ঢাকায় গেলাসি কি আছে?

ঢাকায় গেলাসি কি আছে?
ঢাকায় যারা গেলাসি বিক্রি করেন তারা সঙ্গে একটা ডিমও পরিবেশন করেন। ছবি: এআই দ্বারা সম্পাদিত

গেলাসি কিংবা গ্লাসি। যে নামেই ডাকা হোক না কেন এই প্রজন্মের কেন মধ্যবয়স্ক অনেক ঢাকাইয়াই পুরো জীবনে সত্যিকারের এই বস্তু খেয়েছেন কি না সন্দেহ। অনেকে হয়ত নামও শোনেননি। এই বস্তুটিকে মোটামুটি আদি ঢাকাইয়া খাবারের একটি ধরা যায়। একজন দুঃখ করে বলেছিলেন, গেলাসি খাওয়া আর খাওয়ানো একটা প্রজন্ম প্রায় শেষের পথে! হয়ত শেষও!

কী এই গেলাসি

ইংরেজি গ্লস শব্দ আসার কারণে এটার নাম ‘গ্লাসি’ হয়েছে। তবে পুরান ঢাকার মানুষরা খাবারটিকে ‘গেলাসি’ বলে।

গেলাসি হচ্ছে খাসির মাংসের একটি পদ। আর সেই মাংস হতে হবে চর্বি সমৃদ্ধ। গেলাসিতে ১ কেজি ভেড়া বা খাসির মাংসকে আট টুকরো করে কাটা হয়। পাঁঠা বা বকরির মাংসের কথা ভাবাই যাবে না! কারণ তাতে চর্বি কম থাকে।

গেলাসি রান্নার মসলা খুব অল্প। আধা কেজি ঘি এবং ২০০ গ্রাম মাখন অবশ্যই লাগবে। গেলাসির প্রধান উপকরণই হলো মাংসের সঙ্গে থাকা চর্বি, ঘি আর মাখন। এর নাম গেলাসি হওয়ার কারণ, মাংসের পৃষ্ঠতল সবসময় কাচের মতো চকচক করে।

হুমায়ূন আহমেদ তার বাদশাহ নামদার উপন্যাসে মোগলাই গেলাসির একটা রেসিপি লিখেছিলেন। কেমন সেটা? পাতলা স্লাইস করে কাটা খাসির মাংস শজারুর কাঁটা দিয়ে (বিকল্পে খেজুরের কাঁটা) কেঁচে নিতে হবে। কেঁচানো মাংসে দিতে হবে কিশমিশের রস, পোস্ত বাটা, পেস্তাবাদাম বাটা, শাহি জিরা বাটা, আদার রস, পেঁয়াজের রস, রসুনের রস, দই, দুধ, গমবাটা ও পরিমাণমতো লবণ। এতে যুক্ত হবে জয়ত্রীর গুড়ো, জয়ফলের গুঁড়ো, দারুচিনির গুঁড়ো। সব ভালোমতো মেখে মাটির হাঁড়িতে রেখে ঢেকে দিতে হবে। মাটির হাঁড়িটি সারা দিন রোদে থাকবে। খাবার পরিবেশনের আগে আগে অল্প আঁচে মাংসের টুকরো ভৈসা ঘি বা মহিষের দুধের ঘিয়ে ভাজতে হবে। তাহলেই তৈরি হবে গেলাসি।

আরেকটি পুরান ঢাকাইয়া রেসিপিও একজন দিয়েছিলেন। বড় বড় আকারের চর্বিযুক্ত খাসির টুকরোতে লবণ মাখিয়ে ঘিয়ে ভেজে নিয়ে তুলে রাখতে হবে। পাত্রে বেশি পরিমাণে ঘি দিয়ে তাতে অল্প পেঁয়াজ ও আদাবাটা কম আঁচে সাদা করে ভুনা করে নিতে হবে। এবার এতে আস্ত দারুচিনি, এলাচ তেজপাতা, সাদা গোলমরিচ দিতে হবে। এবার এতে মাংস দিয়ে অল্প আঁচে ঢেকে রান্না করতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ রান্নার পর ওপরের চর্বির স্তর আধগলা হয়ে চকচকে রূপ নিলে বেশ ভালো পরিমাণে মাখন, মালাই, দুধ ও সামান্য ময়দা গুলিয়ে গেলাসি রান্নার পাত্রে ঢেলে দিতে হবে। এই মিশ্রণটি মিশে গেলে চকচকে একটা ভাব আসবে। দরকার পড়লে ওপর থেকে আরও খানিকটা মাখন দিয়ে দিতে হবে।

এলো কোথা থেকে

গেলাসির উৎপত্তি নিয়ে নানা মত আছে। কেউ বলেন এটি মধ্য এশিয়ার পদ। কেউ বলেন কাশ্মিরী। কেউ এটাকে আবার অ্যাংলো পদও বলেন।

যারা বলেন, পদটি মধ্য এশিয়া থেকে উৎসাহিত। তারা যে খুব একট ভুল বলেন–এমন নয়। কারণ, আজকের কাজাখস্তান এবং আশপাশের অঞ্চলের যাযাবররা মাংস যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য ওই পশুর চর্বিতেই তা রান্না করতেন। তাদের দেওয়া হতো মাখনও। আর তারা এই পদটি করতেন ভেড়ার মাংস দিয়ে।

অনেকে বলেন, আর্মেনিয়ান গুলাশ হচ্ছে গেলাসির আদি মাতা বা পিতা। অনেকে আবার সেটি মানেন না। কারণ এই রান্নার অন্যতম উপাদান মাখন আর ঘি। আর্মেনীয় রান্নায় মাখনের ব্যবহার আছে কিন্তু ঘিয়ের ব্যবহার?

অনেকে আবার বলেন, ঢাকার নবাবদের বাবুর্চিরা কাশ্মীর থেকে এই পদ আমদানি করেন। তাহলে এই পদটিতে জাফরান দেওয়া হয় না কেন? অনেকে আবার বলেন, এটা নাকি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের পদ। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পদ কি এত চর্বিপূর্ণ হয়? গেলাসি যে কতটা স্নেহপূর্ণ তা বলাই হয়েছে। মধ্য এশিয়ার মাংসের যে পদটির কথা বলা হলো, ওটাই হয়ত গেলাসির দূরতম পূর্বনারী বা পূর্বপুরুষ। হিন্দুকুশ পেরিয়ে বহু ঘাটের জল খেয়ে ঢাকায় এসে গেলাসি রূপে ধরা দিয়েছিল।

গেলাসি বিলুপ্ত?

পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দাদের বর্তমান বংশধরদের অনেকে বলেন, ঢাকায় এখন গেলাসি বলে যে বস্তুটি পাওয়া যায়–সেটি আদতে তা নয়। বরং গেলাসির কাছাকাছি কিছু একটা। তাদেরই একজন সাংবাদিক নাদিমা জাহান বলেছিলেন, “প্ল্যানচেট কইরা পাগলা সাবেরে লিয়া আহেন। আর কুনো তরিকা নাইক্কা। আমি হুদা কিসসা হুনছি। জিন্দিগিতে খাইনাইক্কা সাচ্চা গেলাসি। লায়ন সিনামার গল্লির লগে দিয়া পাওন যাইত পাগলার গেলাসি।”

‘পাগলা সাহেব’ নামের এই ভদ্রলোককে অনেকে বলেন ঢাকার শেষ গেলাসি বিক্রেতা। যার দোকান সেই ৭০ এর দশকেই উঠে যায়।

শিল্পী পরিতোষ সেন তার ‘জিন্দাবাহার লেন’ বইতে যে এলাকার কথা বলেছেন, সেখানেই গেলাসি বিক্রি করতেন পাগলা। নাট্যকার, চিত্র সমালোচক সাঈদ আহমদ ‘ঢাকা আমার ঢাকা’ বইতে লিখেছেন, আশেক লেনের লায়ন সিনেমার পাশে ছিল পাগলার গেলাসির দোকান। একসময় পুরো ঢাকায় বিখ্যাত ছিল পাগলার গেলাসি। পাগলা নামে পরিচিত এই মানুষটার বাবা ছিলেন থমসন সাহেবের কুক (বাবুর্চি)। তারা ছিলেন বংশ পরম্পরায় বাবুর্চি।

থমসন সাহেব নিজে দেশে ফিরে গেলে ভদ্রলোক আর বাবুর্চির কাজ না করে চাষবাস শুরু করেন। তার ছেলে বাবার কাছ থেকে শেখা বিদ্যা দিয়েই একসময় শুরু করেন গেলাসি বানানো। লায়ন সিনেমা লাগোয়া বেড়ার ঘরেই বসে বানাতেন গেলাসি।

সাঈদ আহমদ লিখেছেন, সন্ধ্যার পরেই পাগলার দোকানে ভিড় জমত রসিকদের। আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন জায়গা এবং বাসা-বাড়িতে পার্সেলও যেত। চকবাজার, লক্ষ্মীবাজার থেকেও লোকজন আসত পাগলার দোকানে।

পাগলার দোকানের পাশে ছিল দুটি গ্যারেজ। সেই দুই গ্যারেজের একটির সম্প্রসারণের জন্য উঠে যেতে হয় পাগলা সাহেবকে। পরেও একটা দোকান করেছিলেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন চলেনি। আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় গেলাসি। সাঈদ আহমেদ লিখেছেন দেড় ইঞ্চি পুরু চাক চাক মাংস কাচের মতো চকচক করত।

কেন বলা হয় গেলাসি শেষ

ঢাকার বেশ কিছু রেস্টুরেন্টে এখনো গেলাসি বলে মাংসের একটি পদ তৈরি হয়। স্মৃতি হাতড়ে অনেকেই বলেন, গেলাসিতো চকচক করার কথা। এগুলোতে সেটা করে না। আর চর্বি, ঘি ও মাখনের যে ছড়াছড়ি ও মিলমিশের কথা বলা হয়, সেটাও অনুপস্থিত। তার ওপর গরুর মাংস দিয়ে অনেকে গেলাসি বানাচ্ছেন। যার কোনোটাই গেলাসির সঙ্গে যায় না। বরং বলা যেতে পারে, গেলাসির মতো কিছু একটা পাওয়া যায়। এই লেখকও কয়েক জায়গায় খেয়ে দেখেছেন। তাতে বইপত্রে বর্ণনা পাওয়া গেলাসির সঙ্গে মেলে না। আর গেলাসির সঙ্গে ডিমও পরিবেশন করা হয়।

সম্পর্কিত