ইউরোপ এখন একা?

ইউরোপ এখন একা?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনসভা ইউরোপীয় পার্লামেন্ট (ইপি)। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

ইউরোপীয়রা নিজেদের এই বিশ্বাসে অভ্যস্ত করে ফেলেছিল যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে আগাম বোঝা কঠিন, তার কোনো ধারাবাহিকতা নেই–তারপরও শেষমেষ তাকে সামাল দেওয়া যায়। এই অদ্ভুত ধারণা একেবারেই ভুল। ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি ভ্যান্সের ইউরোপবিরোধী বক্তব্য থেকে শুরু করে ৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত নতুন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল পর্যন্ত–ট্রাম্প প্রশাসনের ইউরোপ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই স্পষ্ট ও ধারাবাহিক ছিল। সেই দৃষ্টিভঙ্গি হলো- আমেরিকা-রাশিয়া সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং ইউরোপকে ভাগ করে দুর্বল করা। এই কাজের বড় একটি অংশ এখন করছে ইউরোপের জাতীয়তাবাদী, কট্টর-ডানপন্থী শক্তিগুলো, যারা আজ মস্কো ও ওয়াশিংটন–দু দিক থেকেই সমর্থন পাচ্ছে।

ইউরোপের বোঝা উচিত যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও নিজস্ব নিরাপত্তার প্রশ্নে তাকে বাস্তবে একাই দাঁড়াতে হচ্ছে। আরও খারাপ হলো, এখন ইউরোপকে দু দিকের দুটি প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হচ্ছে: পূর্বে রাশিয়া এবং পশ্চিমে ট্রাম্পের আমেরিকা।

যখনই ট্রাম্প বা তার প্রশাসনের সদস্যরা ইউরোপকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করেছেন ইউক্রেনসহ ইউরোপীয়রা জোর করে হাসি ধরে রেখে সেই আঘাত সহ্য করেছে। তখনও হোয়াইট হাউসকে খুশি করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তাদের বিশ্বাস ছিল, এটি এক ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত চাল। ট্রাম্পের কথিত অসংগত আচরণ ও আত্মমুগ্ধতা ব্যবহার করে তাকে আবারও আন্তঃঅ্যাটলান্টিক সম্পর্কের ভেতরে টেনে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তারা।

কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যখনই ট্রাম্প মনোযোগ দিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কিকে ওভাল অফিসে ডেকে অপদস্থ করার কূটচক্রান্ত থেকে শুরু করে, আগস্টে আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দেওয়া লাল কার্পেট অভ্যর্থনা পর্যন্ত সবই আছে। এছাড়া মস্কোই লিখে দিয়েছে বলে মনে হতে পারে এমন ২৮-দফার ‘শান্তি পরিকল্পনা’ পর্যন্ত এরই অংশ। প্রতিটি ঘটনায় ইউরোপীয়রা আঘাতটা মেনে নিয়েছে। নিজেরা ব্যস্ত থেকেছে ওয়াশিংটনকে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টার মধ্যে। পাশাপাশি আন্তঃঅ্যাটলান্টিক বন্ধন রক্ষা করতে।

ট্রাম্পের প্রতি এতবারই ইউরোপীয়রা নমনীয়তা দেখিয়েছে যে এখন প্রশ্ন ওঠে, তাদের আর নমনীয় করার মতো কোনো দিক বাকি আছে কি?

আসলে ইউরোপ এমন এক বাজি ধরেছে যার ফলাফল হার ছাড়া কিছুই নয়। একটি শেষ না হওয়া ‘গ্রাউন্ডহগ ডে’-এর মতো। ইউরোপ, ইউক্রেন ও রাশিয়ার প্রশ্নে ট্রাম্প প্রশাসন বরাবরই বিস্ময়করভাবে সুসংগত। ট্রাম্প চান ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হোক। এর মূল কারণ তিনি মনে করেন এই যুদ্ধই আমেরিকা–রাশিয়া সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে বাধা দিচ্ছে। বিশেষ করে তার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে ক্রেমলিন-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের পরিকল্পিত ব্যবসায়িক চুক্তিগুলোর ব্যাপারে।

লিবারেল বিশ্বব্যবস্থা এখন অতীত; তার জায়গায় এসেছে ‘যোগ্যতমের টিকে থাকা’। পুরোনো আমলের পরাশক্তির প্রতিযোগিতার বদলে ট্রাম্প এখন রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে এক ধরনের সাম্রাজ্যবাদী সমঝোতা গড়ে তুলতে আগ্রহী। আর ইউরোপসহ বিশ্বের বাকি অংশ এখন সেই ঔপনিবেশিক মেন্যুর অংশ।

কৌশলগতভাবে দেখলে, এতে স্বল্পমেয়াদে কিছুটা যুক্তি আছে। আদর্শগতভাবেও এটি ইউরোপসহ নানা দেশে কট্টর-ডানপন্থী দল ও সরকারের প্রতি সমর্থনের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। এসব শক্তি শুধু ট্রাম্পের মাগা (মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন)-এর জাতীয়তাবাদী ও সামাজিকভাবে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিই ভাগ করে না, তারা ইউরোপকে ভেঙে বিভক্ত করা এবং ইউরোপীয় সংহতিকে ভেতর থেকে দুর্বল করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদের সহযোগিতায় মধ্য-ডানপন্থীরা ‘বোকা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

ইউরোপে তথাকথিত দেশপ্রেমিক ও সার্বভৌমত্ববাদীরা যে ইউরোপীয় ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার পথ খুঁজছে। এর চেয়ে কম দেশপ্রেম কিছু হতে পারে না। নতুন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে ইউরোপ নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতি খুবই সীমিত। এটি ঠিক সেই দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলের প্রতিরূপ, যা পুতিনের রাশিয়া বহু বছর ধরে ইউরোপের প্রতি অনুসরণ করে আসছে।

যদি ট্রাম্প এখনো ইউরোপকে নিজের ইচ্ছেমতো বশীভূত করতে না পারেন, তার কারণ ইউরোপের কোনো চতুর কৌশল নয়। ট্রাম্পকে ‘ড্যাডি’ বলে ডেকে তোষামোদ করা, উপহার দিয়ে ভাসিয়ে রাখা, বা রাজকীয় ভোজে আমন্ত্রণ জানানো–এগুলো কোনোভাবেই ইউক্রেনকে বাঁচাবে না, পারবে না আন্তঃঅ্যাটলান্টিক সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে।

ট্রাম্প তার ইউক্রেন যুদ্ধসংক্রান্ত পরিকল্পনা এবং ইউরোপে নতুন ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করতে না পারার একমাত্র কারণ হলো, পুতিন এখনো সহজে ধরা দিচ্ছেন না। কিন্তু আমেরিকা-রাশিয়া সমঝোতায় পুতিন সবসময়ই বাধা হয়ে দাঁড়াবেন-এই ধারণার ওপর ইউরোপের নিরাপত্তা কৌশল দাঁড় করানো চলবে না।

ইউরোপীয়দের তাহলে কী করা উচিত?

সুখবর হলো, ইউরোপের সাধারণ মানুষ ও সরকারগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখন বুঝতে পারছে যে, ইউরোপের নিরাপত্তার পথ যায় কিয়েভের মধ্য দিয়ে। এই পথে আছে জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, পোল্যান্ড, নর্ডিক দেশগুলো, বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো, নেদারল্যান্ডস, স্পেন এবং কিছুটা হলেও ইতালি।

তারা স্বীকার করে যে রাশিয়ার এই সাম্রাজ্যবাদী দখলযুদ্ধ ইউক্রেন দিয়ে শুরু হলেও সেখানে শেষ হয় না। কিয়েভের যদি পতন ঘটে, তাহলে রাশিয়ার হাতে আরও সম্পদ ও সক্ষমতা যুক্ত হয়ে যাবে, যা দিয়ে তারা ইউরোপের বিরুদ্ধে নতুন ফ্রন্ট খুলতে পারবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ইউক্রেনই এখন সেই দরজা, যা ইউরোপজুড়ে চলমান হাইব্রিড যুদ্ধকে আরও গুরুতর সামরিক আক্রমণে রূপ নিতে বাধা দিচ্ছে।

দ্বিতীয় সুখবর হলো, ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইউরোপের হাতে উল্লেখযোগ্য শক্তিশালী উপায় আছে, অনেক ক্ষেত্রে তা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেন-সমর্থন প্রায় থমকে গেছে। কিন্তু ইউরোপই রাশিয়ার বেশির ভাগ জব্দকৃত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছ। ইউরোপই সেই কার্যকর নিষেধাজ্ঞা দেয়, ইউক্রেনকে অর্থনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখে এবং সামরিক সহায়তার বড় অংশ সরবরাহ করে।

ইউরোপের বিনিয়োগের কারণেই এখন ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ টিকে আছে এবং তা দেশের নিজস্ব সামরিক শিল্পের ওপর ভর করে।

তারপরেও এসব বলে যেন অতিরিক্ত আশাবাদের কোনো ছবি আঁকা না হয়–সেটিও মনে রাখা জরুরি। আমেরিকা এখনো ইউক্রেন ও ইউরোপের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে সেই গোয়েন্দা তথ্যের কারণে যা ইউক্রেনকে রাশিয়ার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং রাশিয়ার ভেতরে দূরপাল্লার হামলার লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করে।

এর বাইরে, আমেরিকা ইউরোপের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে লাভবান হয়, সেসব অস্ত্র ইউক্রেনের জন্য কেনা হয়, এবং যে ধরনের অস্ত্র ইউরোপ বড় পরিসরে উৎপাদন করে না বা একেবারেই করে না।

ইউরোপ তার দুর্বলতা কমাতে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াচ্ছে। কিন্তু প্রায়শই এর মানে হলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও বেশি অস্ত্র কেনা। এটি স্বল্পমেয়াদে দুর্বলতা কমাচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। ইউরোপীয়রা এখনও এই দ্বিধার সমাধান করতে পারেনি।

তাই ইউরোপের নিরাপত্তা ধাঁধার একটি সিস্টেম্যাটিক সমাধান এখনও দেখা যাচ্ছে না। ইউরোপের হাতে আছে সেই শক্তিশালী উপায় যা ইউক্রেনের পতন রোধ করতে পারে এবং ন্যায়সঙ্গত শান্তির শর্ত তৈরি করতে পারে। আর দুটি বিষয় এখানে অনুপস্থিত।

প্রথমটি হলো ইউরোপের কৌশলগত উদ্দেশ্যের ওপর মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা। ইউরোপীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘমেয়াদী কৌশল সম্পর্কে একটি বিমূর্ত ধারণা নিয়ে আছেন। কিন্তু বাস্তবে তারা প্রায়ই স্বল্পমেয়াদী, স্বার্থনিষ্ঠ বিষয়ের মধ্যে আটকা পড়ে। এটি সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা যায় বেলজিয়াম এবং ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রাশিয়ার জব্দকৃত সম্পদের ব্যবহার নিয়ে স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন অবস্থান থেকে, যা ইউক্রেনকে সাহায্য করতে পারে। নিঃসন্দেহে এখানে আর্থিক এবং আইনি ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু এগুলো তুলনায় ক্ষুদ্র যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত খরচ ইউরোপকে ভোগ করতে হতে পারে যদি ইউক্রেন হারলে।

দ্বিতীয় উপাদান হলো, সাহস। ইউরোপীয় নেতাদের উচিত সাহস জোগানো। ওয়াশিংটনে গিয়ে ট্রাম্পকে তার ‘শান্তি’ প্রচেষ্টার জন্য বিনয়ী ধন্যবাদ জানানো। তাকে বোঝানো যে পৃথিবী জুড়ে আরও অনেক সংঘাত রয়েছে যেদিকে তার মনোযোগ প্রয়োজন। ইউরোপীয়রা বলতে পারে: “ইউক্রেনের ব্যাপারে যুদ্ধ আমরা সামলাতে পারি। আমাদের একমাত্র অনুরোধ, গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা এবং অস্ত্র ক্রয় অনুমোদন চালিয়ে যাওয়া, যাতে আমরা আমাদের নিজস্ব সময় তৈরি করতে পারি।”

ইউরোপ আজই যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না। কিন্তু এটি মহাদেশে টেকসই নিরাপত্তার শর্ত তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারে। আর যদি তোষামোদ প্রয়োজন হয়, ইউরোপ ট্রাম্পকে আশ্বাস দিতে পারে যে শান্তির দিন এলে, এটি আনন্দের সঙ্গে তাকে একটি স্মারক, একটি চত্বর, বা উজ্জ্বল, সোনালী পুরস্কার উৎসর্গ করবে।

নাথালি তোচ্চি: একজন ইতালীয় রাজনৈতিক বিজ্ঞানী এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ।

**লেখাটি আমেরিকান সাময়িকী ফরেন পলিসি থেকে নিয়ে ঈষৎ সংক্ষেপে অনুবাদ করে প্রকাশিত।**

সম্পর্কিত