগুলো নাটকীয়ভাবে দেহটাকে মাংসমুক্ত করে ফেলেছে। বাঙালি জনতা এই ডোবাগুলোতে এক অদ্ভুত শান্ত ভঙ্গিমায় চলাচল করছে। এখানে তাদেরকে ক্রোধান্বিত মনে হয় না। অন্যত্র তারা ক্রোধোন্মত্ত, কিন্তু এখানে তারা হাঁটছে, মৃদু ফিসফিস করে কথা বলছে, এমনভাবে হাঁটছে, যেন তারা গির্জা পরিদর্শনরত পর্যটক।”
শিল্পীর তুলিতে কয়েকজন শহীদ বুদ্ধিজীবী।রায়েরবাজার বধ্যভূমির একটা বর্ণনাও পাওয়া যায় তার ‘বেঙ্গলস এলিট ইন অ্য ডিচ’শিরোনামের লেখায়, “রায়েরবাজারের বধ্যভূমিটি হচ্ছে ঢাকা শহরের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকা ধানমন্ডির কাছে একটি ইটখোলা। অদ্ভুত এক নির্জন জায়গা। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে নীলচে সাদা জলাশয়। কচুরিপানা ভেসে বেড়ায় তাতে। শতশত ঢাকাবাসী এসেছিলেন মরদেহগুলো দেখার জন্য। কাদামাটির পাড় ধরে হাঁটতে থাকা অনেকেই খুঁজছিলেন নিজেদের প্রিয়জনদের মরদেহ। তাদের নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গত কয়েকদিনের মধ্যেই।”
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঠিক আগে দিয়ে এমন নৃশংসতা নিয়ে নিজের অভিমতও তুলে ধরেছেন টোমালিন, ‘বৃহস্পতিবার (১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার) ঢাকায় আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কমপক্ষে ৫০ জনের মতো শহরের সেরা বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ নানা পেশাজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। ওটা ছিল বাঙালি এলিট বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত শ্রেণির মানুষকে নিঃশেষ করে দেওয়ার সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। সামরিক অভিযানের নামে এই নৃশংস ব্যাপারটি সম্পর্কে জেনারেল নিয়াজীসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাইকমান্ডের অনেকেই খুব ভালো করেই জানতেন।’
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে কতজন বুদ্ধিজীবী হত্যার শিকার হয়েছিলেন?বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়েই হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন ঢাকাবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নৃশংস উন্মত্ততায় তখনই বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা শুরু হয়। গণহত্যার প্রথম প্রহরেই হত্যা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিশিষ্ট অধ্যাপককে। দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান খান, পরিসংখ্যান বিভাগের এ এন এম মুনীরুজ্জামান, পর্দার্থবিজ্ঞান বিভাগের আতাউর রহমান খাদিম, ইংরেজি বিভাগের ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হলে তিনি বেঁচে ছিলেন আরও কয়েকদিন। ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষককে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। তাদের প্রায় সবাই ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থক।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি ধরে রাখতে ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমি একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। ‘স্মৃতি ১৯৭১’ নামে একাধিক খণ্ডে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজন ও পরিচিতদের লেখা স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ‘স্মৃতি ১৯৭১’গ্রন্থের ১৩টি খণ্ড প্রকাশিত হয়। সেখানে তিন শতাধিক শহীদ বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীর পরিচয় পাওয়া যায়। এই স্মৃতিগ্রন্থের পরিকল্পনা করেছিলেন একাডেমির প্রয়াত মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল। সম্পাদক ছিলেন প্রয়াদ রশীদ হায়দার।
১৯৭১ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের বছর। বিশ্ব মানচিত্র মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর বছর। কিন্তু সেটির বিনিময় মূল্য অনেক। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা স্বাধীন বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনাটা করেছিল ঠান্ডা মাথাতেই।