২০৩০ সাল শাসন করবে যে ১০টি দেশ

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
২০৩০ সাল শাসন করবে যে ১০টি দেশ
ভারতের ইন্ডিয়া গেট, আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি ও চীনের গ্রেটওয়াল। ছবি: পেক্সেলস

২০৩০ সাল। আর মাত্র চার থেকে সাড় চার বছর বাকি। কী হতে পারে এই সময়কালে? অনেক কিছু? কেন? গত ছয় মাসের ঘটনাই দেখুন। ট্রাম্পের শুল্ক-যুদ্ধ, চীনের ডিপসিক এআই-এর কারণে আমেরিকার শেয়ারবাজারে ধস, বিরল খনিজ রপ্তানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা, মার্কিন ডলারের পতন, একের পর এক দেশের ব্রিকস জোটে যোগদান, ট্রাম্পের কথা অমান্য করে রাশিয়ার বেয়াড়াপনা, ইউরোপের থরহরিকম্প দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি–কত কিছুই না হয়ে এর গেছে এর মধ্যে। গাজার গণহত্যা, ইরানের ওপর হামলার প্রসঙ্গও কী বাদ দেওয়া যাবে? এসব ঘটনাই ভবিষ্যৎ বিশ্বের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে।

সেই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় কে কোথায় থাকবে, সেটা ধীরে ধীরে নির্ধারণ হয়ে যাবে। তবে আমাদের আলোচ্য বিষয়, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রভাবশালী ১০টি দেশ কারা হবে? আপনি যাদের এ তালিকায় থাকবে বলে ভাবছেন, তারা না-ও থাকতে পারে। আবার যাকে আপনি এক/ দুই/ তিন নম্বরে ভাবছেন তারা হয়তো সেখানে নেই। ফলে এই তালিকা চূড়ান্ত নয়। এ নিয়ে বিতর্ক আছে, থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। এই বিতর্কের চর্চাটা সমাজের জন্য জরুরি। নিয়ে আলোচনা করব।

তবে অবশ্যই তালিকায় যারা যুক্ত হয়েছে তাদের থাকার পেছনে যুক্তি আছে। এই যুক্তি দ্বিমত থাকতে পারে। এখানে এমন সব পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে যা আপনার জীবন বদলে দেবে। আপনার ফোন কোথায় তৈরি হচ্ছে, আপনার গাড়ি কীভাবে চলছে, কারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং বৈশ্বিক কূটনীতি–সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত।

তাহলে চলুন ১০ নম্বর দিয়ে শুরু করা যাক। তারপর ধীরে ধীরে না হয় এক-এ পৌঁছে যাব।

১০. জার্মানি

ক্ষমতার ধারাবাহিকতা, উদ্ভাবন ও প্রভাব দিয়ে পরিমাপ করলে জার্মানি প্রতিটি তালিকায় হয়তো শীর্ষে থাকবে। ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি। দীর্ঘদিন ধরে তারা বিশ্বমানের প্রকৌশল, উচ্চ-মানের উৎপাদন এবং শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পরিচিত। জার্মানি দ্রুত বদলাচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতা থেকে গ্রিন এনার্জির দিকে দ্রুত যাচ্ছে দেশটি। তারা ইতিমধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে শুরু করেছে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে, জার্মানি তার শিল্প ভিত্তিকে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ দিয়ে আধুনিকীকরণ করছে। স্মার্ট উৎপাদনের জন্য মেশিন, এআই এবং ক্লাউড সিস্টেম সংযুক্ত হচ্ছে। এটি শুধু দক্ষতার বিষয় নয়; এটি স্বয়ংক্রিয়তার যুগে জাতি হিসেবে কীভাবে পণ্য উৎপাদন করে তা পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার বিষয়।

রাজনৈতিকভাবে, জার্মানি ইউরোপ ও ন্যাটোর মধ্যে আরও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। জার্মানি চিৎকার করে না। তারা তৈরি করে, তারা নেতৃত্ব দেয়, নিয়ম বানিয়ে দেয়–যা পরে অন্যরা অনুসরণ করে।

৯. জাপান

জাপান পুরোনো ও নতুনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার এক দারুণ উদাহরণ। আর এই ভারসাম্যের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে তারা সুপারপাওয়ার হতে পারে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি জাপান তার ঐতিহ্যের ওপর ভর করে বসে নেই। তারা রোবোটিক্স, এআই-চালিত উৎপাদন, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং টেকসই শক্তি প্রযুক্তিতে অগ্রগতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। জাপানের স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত শুধু গাড়ি নিয়ে নয়; এটিকে বুদ্ধিমান, গতিশীলতা, জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং এমনকি উড়ন্ত গাড়ি তৈরি দিকে মন দিয়েছে।

তবে জাপানের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো দ্রুত বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। জন্মহার কমে আসা। ফলে দেশটির জন্য অভিবাসন একটা বড় বিষয়। কারণ প্রযুক্তির যত উন্নতিই হোক না কেন শেষমেষ মানুষ লাগবেই। আন্তর্জাতিকভাবে, জাপান আরও দৃঢ়ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় তারা। পরিবর্তিত নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে শান্তিবাদী সংবিধানও পুনর্বিবেচনা করছে তারা। বিভিন্ন দেশে জাপানের ব্যাপক বিনিয়োগও দেশটির একটা বড় শক্তি।

৮. রাশিয়া

ভালোবাসুন বা ভয় পান, উপেক্ষা করতে পারবেন না রাশিয়াকে। পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং বৈশ্বিক বিতর্ক সত্ত্বেও ২০৩০ সালের দিকে রাশিয়া অন্যতম শক্তিশালী ভূ-রাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে থেকে যাবে। বিশাল তেল, গ্যাস এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের মজুদ–দেশটির বড় অস্ত্র। তিন বছর ধরে ইউক্রেন সংঘাতের পরেও তারা বহাল তবিয়তে টিকে আছে।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার সামরিক ক্ষমতা। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে পূর্ব ইউরোপ থেকে সিরিয়া পর্যন্ত সবাই রাশিয়াকে সমিহ করে। দেশটির সাইবার অ্যাটাকের ক্ষমতা বিশ্বের সবচেয়ে ভীতিকর বিষয়ের মধ্যে অন্যতম। এআই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং মহাকাশ প্রতিরক্ষায় প্রচুর বিনিয়োগ করছে রাশিয়া। ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্র ডিজিটাল ও মহাকাশ–উভয়ই হতে পারে তা তারা জানে।

পশ্চিমাদের নীতির কারণে রাশিয়া পূর্ব দিকে ঝুঁকছে। চীন, ইরান, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে সম্পর্ক জোরদার করছে। রাজনৈতিক সমর্থনের বিনিময়ে অস্ত্র, জ্বালানি ও অবকাঠামো সহযোগিতা দিচ্ছে। তবে দেশটির অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বাস্তব। কিন্তু ক্ষমতা সবসময় দেশের জিডিপি অথবা মাথা পিছু আয় দিয়ে হয় না। মনে রাখতে হবে, রাশিয়ার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে পরমাণু অস্ত্র আছে। এগুলো ব্যবহারের মতো উচ্চ প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্রও আছে। পাশাপাশি আছে পশ্চিমাদের ওপর বিরক্ত একাধিক বন্ধুদেশ। তাই ভবিষ্যতের বহুমুখী বিশ্বে তারা বৈশ্বিক দাবাবোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।

৭. মিশর

মিশর একসময় ছিল ফারাওদের আবাসস্থল। এখন একটি নতুন মহাদেশীয় অর্থনীতিকে শক্তি। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের মাঝে কৌশলগতভাবে অবস্থিত মিশর সুয়েজ খাল নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বে জাহাজে করে যে পণ্য পাঠানো হয় তার ১০ শতাংশ এই খালের মাধ্যমে হয়। একে বলা হয় বাণিজ্য ধমনী।

তবে ভৌগোলিক অবস্থানই এর একমাত্র শক্তি নয়। মিশর তার দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যাকে কাজে লাগাচ্ছে। ২৫ বছরের কম গড় বয়স এবং একটি ক্রমবর্ধমান ভোক্তা শ্রেণি, অবকাঠামো, পরিষেবা গড়ে উঠেছে। সরকার নতুন প্রশাসনিক রাজধানী, উন্নত বন্দর, শিল্প অঞ্চল এবং মরুভূমিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্ষেত্রের মতো মেগা প্রকল্পগুলিতে বড় বাজি ধরছে। এগুলো কেবল প্রতীক নয়। এগুলি মিশরকে পর্যটন-নির্ভর অর্থনীতি থেকে বের হয়ে আসার একটা বড় উদ্যোগ।

তবে মুদ্রাস্ফীতি, সরকারের ঋণ এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মতো বাধা তো আছেই। মিশরের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হলো মহাদেশগুলোর মধ্যে সেতু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং উপসাগরীয় দেশ, চীন ও ইউরোপের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা। মিশর নিজেকে আঞ্চলিক সুপার-কানেক্টর হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে। মিশর কেবল নিল নদের তীরে গড়ে ওঠা প্রাচীন সাম্রাজ্যের একটি ধ্বংসাবশেষ নয়। এটি একটি নতুন মহাদেশীয় অর্থনীতির লঞ্চপ্যাড হয়ে উঠছে।

৬. ব্রাজিল

কয়েক দশক আগেই ব্রাজিলকে একটি ঘুমন্ত দৈত্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সম্ভাবনাময় একটি দেশ। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এর গতি মন্থর। এই তকমা আর এখন মানানসই নয়। ২০৩০ সালের মধ্যে, ব্রাজিল শুধু লাতিন আমেরিকাকে নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতির মূল কিছু খাতকেও নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। এর বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ– লোহা, তেল, লিথিয়াম এবং বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানি– আগের চেয়ে আরও মূল্যবান হয়ে উঠছে।

তবে ব্রাজিলের শক্তি শুধু মাটির নিচে নয়। বিশ্বকে খাদ্য, জ্বালানি ও প্রযুক্তি সরবরাহের সক্ষমতার মধ্যেও নিহিত। ব্রাজিল বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জন্য সয়াবিন, গরুর মাংস, কফি ও চিনি সরবরাহ করে। এখন তারা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফলন সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি ব্রাজিল নীরবে লাতিন আমেরিকায় একটি প্রযুক্তি কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে।

কূটনৈতিকভাবে ব্রিকস জোট, জি২০-তে ব্রাজিল কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করছে। ট্রাম্পের শুল্ক-নীতির বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলতে ভয় পায় না দেশটি। আমরা জানি ফুটবল ব্রাজিলকে বিখ্যাত করেছে। কিন্তু কত জন জানি তাদের সঙ্গীত, ফ্যাশন ও পপ সংস্কৃতিকে। এদিকে মন দিয়েছে তারা। তাই ব্রাজিল আর শুধু কার্নিভালের দেশ নয়। এটি শক্তি, খাদ্য ও লাতিন আমেোরিকার কূটনীতির কমান্ড সেন্টারে পরিণত হচ্ছে। ব্রাজিল তার ছন্দ খুঁজে পাচ্ছে।

৫. তুরস্ক

তুরস্ক এক অদ্ভুত দেশ। ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগস্থলে এর অনন্য অবস্থান। শত শত বছর ধরে এটি সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখন এটি ২১ শতকের একটি ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছে। তুরস্ক বসফরাস প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করে, যা বৈশ্বিক শক্তি এবং শস্য পরিবহনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বটলনেক। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য এবং পূর্বাঞ্চলীয় মধ্যস্থতাকারী উভয় ভূমিকাই পালন করে। প্রায়শই মার্কিন-রাশিয়া উত্তেজনা বা ইইউ-মধ্যপ্রাচ্যের বিরোধের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। এটা আঙ্কারাকে একটি অনন্য সুবিধা দিয়েছে, যা খুব কম দেশেরই আছে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তুরস্ক দ্রুত বৈচিত্র্য আনছে। বাড়াচ্ছে প্রতিরক্ষা রপ্তানি বাড়াচ্ছে। ড্রোন শিল্প সমৃদ্ধ করছে। তুর্কি নির্মাণ সংস্থাগুলো আফ্রিকা, উপসাগরীয় অঞ্চল এবং মধ্য এশিয়া জুড়ে শহর তৈরি করছে।

মুদ্রার অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি ও রাজনৈতিক উত্তেজনা–এসব নিয়ে তুরস্কে উত্তেজনা আছে। তবে এর দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হলো স্বাধীনতা— কৃষ্ণ সাগরের গ্যাসের মাধ্যমে জ্বালানি স্বাধীনতা, প্রতিরক্ষা স্বাধীনতা এবং পররাষ্ট্র নীতিতে স্বাধীনতা। তুরস্কের টিভি নাটক, রান্না ও ইতিহাস এটিকে একটি সফট পাওয়ার জায়েন্ট বানিয়েছে। বিশেষ করে ইসলামিক বিশ্ব, মধ্য এশিয়া এবং বলকান জুড়ে। একটি বহুমেরুত বিশ্বে তুরস্কের সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে কোনো পক্ষ না নেওয়া। একটি বিভক্ত বিশ্বে সেতু হতে পারাটা সম্ভবত সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হয়ে উঠবে।

৪. ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্র। ২৮ কোটিরও বেশি মানুষ, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ–এসব নিয়ে, ইন্দোনেশিয়া আর শান্ত আঞ্চলিক খেলোয়াড় থাকতে আগ্রহী নয়। তাই বৈশ্বিক মঞ্চে পা রাখছে। ভূ-কৌশলগতভাবে ইন্দোনেশিয়া মালাক্কা প্রণালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের ওপর অবস্থিত, যা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত বাণিজ্য পথগুলোর মধ্যে একটি। এটি এশিয়ার অর্থনৈতিক ধমনীতে প্রবেশাধিকার পাওয়ার পাসপোর্ট।

অর্থনৈতিকভাবে ইন্দোনেশিয়া সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকার বড় আকারে অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করছে–হাইওয়ে, বন্দর, এমনকি একটি সম্পূর্ণ নতুন রাজধানী শহর নুসানতারা, যার লক্ষ্য ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ এবং উদ্ভাবন বাড়ান। এটি গ্রিন ইকোনমিতেও বড় বাজি ধরছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নিকেল মজুদ থেকে ইভি ব্যাটারি উৎপাদন থেকে শুরু করে বন পুনরুদ্ধার এবং টেকসই পাম তেল পর্যন্ত।

রাজনৈতিকভাবে তারা স্বাধীনতা বজায় রাখছে। পশ্চিমা দেশ ও চীন–উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রেখে তার নিজস্ব স্বাধীন ও সক্রিয় পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে। অন্যান্য দেশগুলো যখন বিচ্ছেদ বা মেরুকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ইন্দোনেশিয়া তখন নীরবে আসিয়ান, জি২০ কূটনীতি, ব্রিকস, এবং দক্ষিণ-দক্ষিণ অংশীদারিত্বের মাধ্যমে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে।

ইন্দোনেশিয়া ১৭ হাজারেরও বেশি দ্বীপ এবং ৭০০টি ভাষার এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এর হালাল অর্থনীতি, ইসলামিক ফ্যাশন এবং ডিজিটাল স্টার্টআপগুলো মুসলিম বিশ্বে তাদেরকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া নিজেকে নির্মাণের মধ্যে আছে। আছে ভবিষ্যৎ বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জনে।

৩. আমেরিকা

আমেরিকার ক্ষমতা বা দাপট নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবুও তারা বিশ্বের সবচেয়ে সুষম ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে টিকে আছে। অর্থনৈতিকভাবে এটি উদ্ভাবন, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, এআই, বায়োটেকনোলজি এবং বিনোদনে নেতৃত্ব দেয়। ন্যাটো ও কোয়াডের মতো জোট এবং প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনী পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী। এর প্রতিরক্ষা ব্যয় এতটাই যে তা এরপরের ১০টি দেশের সম্মিলিত ব্যয়ের চেয়ে বেশি। তবে শুধু হার্ডওয়্যার নয়, আমেরিকার শক্তি এর অভিযোজন ক্ষমতায় নিহিত।

শিক্ষাগত দিক দিয়ে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমেরিকার। আর্থিকভাবে ডলার এখনো বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে রয়ে গেছে, যা আমেরিকাকে বিশ্বব্যাপী মন্দার সময়েও অর্থনৈতিক শক্তি দেয়। আমেরিকার সত্যিকারের সুপারপাওয়ার। নানা গোলমাল, বিশৃঙ্খলা থেকে সে বারবার নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে।

২. ভারত

ভারত নীরবে উঠছে না। এটি সুপারপাওয়ারের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হবে। জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৫০ কোটি। প্রধান অর্থনীতিগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম গড় বয়স থাকবে। তবে শুধু তারুণ্যই ভারতের উত্থানকে সংজ্ঞায়িত করে না। দেশটি দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৯০ কোটিরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মোবাইল পেমেন্ট, দূরবর্তী শিক্ষা এবং ই-কমার্স দৈনন্দিন জীবনকে নতুন করে সাজাচ্ছে।

ভারত প্রযুক্তি পরিষেবা এবং স্টার্টআপের জন্য একটি বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে, যার ফলে এটি ‘বিশ্বের ব্যাক অফিস’ এবং ‘ফ্রন্ট এন্ড’-এর ডাকনাম অর্জন করেছে। এর অর্থনীতি আইটি এবং ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে শুরু করে নবায়নযোগ্য শক্তি, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এবং মহাকাশ অনুসন্ধান পর্যন্ত নানা বিচিত্র বিষয় রয়েছে। ভারতের মহাকাশ সংস্থা ইসরো (ISRO) ইতিমধ্যেই চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান পাঠিয়েছে এবং স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা রয়েছে।

অবশ্য বিশ্ব মঞ্চে ভারত একটি সরু কূটনৈতিক দড়ি ধরে হাঁটছে। আসেরিকা ও রাশিয়া–উভয়ের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। আফ্রিকা, ইন্দো-প্যাসিফিক এবং এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও সক্রিয়ভাবে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। এটি ব্রিকস, জি-২০ এবং অন্যান্য ফোরামে একটি নতুন বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য চাপ সৃষ্টিকারী একটি অগ্রণী কণ্ঠস্বর। ভারত শুধু বৈশ্বিক খেলায় অংশ নিচ্ছে না। এটি তারুণ্য, প্রযুক্তি ও বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষার দ্বারা চালিত হয়ে নিয়মগুলো নতুন করে লিখছে।

১. চীন

চীন এক বিস্ময়। গত দুই দশকে নিজেদের বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে। অর্থনৈতিক শক্তিতে এখন দ্বিতীয়। ২০৩০ সালের মধ্যে তারা শীর্ষস্থানে চলে আসতে পারে। তারা এরই মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়েছে। দেশে ও দেশের বাইরে অবকাঠামো খাতের মেগা প্রকল্প, এআই স্থাপন এবং সবুজ শক্তি উৎপাদনে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ সড়ক, বন্দর এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর মাধ্যমে ১৪০টিরও বেশি দেশকে যুক্ত করেছে। তারা এখন বিশ্বব্যাপী প্রভাবের মানচিত্রকে নতুনভাবে আঁকছে।

হুয়াওয়ে, টেনসেন্ট এবং BYD-এর মতো এর প্রযুক্তি জায়ান্টগুলো 5G নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি পর্যন্ত সবকিছুই তৈরি করছে। এদিকে সাপ্লাই চেইনে চীনের আধিপত্য, বিশেষ করে বিরল মৃত্তিকা খনিজ বা রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট এবং সোলার প্যানেল তৈরির দক্ষতা–নতুন এক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনীগুলোর মধ্যে একটি চীনের। দক্ষিণ চীন সাগরে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে দুনিয়াকে অন্য বার্তা দিচ্ছে চীন। এর সাথে যোগ হয়েছে, মহাকাশ নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা। মহাকাশ স্টেশন, চাঁদে ঘাঁটি এবং আন্তগ্রহ মিশন, যা সবই ২১ শতকের সুপারপাওয়ার হিসেবে চীনের ভূমিকাকে সুদৃঢ় করছে।

তবে চীনের উত্থান বাধাহীন নয়। ২০১১ সাল থেকে আমেরিকা সাথে চীনের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ এবং অভ্যন্তরীণ নজরদারি নীতিগুলো টানাপোড়েন চলছে। এই টানাপোড়েন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তারপরেও ভবিষ্যৎ যদি একটি নকশা হয়, তাহলে চীন ইতিমধ্যেই সেখানে সিমেন্ট ঢালছে।

এতক্ষণ আমরা ১০টি দেশের কথা বললাম। এর বাইরে অন্যরা ভালো করতে পারে। সেই তালিকায় আছে যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা। বিশ্ব যে বদলাচ্ছে, এটা যারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বদলের সঙ্গী হয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে উপযুক্ত করছে। আমাদের কী সেই প্রস্তুতি আছে?

সম্পর্কিত