প্রসঙ্গ চাকসু

নির্বাচন হয়েছে দুই মাস, বসার জায়গা নেই নির্বাচিতদের!

নির্বাচন হয়েছে দুই মাস, বসার জায়গা নেই নির্বাচিতদের!
চাকসু ভবন। ছবি: চরচা

দুই মাস পার হতে চললেও এখনো আসন বুঝে পাননি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) প্রতিনিধিরা। চাকসু ভবন সংস্কারের কাজ শেষ না হওয়ায় এ অবস্থার তৈরি হয়েছে। এদিকে চাকসুর জন্য অর্থ বরাদ্দও দিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যে কারণে তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা।

দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক পরে গত ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় চাকসু নির্বাচন। ভোট না হওয়ায় বেহাল দশা ছিল চাকসু ভবনের। ক্যান্টিন আর বিয়ের অনুষ্ঠানের কমিউনিটি সেন্টারে পরিণত হয় চাকসু ভবন। তবে চাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ভবন সংস্কার শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল আহাদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় চাকসু ভবন সংস্কারের জন্য ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৬৭৭ টাকার বাজেট অনুমোদন করা হয়েছে।

তবে সংস্কার কাজ চলছে ‘কচ্ছপ গতিতে’। নির্বাচনের আগে ভবন সংস্কারের কাজ শুরু হলেও এখনো নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আসন বুঝে পাননি। দীর্ঘ সময় পর চাকসু নির্বাচন আয়োজন, প্রতিনিধিদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতার কারণে চাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আসন বণ্টনে বিলম্ব হচ্ছে বলে দাবি প্রশাসনের।

চাকসুর পরিচালক জাহেদুর রহমান চৌধুরী বলেন, “নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আসন বরাদ্দ দেওয়ার কাজ চলছে। খুব শিগগিরই তা সম্পূর্ণ করা হবে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কর্মকর্তার দাবি, “সম্পাদকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।”

চাকসুর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা কোনো তহবিল ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৬০ বছরে মোট ছয়বার চাকসু নির্বাচন হলেও কখনো আলাদা তহবিল বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে ভর্তি হওয়া সময় ৫৮ টাকা করে ‘কেন্দ্রীয় হল ইউনিয়ন ফি’ দিতে হয়। এছাড়া প্রতি বর্ষে ফরম পূরণের সময়ও এই ফি দিতে হয়। নিয়মিত ফি নিলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আলাদা করে চাকসুর নামে কোন তহবিল গঠন করেনি। চাকসু নির্বাচন না হওয়ায় গত ৩৫ বছরে প্রায় কোটি টাকার উপরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাকসু বা ‘কেন্দ্রীয় হল ইউনিয়ন’ ফি নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের থেকে নেওয়া এসব টাকা আদতে কোন খাতে ব্যয় হয়েছে, কীভাবে ব্যয় হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসাব নিয়ামক আমিরুল ইসলাম চরচাকে বলেন, “চাকসুর জন্য আলাদা কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। এ কারণে চাকসু কেন্দ্রিক আয় বা ব্যয়ের জন্য পৃথকভাবে কোনো তহবিল সংরক্ষণও করা হয় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের আয় ভর্তি পরীক্ষা, বিভিন্ন ফি, দোকান ইত্যাদির আয়ের টাকা বার্ষিক রাজস্ব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) থেকে যে অনুদান দেওয়া হয়, সেটিও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ের সঙ্গে একত্র করে একটি সমন্বিত বাজেট তৈরি করা হয়।”

চাকসু ভবন সংস্কারের কাজ শেষ না হওয়ায় এখনো বসতে পারেনি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। ছবি: চরচা
চাকসু ভবন সংস্কারের কাজ শেষ না হওয়ায় এখনো বসতে পারেনি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। ছবি: চরচা

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “বাজেট অনুমোদনের পর খাতভিত্তিক ব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ের ক্ষেত্র অনেক। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে অর্থ পাওয়া যায়, তার পরিমাণ মোট বাজেটের তুলনায় খুবই নগণ্য। এই অর্থ দিয়ে আলাদাভাবে চাকসু পরিচালনা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”

আমিরুল ইসলামের দাবি, “২৫-২৬ এ আমাদের মোট বাজেট ৪৫০ কোটি টাকা, যেখানে শিক্ষার্থী ও অন্যান্য উৎস থেকে মোট আয় মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। ইউজিসি অনুদানসহ এই পুরো ৪৫০ কোটি টাকা একত্রিতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হয়। ফলে চাকসু থেকে যে সামান্য আয় হয়, তাও মোট বাজেটের অংশ হিসেবে যুক্ত হয়ে যায় এবং সেখান থেকেই সব খাতে ব্যয় করা হয়। চাকসুর জন্য এখন পর্যন্ত কোনো পৃথক সিদ্ধান্ত, তহবিল বা অ্যাকাউন্ট গঠন করা হয়নি।”

চাকসুর এজিএস আইয়ুবুর রহমান তৌফিক বলেন, “প্রথম মিটিংয়ে আমি উপাচার্যের কাছে আয় এবং বাজেটসহ বিভিন্ন হিসাব চেয়েছিলাম। তারা জানায়, এক খাতের টাকা অন্য খাতে খরচ হয়ে গেছে। চাকসু বন্ধ থাকলেও চাকসুর অন্যান্য কার্যক্রম চলমান ছিল। খরচ হওয়ার পরেও আমরা বাকি হিসাব চাইলে তা পাইনি।”

চাকসুর কোনো বরাদ্দ না থাকায় বিভিন্ন আয়োজন ও কার্যক্রমে আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে। তবে, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে চাকসুর পক্ষ থেকে সেমিনার আয়োজন, উদ্যোক্তা মেলা, ছাত্রী হলে সেলাই মেশিন বিতরণ, হলে উচ্চশিক্ষা সহায়ক বই বিতরণসহ বেশ কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়।

চাকসুর কোনো সুনির্দিষ্ট তহবিল না থাকায় ইসলামী ছাত্রশিবির এসব কাজে অর্থায়ন করেছে বলে অভিযোগ আছে। তবে শিবিরের অর্থায়নের বিষয়টি গোপন করার অভিযোগ উঠেছিল। গত ১৯ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ-ভারত ফুটবল ম্যাচ দেখতে বড় এলইডি স্ক্রিনের ব্যবস্থা করা হয় চাকসুর পক্ষ থেকে। বড় পর্দায় খেলা দেখানোর সময় ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। এরই মাধ্যমে চাকসুর কার্যক্রম আয়োজনে ছাত্র শিবিরের অর্থায়নের বিষয়টি সামনে আসে।

এজিএস আইয়ুবুর রহমান তৌফিক বলেন, “বিভিন্ন প্রোগ্রাম করার সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা যাতায়াত ও অন্যান্য খরচের বেশিরভাগই ছাত্রশিবিরের টাকা দিয়ে হচ্ছে এবং তারা এটিকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গোপন করছে। আমরা বাজেট চেয়েছি, কিন্তু তারা দিচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে চাকসুকে একটি রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার বানাতেই বাজেট দিতে এত দেরি করা হচ্ছে। উপাচার্যের সাথে যখনই দেখা হয়, তখনই আমরা বাজেট নিয়ে কথা বলি।”

ভিপি ইব্রাহিম হোসেন রনি ছাত্র শিবিরের অর্থায়নের বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করেননি। তিনি চরচাকে বলেন, “প্রথম দিন থেকেই চাকসুর কার্যক্রম চলছে। কিছু দিন পর আমরা সব কাজের একটা তালিকা প্রকাশ করব। চাকসুকে যে কেউ চাইলে সহযোগিতা করতে পারে। আমি সবাইকে স্বাধীনতা দিয়েছি। যারা সহযোগিতা করতে চাইবে তাদের সাহায্য নিতে পারবে, সেটা সংগঠন হোক বা সামাজিক সংগঠন হোক। তবে সব সম্পাদককে সব তথ্য জানানো জরুরি নয়।”

চাকসুর কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী অ্যালামনাই সংগঠন চাকসুসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শক্তিশালী অ্যালামনাই সংগঠন আবাসিক হল নির্মাণসহ বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রমে সহায়তা করার রীতি রয়েছে। এই সুযোগটা পাচ্ছে না চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। তবে অ্যালামনাই সংগঠন দাঁড় করাতেও রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ।

নির্বাচনের দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো শেষ হয়নি চাকসু ভবন সংস্কারের কাজ। ছবি: চরচা
নির্বাচনের দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো শেষ হয়নি চাকসু ভবন সংস্কারের কাজ। ছবি: চরচা

চাকসুর কার্যক্রমে অ্যালামনাইদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। যদিও এখন পর্যন্ত অ্যালামনাইদের সঙ্গে কোনো সভা করতে পারেনি চাকসুর প্রতিনিধিরা। চাকসুর ভিপি ইব্রাহিম রনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি অ্যালামনাই গ্রুপ আছে। একটি পক্ষ থেকে আমাদেরকে শুভেচ্ছা জানালেও আরেকটি থেকে জানানো হয়নি। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আশা করি ভবিষ্যতে প্রতিটি কাজেই তারা অংশগ্রহণ করবে ও সাহায্য করবে।”

চাকসুকে পুরোপুরি কার্যক্ষম করতে চাকসু নেতৃত্বের ‘যথেষ্ট ঘাটতি’ রয়েছে বলে মনে করেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগাঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়। তিনি বলেন, “আসলেই আমরা ৩৫ বছর পর নির্বাচনকে ঘিরে অনেক আশা করেছিলাম। কিন্তু গত দুই মাসে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখিনি। আগে যারা নিজেদের সাধারণ ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিত, এখন তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রোগ্রামে যাচ্ছে। এটি চবি শিক্ষার্থীদের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।”

এই ছাত্রনেতা আরও বলেন, “মেডিকেল, শাটল বা অন্য যে কোনো ইস্যুতে আমরা কোনো আশাতীত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না। শিক্ষার্থী–বান্ধব কোনো কাজ চোখে পড়ছে না বরং দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নেই ব্যস্ত সময় কাটছে। আগেও অবস্থার উন্নতি ছিল না, এখনো একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।”

সার্বিক বিষয় জানতে চাকসুর সভাপতি উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

সম্পর্কিত