২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী দেড় বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি এক জটিল সমীকরণের মুখোমুখি। ২০২৫ সালের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, একসময়ের ‘স্বৈরাচারী শাসনের’ পতনের পর যে গণতান্ত্রিক আশার সঞ্চার হয়েছিল, তা এখন বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস বলছে, বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে রয়েছে। তবে এই পথটা ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস বলছে, বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের গতিপথ দুটি পথের মাঝখানে অনিশ্চিতভাবে দুলছে। একদিকে, অনেক দেশে গণতন্ত্র ক্রমেই পেছনের দিকে হাঁটছে। অন্যদিকে, কিছু দেশ সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধার ও নবায়নের পথে যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে পথটা কঠিন।
২০২৫ সালের শেষে এসে বিশ্বের দিকে তাকালে দশটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে দুই ধরনের প্রবণতাই দেখা যায় বলে এক বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধে উল্লেখ করেছে কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস। হার্ভে ভি. ফাইনবার্গ চেয়ার ফর ডেমোক্রেসি স্টাডিজ ও ডেমোক্রেসি, কনফ্লিক্ট, অ্যান্ড গভর্নেন্স প্রোগ্রামের পরিচালক থমাস ক্যারোথার্স এবং ডেমোক্রেসি, কনফ্লিক্ট, অ্যান্ড গভর্নেন্স প্রোগ্রামের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাকেনজি ক্যারিয়ার এই নিবন্ধ লেখেন।
তারা বলছেন, প্রথম গ্রুপে থাকা পাঁচটি দেশের গণতন্ত্র নতুন গুরুতর চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গণতন্ত্র ক্ষয়ের উদ্বেগজনক লক্ষণ।
দ্বিতীয় গ্রুপের পাঁচটি দেশ সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য স্বৈরাচারবিরোধী বা গণতন্ত্রপন্থী উত্তাল পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে অর্থবহ রাজনৈতিক সুযোগ তৈরি হয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
এই দশটি দেশের অবস্থাই ঠিক করে দেবে, আগামী বছরে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র কতটা পিছু হটবে বা এগিয়ে যাবে।
এ তালিকায় বাংলাদেশকে রেখেছে কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস। আর রয়েছে পরের ৫ দেশের তালিকায়। তারা বলছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সরকারি চাকরির কোটা পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এটি পরে দেশব্যাপী গণবিক্ষোভে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বিক্ষোভে ১ হাজার ৪০০ মানুষ মারা যায়।
এরপর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, যার প্রধান হিসেবে রয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস। এই সরকারে সামরিক বাহিনীর সমর্থন রয়েছে।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন এক বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অগ্রগতি অধরাই রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখিয়েছে। রাজনীতি এখনো গভীরভাবে মেরুকরণ হয়ে আছে এবং বিরোধী পক্ষগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে শক্তিশালী ভূমিকা ধরে রেখেছে।
বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন বলছে, সামরিক বাহিনী এখনো উল্লেখযোগ্য ক্ষমতার অধিকারী। নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক রাজনৈতিক সহিংসতা এবং বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো এখনো উদ্বেগের কারণ হিসেবে রয়ে গেছে। দুর্নীতি ও দুর্বল অর্থনীতি তরুণদের প্রধান অভিযোগ হিসেবে রয়ে গেছে। এ কারণে তারা একের পর এক দাবিতে রাস্তায় নামছে।
এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধিতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস। তারা বলছে, গত মে মাসে ইউনূস প্রশাসন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণে নিষিদ্ধ করে। এই সিদ্ধান্ত নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি এবং হাসিনাকে নির্বাচনী বয়কটের ডাক দিতে উদ্বুদ্ধ করে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ছাত্র বিক্ষোভের ওপর সহিংস দমন-পীড়নের দায়ে হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ আরও সরব বলেই মনে করা হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬ সালের নির্বাচনের বিজয়ীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যাতে একটি নতুন সরকার গঠিত হতে পারে। অনেকে আশাবাদী যে, এই নির্বাচিত সরকার বাংলাদেশের জনগণের দাবিকৃত সংস্কারগুলো আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে।
তবে আগামী নির্বাচনের গণতান্ত্রিক প্রকৃতি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ আন্দোলন এবং পরবর্তীতে নতুন সরকারের গণতন্ত্রপন্থী সংস্কারের কার্যকারিতা বাংলাদেশের সম্ভাব্য পুনঃগণতন্ত্রীকরণের পথে কঠিন পরীক্ষা হবে।
মোদ্দাকথা, ২০২৫ সাল শেষে বাংলাদেশের গণতন্ত্র একটি দ্বিধাগ্রস্ত পথরেখায় দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বপ্ন, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পুরোনো চক্র। ২০২৬ সালের নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হয় এবং নির্বাচিত সরকার জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সংস্কার করতে পারে কি না–তার ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ভাগ্য।