রিতু চক্রবর্ত্তী

বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনের (কপ) ৩০তম আসর শেষ হয় গত ২১ নভেম্বর। সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল দেশে ফেরে ২৩ নভেম্বর, ঠিক যেদিন ঢাকার বাতাসের মান ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’। সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশের রাজধানীতে দূষণ থাকবে না–এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু এটা একটা বৈপরীত্যকে সামনে আনে।
একটু পেছনে ফেরা যাক। গত ২ নভেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন, এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেশ কিছু সরকারি দপ্তরের প্রধানদের অংশগ্রহণে এক সভায় সমন্বিত উদ্যেগে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই নির্দেশনার সাথে জুড়িগাড়ি হয়ে ছিল—সাবেকী ইটভাটা বন্ধ, ইটিপি চালু, যানবাহনের কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলো। এই প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে টেকসই জ্বালানি ব্যবহার বা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়টিও যুক্ত। কিন্তু বছরের পর বছর এ বিষয়ে নির্দেশনার বাইরে যেমন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি জলবায়ু সম্মেলন থেকেও আদতে প্রতিশ্রুতিগুচ্ছ ছাড়া ভাণ্ডার শূন্য।
ব্রাজিলের বেলেম শহরে অনুষ্ঠিত কপ সম্মেলনের ৩০তম আসর এবার অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এবারই প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কার্যকর হওয়ারও এক দশক পূর্ণ হলো।
প্রশ্ন হলো—কপ সম্মেলনের ৩০তম বছরে বাংলাদেশের চাওয়া কী ছিল? আর কী পেয়েছে বাংলাদেশ? আর তাতে আমাদের প্রতিনিধি দলেরই–বা কী অবদান?

গত ৩০ বছর ধরেই বাংলাদেশ মহাসমারোহে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মলেনে (কনফারেন্স অব পার্টিস) অংশ নিচ্ছে। আর ৩০ বছর ধরেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমরা নানা পরিকল্পনার কথা শুনছি। কিন্তু তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, সেই প্রশ্ন তোলা একদমই অমূলক নয়।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনা চলছে—জলবায়ুতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো কত টাকা পাবে? কথা ছিল, একটি বিশেষ তহবিল গঠন হবে, আর সেই অর্থ সবচেয়ে বেশি পাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম দেশ। নদী ভাঙন, খরা, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিয়মিত মোকাবিলা করতে হয় এই দেশের মানুষের। কিন্তু বাংলাদেশ পেয়েছে ঋণ।
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান ও কার্বন ব্রিফ-এর যৌথ প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক এক চিত্র উঠে এসেছে। জাতিসংঘে জমা দেওয়া অপ্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তাদের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের তহবিলের একটি বড় অংশ যাচ্ছে চীন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো তেল-সমৃদ্ধ দেশগুলোর কাছে।
২০২১ ও ২০২২ সালের বিশ হাজারেরও বেশি বৈশ্বিক প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই দুই বছরে জলবায়ু অর্থায়নের সবচেয়ে বড় প্রাপক ছিল ভারত, যারা পেয়েছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন পেয়েছে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার।
আশ্চর্যজনকভাবে, জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও সংযুক্ত আরব আমিরাত জাপানের চেয়ে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ পেয়েছে। শীর্ষ ১০ কার্বন নিঃসরণকারী দেশের মধ্যে অন্যতম সৌদি আরবও জাপান থেকে প্রায় ৩২৮ মিলিয়ন ডলার বেশি পেয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও কেন তহবিলের বদলে ঋণ পাচ্ছে বা এই বিষয়ে আমাদের প্রতিনিধি দলই বা কী ভূমিকা পালন করছে–সে প্রশ্ন থাকছে।
এ ছাড়া প্রশ্ন ওঠে, প্রাপ্ত ঋণ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের সাফল্য কী? আমাদের ক্লাইমেট রিফিউজি (জলবায়ু উদ্বাস্তু) বা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর ভাগ্যেই–বা কতটুকু পরিবর্তন এসেছে?
প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্প-যুগের পূর্বের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা এবং সম্ভব হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হবে। এই চুক্তি অনুযায়ী, তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য যারা দায়ী; অর্থাৎ, শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া বা শিল্পোন্নত দেশগুলো, তাপমাত্রা কমানোর উদ্যোগ নিতে বাধ্য।

কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য যারা দায়ী, তাদের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার বদলে আমরা ঋণ নিচ্ছি। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের অনেকেই আবার এই তহবিলের সিংহভাগ নিয়েও যাচ্ছে। এ তো গেল জলবায়ু তহবিল বা এ সূত্র ধরে অর্থায়নের বিষয়টি। এর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আসে বছর বছর হওয়া এ সম্মেলন থেকে বিশ্ববাসী আসলে কী চায়। তার কিছুটা বোঝা যাবে আলোচ্যসূচি দেখলে।
এবার যেমন, পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থাকে মাথায় রেখে ৩০তম কপ সম্মেলনের ছয়টি অ্যাকশন এজেন্ডা সাজানো হয়েছিল। এগুলো হলো–শক্তি, শিল্প ও পরিবহন; বন, সাগর ও জীববৈচিত্র্য; কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা; শহর, অবকাঠামো ও জল; মানব ও সামাজিক উন্নয়ন এবং অর্থ ও প্রযুক্তি।
সম্মেলনে বাংলাদেশের দাবি থাকে দুটি–
১. ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ তহবিল থেকে দ্রুত ও যথাযথ অর্থায়ন, কারণ নদীভাঙন, লবণাক্ততা ও জলসংকটে বাংলাদেশে ক্ষতি বাড়ছে।
২. উপকূল রক্ষা বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার, পানি পরিশোধন, লবণসহনশীল ফসল ও দুর্যোগ পূর্বাভাস ব্যবস্থায় অভিযোজনে অর্থায়ন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর প্রয়োজন।
কপ সম্মেলনে দেশগুলো তাদের দাবি দাওয়া তুলে ধরে সাধারণত দুভাবে–স্বতন্ত্রভাবে বা কোনো একটা ব্লকের মাধ্যমে। স্বল্পন্নোত দেশগুলো সাধারণত এলডিসি, জি৭৭+চীন বা অন্য কোনো ব্লক তৈরি করে নিজেদের দাবিগুলো পেশ করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এলডিসি প্ল্যাটফর্মকেই ব্যবহার করে। কপ ৩০–এ এলডিসি ব্লকের অন্যতম দাবি ছিল অভিযোজন–সংক্রান্ত তহবিল তিনগুণ করা।
তবে অনেক দেশই তাদের দাবিগুলোকে স্বতন্ত্রভাবে তুলে ধরে। এর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাউই। তারা তাদের বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন–সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলোকে তুলে ধরেছে চমৎকারভাবে এবং তাতে শুধু কপ সম্মেলনের অভ্যন্তরীণ তহবিলই নয়, সম্মেলনে আসা অন্য অনেক দাতা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান মালাউই নিয়ে আগ্রহী হয়েছে।
বাংলাদেশ কেন এভাবে নিজেদের তুলে ধরে না, সে বিষয়ে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশনের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ চরচাকে বলেন, “এর বড় কারণ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা প্রতিনিধি দলের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। আর এ জন্যই বাংলাদেশ স্বতন্ত্রভাবে নিজেদের দাবি দাওয়া তুলে ধরতে পারে না।”
শুধু তাই নয়, এই সমন্বয়হীনতা কোন মাত্রায় তাও জানালেন কপ ৩০ থেকে ফিরে আসা এই জলবায়ু অ্যাকটিভিস্ট। তিনি জানান, এই সমন্বয়ের অভাবের কারণেই এবারের কপ ৩০–এ বাংলাদেশের যে প্যাভিলিয়ন ছিল, তা প্রথম ৩ দিন বন্ধ ছিল, যা খুবই ‘দুঃখজনক’।
তবে এবারের অভিযোজন সংক্রান্ত তহবিল ৩ গুন করার যে দাবি ছিল এলডিসি ব্লকের, তা কপ ৩০–এ পাস হয়। আর এতে এই ব্লকের যে অভ্যন্তরীণ আলোচনা ছিল, সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন আজাদ।
শুরুতেই গত ২৩ নভেম্বর নিয়ে যে বৈপরীত্যের কথা বলা হয়েছিল, তা এতক্ষণে স্পষ্ট হওয়ার কথা। বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন থেকে ফিরে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রাজধানী ঢাকার অস্বাস্থ্যকর বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর তার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এর ঠিক ২১ দিন আগে পরিবেশ উপদেষ্টার নির্দেশনা অনেকটা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো হয়েছে। কারণ, ২১ দিনেও বায়ুদূষণ তো দূর, এ সংক্রান্ত উদ্যোগের কোনো নজির সামনে আসেনি। ঠিক যেমন ৩০ বছর ধরে জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিলেও এবং বাংলাদেশ নিজে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় থাকলেও মালাউইর মতো করে নিজেদের সংকট, তা মোকাবিলার নানা পন্থা এবং নিজস্ব কোনো উদ্যোগের উদাহরণ সামনে রাখতে পারছে না। আবুল কালাম আজাদ যে তথ্য জানালেন, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্যাভিলিয়ন করার সুযোগ পেয়েও বাংলাদেশ তা তিনদিন ধরে শূন্য রেখে দিয়েছিল। ফলে, জলবায়ু সম্মেলন থেকে নিজেদের দাবি আদায়ে বাংলাদেশের চেষ্টা যথাযথ কিনা, সে প্রশ্নের উত্তরটি আর তেমন খুঁজতে হয় কি?

বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনের (কপ) ৩০তম আসর শেষ হয় গত ২১ নভেম্বর। সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল দেশে ফেরে ২৩ নভেম্বর, ঠিক যেদিন ঢাকার বাতাসের মান ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’। সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশের রাজধানীতে দূষণ থাকবে না–এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু এটা একটা বৈপরীত্যকে সামনে আনে।
একটু পেছনে ফেরা যাক। গত ২ নভেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন, এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেশ কিছু সরকারি দপ্তরের প্রধানদের অংশগ্রহণে এক সভায় সমন্বিত উদ্যেগে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই নির্দেশনার সাথে জুড়িগাড়ি হয়ে ছিল—সাবেকী ইটভাটা বন্ধ, ইটিপি চালু, যানবাহনের কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলো। এই প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে টেকসই জ্বালানি ব্যবহার বা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়টিও যুক্ত। কিন্তু বছরের পর বছর এ বিষয়ে নির্দেশনার বাইরে যেমন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি জলবায়ু সম্মেলন থেকেও আদতে প্রতিশ্রুতিগুচ্ছ ছাড়া ভাণ্ডার শূন্য।
ব্রাজিলের বেলেম শহরে অনুষ্ঠিত কপ সম্মেলনের ৩০তম আসর এবার অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এবারই প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কার্যকর হওয়ারও এক দশক পূর্ণ হলো।
প্রশ্ন হলো—কপ সম্মেলনের ৩০তম বছরে বাংলাদেশের চাওয়া কী ছিল? আর কী পেয়েছে বাংলাদেশ? আর তাতে আমাদের প্রতিনিধি দলেরই–বা কী অবদান?

গত ৩০ বছর ধরেই বাংলাদেশ মহাসমারোহে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মলেনে (কনফারেন্স অব পার্টিস) অংশ নিচ্ছে। আর ৩০ বছর ধরেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমরা নানা পরিকল্পনার কথা শুনছি। কিন্তু তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, সেই প্রশ্ন তোলা একদমই অমূলক নয়।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনা চলছে—জলবায়ুতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো কত টাকা পাবে? কথা ছিল, একটি বিশেষ তহবিল গঠন হবে, আর সেই অর্থ সবচেয়ে বেশি পাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম দেশ। নদী ভাঙন, খরা, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিয়মিত মোকাবিলা করতে হয় এই দেশের মানুষের। কিন্তু বাংলাদেশ পেয়েছে ঋণ।
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান ও কার্বন ব্রিফ-এর যৌথ প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক এক চিত্র উঠে এসেছে। জাতিসংঘে জমা দেওয়া অপ্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তাদের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের তহবিলের একটি বড় অংশ যাচ্ছে চীন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো তেল-সমৃদ্ধ দেশগুলোর কাছে।
২০২১ ও ২০২২ সালের বিশ হাজারেরও বেশি বৈশ্বিক প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই দুই বছরে জলবায়ু অর্থায়নের সবচেয়ে বড় প্রাপক ছিল ভারত, যারা পেয়েছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন পেয়েছে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার।
আশ্চর্যজনকভাবে, জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও সংযুক্ত আরব আমিরাত জাপানের চেয়ে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ পেয়েছে। শীর্ষ ১০ কার্বন নিঃসরণকারী দেশের মধ্যে অন্যতম সৌদি আরবও জাপান থেকে প্রায় ৩২৮ মিলিয়ন ডলার বেশি পেয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও কেন তহবিলের বদলে ঋণ পাচ্ছে বা এই বিষয়ে আমাদের প্রতিনিধি দলই বা কী ভূমিকা পালন করছে–সে প্রশ্ন থাকছে।
এ ছাড়া প্রশ্ন ওঠে, প্রাপ্ত ঋণ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের সাফল্য কী? আমাদের ক্লাইমেট রিফিউজি (জলবায়ু উদ্বাস্তু) বা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর ভাগ্যেই–বা কতটুকু পরিবর্তন এসেছে?
প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্প-যুগের পূর্বের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা এবং সম্ভব হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হবে। এই চুক্তি অনুযায়ী, তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য যারা দায়ী; অর্থাৎ, শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া বা শিল্পোন্নত দেশগুলো, তাপমাত্রা কমানোর উদ্যোগ নিতে বাধ্য।

কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য যারা দায়ী, তাদের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার বদলে আমরা ঋণ নিচ্ছি। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের অনেকেই আবার এই তহবিলের সিংহভাগ নিয়েও যাচ্ছে। এ তো গেল জলবায়ু তহবিল বা এ সূত্র ধরে অর্থায়নের বিষয়টি। এর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আসে বছর বছর হওয়া এ সম্মেলন থেকে বিশ্ববাসী আসলে কী চায়। তার কিছুটা বোঝা যাবে আলোচ্যসূচি দেখলে।
এবার যেমন, পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থাকে মাথায় রেখে ৩০তম কপ সম্মেলনের ছয়টি অ্যাকশন এজেন্ডা সাজানো হয়েছিল। এগুলো হলো–শক্তি, শিল্প ও পরিবহন; বন, সাগর ও জীববৈচিত্র্য; কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা; শহর, অবকাঠামো ও জল; মানব ও সামাজিক উন্নয়ন এবং অর্থ ও প্রযুক্তি।
সম্মেলনে বাংলাদেশের দাবি থাকে দুটি–
১. ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ তহবিল থেকে দ্রুত ও যথাযথ অর্থায়ন, কারণ নদীভাঙন, লবণাক্ততা ও জলসংকটে বাংলাদেশে ক্ষতি বাড়ছে।
২. উপকূল রক্ষা বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার, পানি পরিশোধন, লবণসহনশীল ফসল ও দুর্যোগ পূর্বাভাস ব্যবস্থায় অভিযোজনে অর্থায়ন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর প্রয়োজন।
কপ সম্মেলনে দেশগুলো তাদের দাবি দাওয়া তুলে ধরে সাধারণত দুভাবে–স্বতন্ত্রভাবে বা কোনো একটা ব্লকের মাধ্যমে। স্বল্পন্নোত দেশগুলো সাধারণত এলডিসি, জি৭৭+চীন বা অন্য কোনো ব্লক তৈরি করে নিজেদের দাবিগুলো পেশ করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এলডিসি প্ল্যাটফর্মকেই ব্যবহার করে। কপ ৩০–এ এলডিসি ব্লকের অন্যতম দাবি ছিল অভিযোজন–সংক্রান্ত তহবিল তিনগুণ করা।
তবে অনেক দেশই তাদের দাবিগুলোকে স্বতন্ত্রভাবে তুলে ধরে। এর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাউই। তারা তাদের বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন–সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলোকে তুলে ধরেছে চমৎকারভাবে এবং তাতে শুধু কপ সম্মেলনের অভ্যন্তরীণ তহবিলই নয়, সম্মেলনে আসা অন্য অনেক দাতা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান মালাউই নিয়ে আগ্রহী হয়েছে।
বাংলাদেশ কেন এভাবে নিজেদের তুলে ধরে না, সে বিষয়ে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশনের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ চরচাকে বলেন, “এর বড় কারণ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা প্রতিনিধি দলের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। আর এ জন্যই বাংলাদেশ স্বতন্ত্রভাবে নিজেদের দাবি দাওয়া তুলে ধরতে পারে না।”
শুধু তাই নয়, এই সমন্বয়হীনতা কোন মাত্রায় তাও জানালেন কপ ৩০ থেকে ফিরে আসা এই জলবায়ু অ্যাকটিভিস্ট। তিনি জানান, এই সমন্বয়ের অভাবের কারণেই এবারের কপ ৩০–এ বাংলাদেশের যে প্যাভিলিয়ন ছিল, তা প্রথম ৩ দিন বন্ধ ছিল, যা খুবই ‘দুঃখজনক’।
তবে এবারের অভিযোজন সংক্রান্ত তহবিল ৩ গুন করার যে দাবি ছিল এলডিসি ব্লকের, তা কপ ৩০–এ পাস হয়। আর এতে এই ব্লকের যে অভ্যন্তরীণ আলোচনা ছিল, সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন আজাদ।
শুরুতেই গত ২৩ নভেম্বর নিয়ে যে বৈপরীত্যের কথা বলা হয়েছিল, তা এতক্ষণে স্পষ্ট হওয়ার কথা। বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন থেকে ফিরে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রাজধানী ঢাকার অস্বাস্থ্যকর বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর তার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এর ঠিক ২১ দিন আগে পরিবেশ উপদেষ্টার নির্দেশনা অনেকটা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো হয়েছে। কারণ, ২১ দিনেও বায়ুদূষণ তো দূর, এ সংক্রান্ত উদ্যোগের কোনো নজির সামনে আসেনি। ঠিক যেমন ৩০ বছর ধরে জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিলেও এবং বাংলাদেশ নিজে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় থাকলেও মালাউইর মতো করে নিজেদের সংকট, তা মোকাবিলার নানা পন্থা এবং নিজস্ব কোনো উদ্যোগের উদাহরণ সামনে রাখতে পারছে না। আবুল কালাম আজাদ যে তথ্য জানালেন, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্যাভিলিয়ন করার সুযোগ পেয়েও বাংলাদেশ তা তিনদিন ধরে শূন্য রেখে দিয়েছিল। ফলে, জলবায়ু সম্মেলন থেকে নিজেদের দাবি আদায়ে বাংলাদেশের চেষ্টা যথাযথ কিনা, সে প্রশ্নের উত্তরটি আর তেমন খুঁজতে হয় কি?