অর্ণব সান্যাল

ফ্যাসিবাদ বললেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সবাই বিবেচনা করে একটি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থাকে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও। এবং এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এটিই ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক বন্দোবস্তকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। মজার বিষয় হলো, ফ্যাসিবাদ বলতেই যে হিটলার ও মুসোলিনির কথা আমাদের মাথায় খেলা করে, সেই সময়কার জার্মানি ও ইতালি ছাড়া আরও কিছু দেশেও এই ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পত্তন হয়েছিল। সেসব দেশের মধ্যে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকাও ছিল!
মার্কিন সংস্থা দ্য লাইব্রেরি অব ইকনোমিকস অ্যান্ড লিবার্টি বলছে, ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আসলে সমাজতান্ত্রিক, যার পুঁজিবাদী মোড়ক আছে। তবে ফ্যাসিবাদের অর্থনীতি বেশ জটিল। ফ্যাসিস্ট সরকারগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে, জাতীয়ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা। হিটলার ও মুসোলিনির প্রবর্তিত ফ্যাসিবাদ এই লক্ষ্যের বিষয়টিকেই প্রচার করেছিল। ১৯২০ ও ১৯৩০–এর দশকে ফ্যাসিস্ট নেতারা জাতীয় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টিকে বুর্জোয়া শ্রেণি, মুনাফাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ ও বিপ্লবী মার্ক্সবাদের মাঝামাঝি একটি অবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের ইমেরিটাস অধ্যাপক রবার্ট প্যাক্সটন মনে করেন, ফ্যাসিবাদের একটি উপাদান হলো পুঁজিপতি ও রক্ষণশীল অভিজাতদের সঙ্গে জোটবদ্ধতা। এমনকি ফ্যাসিস্টরা যখন নিজেদের উগ্রবাদী ধ্যান–ধারণা নিয়ে সোচ্চার হয়ে মাঠে নামে, তখনো ব্যক্তিগত সম্পদের সুরক্ষা দেওয়ার চিন্তা ভালোভাবেই তাদের মাথায় থাকে। এই জোট খুবই অদ্ভুত বলেও মন্তব্য প্যাক্সটনের। তাঁর মতে, রক্ষণশীলেরা চান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রভাব ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে থাকা নিয়ন্ত্রণ যেন টিকে থাকে। অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট বিপ্লবীরা প্রয়োজনে সামাজিক প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি ভেঙেচুরে দিতেও রাজি থাকে, যদি তাতে জাতীয় ক্ষমতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গড়ে ওঠে একই ভাবধারার একটি কার্টেল। এটিই এক পর্যায়ে ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোয় সকল সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। এক ধরনের একচেটিয়া ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলা হয়। অর্থ ও বাণিজ্যের বিভিন্ন বিষয় ও কৃষিসংক্রান্ত নির্দেশনাসহ উৎপাদন ও বিপণনের নানা নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে থাকে এই কার্টেল। এটিই হয়ে দাঁড়ায় সর্বময় কর্তা। মূলত রাষ্ট্রের ক্ষমতা সুসংহত করতেই এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এর পাশাপাশি রক্ষণশীল অভিজাত ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত সম্পদ ভোগ ও তা বৃদ্ধি করার সুযোগও দেওয়া হয়। যদিও পারিশ্রমিক বা মজুরির হার ও মাত্রা কমিয়ে আনার চেষ্টা চলে ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। শ্রমিকদের কম বেতন দিয়ে বাড়তি হিসেবে জাতীয় মর্যাদা গেলানোর প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।
ফ্যাসিবাদী অর্থনীতি নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন গবেষক ও সম্পাদক শেলডন রিচম্যান। মার্কিন ম্যাগাজিন দ্য ফ্রিম্যান–এর সম্পাদক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন ১৫ বছরেরও বেশি সময়। বর্তমানেও বিভিন্ন সংস্থায় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন শেলডন। তার কথায়, সমাজতন্ত্র যেখানে সমাজে থাকা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোর ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় রাষ্ট্রকাঠামোর মাধ্যমে, সেখানে ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ওই নিয়ন্ত্রণই পরোক্ষভাবে চাওয়া হয় ব্যক্তিসম্পদের মালিকদের ওপর প্রভাব খাটানোর মাধ্যমে। সমাজতন্ত্র সকল সম্পদকে প্রত্যক্ষভাবে জাতীয়করণ করতে চায়, অন্যদিকে ফ্যাসিবাদ চায় পরোক্ষভাবে। এর জন্য সম্পদের মালিকদের মধ্যে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা জারি থাকে এবং তাদের ‘জাতীয় স্বার্থ’ বিবেচনা করে কাজ সম্পাদনে উৎসাহ দেওয়া হয়। আর এই জাতীয় স্বার্থের হিসাব মেলাতে গিয়েই এসব সম্পদের ওপর ফ্যাসিবাদের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। সমাজতন্ত্রে সরাসরি আগের সব বাজার সম্পর্ক বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদ আগের ব্যবস্থার মোড়ক বজায় রেখে ভেতরে ভেতরে সকল অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেয়। ফ্যাসিবাদী অর্থনীতিতে মুদ্রাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ফ্যাসিস্ট কাঠামোর হাতে চলে যায় এবং সব ধরনের মূল্য ও মজুরি রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত হতে থাকে। এভাবে পুরো বাজারব্যবস্থাকেই বিকৃত করে ফেলে ফ্যাসিবাদ। উদ্যোক্তা হওয়ার পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভোক্তাদের চাহিদা, পণ্যের যোগান—এসব আর বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ফ্যাসিবাদের অধীনে, বরং রাষ্ট্রীয় মন্ত্রণালয়গুলো ঠিক করে দেয় কী উৎপন্ন হবে এবং কীভাবে হবে।
তবে তাই বলে ফ্যাসিবাদী অর্থনীতিকে হস্তক্ষেপবাদী বা মিশ্র অর্থনীতি বলার সুযোগ নেই। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই দুটোর ক্ষেত্রে বাজার প্রক্রিয়াকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় কেবল। কিন্তু ফ্যাসিবাদে এই প্রক্রিয়াকে একেবারেই নির্মূল করা হয়।
শেলডন রিচম্যানের মতে, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় সরকারের অনুমতি ব্যতীত কোনো ধরনের অর্থনৈতিক কর্মপ্রক্রিয়া চালানো যায় না। এমনকি ভোক্তারা কোন মাত্রায় ভোগ করবেন, সেটিও রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে নাগরিকের অতিরিক্ত আয়কে ঋণ বা কর হিসেবে সরকারের কাছে ন্যস্ত করতে হয়। উৎপাদকদের ওপর নানামাত্রিক বিধিনিষেধ ও নিয়মকানুন আরোপ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই উৎসাহিত হয় বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো, তারা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে রপ্তানি বাড়াতে চায়। কিন্তু ফ্যাসিবাদ আবার অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার মন্ত্র সর্বদা জপতে থাকে বলে, সংরক্ষণবাদও জারি থাকে ভালোভাবেই। এই নীতিতে আমদানি নিষিদ্ধ করা হয় বা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে দেশের সম্পদ বাড়াতে এর আয়তন বাড়ানোই একমাত্র পথ হিসেবে উদ্ভূত হয়। জার্মানি ও ইতালিতেও এমনটা হয়েছে। এভাবে উদারবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজনের সঙ্গে পুরোপুরি অসঙ্গত অবস্থান নেয় ফ্যাসিবাদ। ফলে বাস্তব রূপ পায় করপোরেটিজম।
এত কিছুর পরও জনপ্রিয়তা লাভের চেষ্টা থাকেই ফ্যাসিবাদের। আর তার জন্য কর্মসংস্থানের পরিমাণ বাড়ানো ও জনঅসন্তোষ কমানোর লক্ষ্যে ফ্যাসিস্ট সরকার কিছু জনমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নের তোড়জোর করে। এতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হয় মাত্রাতিরিক্ত কর আরোপ, ঋণ করা বা অর্থ ছাপিয়ে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রকল্প হয় অবকাঠামোগত। নানা ধরনের রাস্তা, ভবন, সেতু ও স্টেডিয়াম বানানো হয়। তবে সবচেয়ে বড় প্রকল্পগুলো সাধারণত সামরিক বাহিনী সংক্রান্ত হয়ে থাকে।
তবে কি ফ্যাসিবাদের অর্থনীতি কম্যুনিজমের শত্রু, আর পুঁজিবাদের বন্ধু?
এ বিষয়ে বেনিতো মুসোলিনি নিজের আত্মজীবনীতে কিছু বক্তব্য দিয়েছিলেন। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত সেই আত্মজীবনীতে উদারবাদী পুঁজিবাদ ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য টেনেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের একজন নাগরিক কখনো স্বার্থপর ব্যক্তির মতো থাকেন না এবং সমষ্টির পক্ষে থাকা কোনো আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার তার থাকে না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র তার জনগণকে এবং তাদের সম্ভাবনাকে উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করে এবং এটিকে তাদের দায়িত্ব হিসেবেই পূর্ণ করার কথা বলে।’

অর্থাৎ, এর মধ্যে প্রবল জাতীয়তাবাদী ধারণার উপস্থিতি দৃশ্যমান। এর মধ্য দিয়ে কর্মক্ষম জনতাকে কাজ করতে বলা হয় দায়িত্ব হিসেবে। যেন এই কাজ করাটা মজুরির জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রের জন্য তার পবিত্র দায়িত্ব। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কম্যুনিজমের মতোই ফ্যাসিজমেও প্রত্যেক নাগরিককে এক–একজন বাধ্যগত কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভাড়াটিয়া হিসেবে মনে করা হয়। একইসাথে যেকোনো ধরনের বিরোধিতা, এমনকি তা শান্তিপূর্ণ হলেও, সেটিকে শক্তিপ্রয়োগে দমন করার বিশেষাধিকার দেওয়া হয় একমাত্র রাষ্ট্রকে।
মুসোলিনির ইতালির মতো হিটলারের জার্মানিতেও ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। সেখানেও একই ধরনের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। হিটলার নিজেই বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রকে অবশ্যই তত্ত্বাবধান জারি রাখতে হবে এবং সম্পদের মালিকদের প্রত্যেককে এটি মাথায় রাখতে হবে যে, তারা রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগকৃত। দেশের মানুষদের স্বার্থের বিপক্ষে নিজের সম্পদের ব্যবহার যেন না হয়, সেটি নিশ্চিত করা প্রত্যেক মালিকের দায়িত্ব। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সম্পদের মালিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ সব সময়ই ধরে রাখবে থার্ড রাইখ।’
এ ছাড়া জার্মানিতে করপোরেশনগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ন্যাশনাল কাউন্সিল অব করপোরেশনস। রাষ্ট্রীয় সংস্থাই এ ক্ষেত্রে সব ধরনের সিদ্ধান্ত নিত। অন্যদিকে নাৎসি পার্টির একটি অঙ্গসংগঠন, দ্য লেবার ফ্রন্ট শ্রমবিষয়ক সব ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করত। এমনকি মজুরি নির্ধারণ ও কে কোন কাজ করবে, সেটিও ঠিক করে দেওয়া হতো।
সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন শুরুর আগে মুসোলিনি ও হিটলারের এ ধরনের ফ্যাসিবাদী অর্থনীতির প্রশংসায় ছিলেন আমেরিকা–ইউরোপের নেতারাও। আমেরিকা–ইউরোপের কিছু দেশেও ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কিছু কিছু চালু হয়েছিল। খোদ আমেরিকাতেই এ ঘরানার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে মার্কিন মুলুকের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ‘নিউ ডিল’ নামের যে নীতি আরোপের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, অনেক বিশ্লেষকই সেটিকে ফ্যাসিস্ট কাঠামোর অনুরূপ বলে মনে করে থাকেন। তাদের মতে, ফ্যাসিস্ট করপোরেট স্টেট হিসেবে আমেরিকার রূপান্তরের শুরু ছিল সেটাই। এ নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। রুজভেল্টের শত্রু হওয়ার আগে বেনিতো মুসোলিনি কিন্তু ‘নিউ ডিল’–এর বেশ প্রশংসাই করেছিলেন, সেটিকে ‘সাহসী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। পাল্টা হিসেবে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টও মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন যে, মুসোলিনি ইতালির পুনর্জন্মের জন্য সৎভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি ইতালির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়েও বেশ আশাবাদী ছিলেন রুজভেল্ট। তবে এর কিছুকাল পরেই ইতালি ও জার্মানি ফ্যাসিবাদের সম্প্রসারণবাদী রূপে নিজেদের রাঙানোয় সেই ঘনিষ্ঠতা রূপান্তরিত হয় ঘোর শত্রুতায়।
আমেরিকার মেরিল্যান্ডের লোয়োলা ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন থমাস জে ডিলরেনজো। তার মতে, ফ্যাসিবাদের অর্থনীতি হলো করপোরেটিজম। ১৯২০ ও ১৯৩০–এর দশকে এটি যেমন ইতালি ও জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তেমনি ওই সময়ে এর একটি রূপ আমেরিকাতেও আবির্ভূত হয়েছিল। তখন মার্কিন মুলুকে একে বলা হতো, ‘পরিকল্পিত পুঁজিবাদ’। এই ফ্যাসিবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য এখনো আমেরিকাতে বর্তমান আছে ভালোভাবেই এবং এর প্রভাব ক্রমশ বাড়বে বলেই মনে করেন থমাস ডিলরেনজো। তবে যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদ শব্দের ব্যবহার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, সেহেতু একে ভিন্ন মোড়কে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে এই ব্যবস্থাটিই বিশ্বব্যাপী বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এ ক্ষেত্রে দোহাই হিসেবে বলা হতো যে—আর যাই হোক, মুসোলিনি ঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়ার ব্যবস্থা তো করেছিলেন!
অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে যে ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুণগ্রাহী ছিল এবং আছেও। এই ব্যবস্থাটি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন থমাস জে ডিলরেনজো। তার কথায়, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে ফ্যাসিবাদ আসলে একটি হস্তক্ষেপবাদী শিল্পনীতি। এর প্রবল ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থাকে, সুরক্ষাবাদী মনোভাব দেখায় এবং এটি এমন এক আদর্শের কথা বলে যা ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের অধীন বা আজ্ঞাবহ হতে বাধ্য করে। নাগরিকদের প্রতি ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক দর্শনের মূল নির্দেশনা হলো—‘রাষ্ট্র আপনার জন্য কী করতে পারে, সেটি নিয়ে কথা নয়। বরং আপনি নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের জন্য কী করতে পারেন, তা নিয়ে ভাবতে হবে সব সময়।’

এভাবে ফ্যাসিবাদে নাগরিককে পুরোপুরি আজ্ঞাবহ বানানোর চেষ্টা চলে এবং উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সম্পদের বণ্টনের নিয়ন্ত্রণও চলে যায় কিছু মুষ্টিমেয় অভিজাতদের হাতে। এ বিষয়ে মার্কিন ফ্যাসিস্ট অর্থনীতিবিদ লরেন্স ডেনিস বলেছিলেন, মুক্তবাজার ব্যবস্থায় ভোক্তা ও বিক্রেতার সার্বভৌম অবস্থানের যে নীতি উদারবাদে থাকে, সেটি ফ্যাসিবাদ সমর্থন করে না। বরং বাজার স্বাধীনতা ও প্রতিযোগিতামূলক উপায়ে যত খুশি লাভ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে কেবলই একটি অভিজাত গোষ্ঠীর হাতে।
থমাস জে ডিলরেনজো তাই মনে করেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, মুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে ধ্বংস করতে চায় ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কারণ, কেবলমাত্র এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করা গেলেই ফ্যাসিবাদ যে ধরনের একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গঠন করতে চায়, সেটি সম্ভব হয়।
এবার তবে সারসংক্ষেপ বানানো যাক। ওপরের আলোচনা অনুযায়ী এতটুকু বোঝা গেছে যে, একটি ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র—এই দুইয়ের মিশেল থাকে। দুটি ব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদানই ফ্যাসিবাদের অর্থনীতিতে স্থান পায়। জাতীয় স্বনির্ভরতা বা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে লাভ করার বিষয়টিতে বাধা দেওয়া হয় না, বরং গুরুত্ব দেওয়া হয়। আবার বিভিন্ন করপোরেশনগুলোতে সরকারি প্রণোদনা বাড়ানোর কথা বলা হয়। ফ্যাসিবাদী অর্থনীতিতে ব্যক্তি ও জাতীয় মালিকানার একটি মিশ্রণকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ক্রোনিজম বা ফ্যাসিবাদের ঘনিষ্ঠ অভিজাতদের নিয়ে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী গড়ে তোলা হয় এবং সেটিই অর্থনীতি সংক্রান্ত সর্বেসর্বা হয়ে দাঁড়ায়। স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত পরিলক্ষিত হয়। এবং ব্যক্তিমালিকানায় মুনাফা অর্জনকে উৎসাহিত করা হলেও, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষাকে। এভাবেই গড়ে ওঠে ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।

ফ্যাসিবাদ বললেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সবাই বিবেচনা করে একটি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থাকে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও। এবং এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এটিই ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক বন্দোবস্তকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। মজার বিষয় হলো, ফ্যাসিবাদ বলতেই যে হিটলার ও মুসোলিনির কথা আমাদের মাথায় খেলা করে, সেই সময়কার জার্মানি ও ইতালি ছাড়া আরও কিছু দেশেও এই ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পত্তন হয়েছিল। সেসব দেশের মধ্যে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকাও ছিল!
মার্কিন সংস্থা দ্য লাইব্রেরি অব ইকনোমিকস অ্যান্ড লিবার্টি বলছে, ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আসলে সমাজতান্ত্রিক, যার পুঁজিবাদী মোড়ক আছে। তবে ফ্যাসিবাদের অর্থনীতি বেশ জটিল। ফ্যাসিস্ট সরকারগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে, জাতীয়ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা। হিটলার ও মুসোলিনির প্রবর্তিত ফ্যাসিবাদ এই লক্ষ্যের বিষয়টিকেই প্রচার করেছিল। ১৯২০ ও ১৯৩০–এর দশকে ফ্যাসিস্ট নেতারা জাতীয় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টিকে বুর্জোয়া শ্রেণি, মুনাফাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ ও বিপ্লবী মার্ক্সবাদের মাঝামাঝি একটি অবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের ইমেরিটাস অধ্যাপক রবার্ট প্যাক্সটন মনে করেন, ফ্যাসিবাদের একটি উপাদান হলো পুঁজিপতি ও রক্ষণশীল অভিজাতদের সঙ্গে জোটবদ্ধতা। এমনকি ফ্যাসিস্টরা যখন নিজেদের উগ্রবাদী ধ্যান–ধারণা নিয়ে সোচ্চার হয়ে মাঠে নামে, তখনো ব্যক্তিগত সম্পদের সুরক্ষা দেওয়ার চিন্তা ভালোভাবেই তাদের মাথায় থাকে। এই জোট খুবই অদ্ভুত বলেও মন্তব্য প্যাক্সটনের। তাঁর মতে, রক্ষণশীলেরা চান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রভাব ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে থাকা নিয়ন্ত্রণ যেন টিকে থাকে। অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট বিপ্লবীরা প্রয়োজনে সামাজিক প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি ভেঙেচুরে দিতেও রাজি থাকে, যদি তাতে জাতীয় ক্ষমতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গড়ে ওঠে একই ভাবধারার একটি কার্টেল। এটিই এক পর্যায়ে ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোয় সকল সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। এক ধরনের একচেটিয়া ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলা হয়। অর্থ ও বাণিজ্যের বিভিন্ন বিষয় ও কৃষিসংক্রান্ত নির্দেশনাসহ উৎপাদন ও বিপণনের নানা নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে থাকে এই কার্টেল। এটিই হয়ে দাঁড়ায় সর্বময় কর্তা। মূলত রাষ্ট্রের ক্ষমতা সুসংহত করতেই এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এর পাশাপাশি রক্ষণশীল অভিজাত ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত সম্পদ ভোগ ও তা বৃদ্ধি করার সুযোগও দেওয়া হয়। যদিও পারিশ্রমিক বা মজুরির হার ও মাত্রা কমিয়ে আনার চেষ্টা চলে ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। শ্রমিকদের কম বেতন দিয়ে বাড়তি হিসেবে জাতীয় মর্যাদা গেলানোর প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।
ফ্যাসিবাদী অর্থনীতি নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন গবেষক ও সম্পাদক শেলডন রিচম্যান। মার্কিন ম্যাগাজিন দ্য ফ্রিম্যান–এর সম্পাদক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন ১৫ বছরেরও বেশি সময়। বর্তমানেও বিভিন্ন সংস্থায় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন শেলডন। তার কথায়, সমাজতন্ত্র যেখানে সমাজে থাকা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোর ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় রাষ্ট্রকাঠামোর মাধ্যমে, সেখানে ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ওই নিয়ন্ত্রণই পরোক্ষভাবে চাওয়া হয় ব্যক্তিসম্পদের মালিকদের ওপর প্রভাব খাটানোর মাধ্যমে। সমাজতন্ত্র সকল সম্পদকে প্রত্যক্ষভাবে জাতীয়করণ করতে চায়, অন্যদিকে ফ্যাসিবাদ চায় পরোক্ষভাবে। এর জন্য সম্পদের মালিকদের মধ্যে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা জারি থাকে এবং তাদের ‘জাতীয় স্বার্থ’ বিবেচনা করে কাজ সম্পাদনে উৎসাহ দেওয়া হয়। আর এই জাতীয় স্বার্থের হিসাব মেলাতে গিয়েই এসব সম্পদের ওপর ফ্যাসিবাদের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। সমাজতন্ত্রে সরাসরি আগের সব বাজার সম্পর্ক বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদ আগের ব্যবস্থার মোড়ক বজায় রেখে ভেতরে ভেতরে সকল অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেয়। ফ্যাসিবাদী অর্থনীতিতে মুদ্রাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ফ্যাসিস্ট কাঠামোর হাতে চলে যায় এবং সব ধরনের মূল্য ও মজুরি রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত হতে থাকে। এভাবে পুরো বাজারব্যবস্থাকেই বিকৃত করে ফেলে ফ্যাসিবাদ। উদ্যোক্তা হওয়ার পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভোক্তাদের চাহিদা, পণ্যের যোগান—এসব আর বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ফ্যাসিবাদের অধীনে, বরং রাষ্ট্রীয় মন্ত্রণালয়গুলো ঠিক করে দেয় কী উৎপন্ন হবে এবং কীভাবে হবে।
তবে তাই বলে ফ্যাসিবাদী অর্থনীতিকে হস্তক্ষেপবাদী বা মিশ্র অর্থনীতি বলার সুযোগ নেই। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই দুটোর ক্ষেত্রে বাজার প্রক্রিয়াকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় কেবল। কিন্তু ফ্যাসিবাদে এই প্রক্রিয়াকে একেবারেই নির্মূল করা হয়।
শেলডন রিচম্যানের মতে, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় সরকারের অনুমতি ব্যতীত কোনো ধরনের অর্থনৈতিক কর্মপ্রক্রিয়া চালানো যায় না। এমনকি ভোক্তারা কোন মাত্রায় ভোগ করবেন, সেটিও রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে নাগরিকের অতিরিক্ত আয়কে ঋণ বা কর হিসেবে সরকারের কাছে ন্যস্ত করতে হয়। উৎপাদকদের ওপর নানামাত্রিক বিধিনিষেধ ও নিয়মকানুন আরোপ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই উৎসাহিত হয় বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো, তারা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে রপ্তানি বাড়াতে চায়। কিন্তু ফ্যাসিবাদ আবার অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার মন্ত্র সর্বদা জপতে থাকে বলে, সংরক্ষণবাদও জারি থাকে ভালোভাবেই। এই নীতিতে আমদানি নিষিদ্ধ করা হয় বা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে দেশের সম্পদ বাড়াতে এর আয়তন বাড়ানোই একমাত্র পথ হিসেবে উদ্ভূত হয়। জার্মানি ও ইতালিতেও এমনটা হয়েছে। এভাবে উদারবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজনের সঙ্গে পুরোপুরি অসঙ্গত অবস্থান নেয় ফ্যাসিবাদ। ফলে বাস্তব রূপ পায় করপোরেটিজম।
এত কিছুর পরও জনপ্রিয়তা লাভের চেষ্টা থাকেই ফ্যাসিবাদের। আর তার জন্য কর্মসংস্থানের পরিমাণ বাড়ানো ও জনঅসন্তোষ কমানোর লক্ষ্যে ফ্যাসিস্ট সরকার কিছু জনমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নের তোড়জোর করে। এতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হয় মাত্রাতিরিক্ত কর আরোপ, ঋণ করা বা অর্থ ছাপিয়ে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রকল্প হয় অবকাঠামোগত। নানা ধরনের রাস্তা, ভবন, সেতু ও স্টেডিয়াম বানানো হয়। তবে সবচেয়ে বড় প্রকল্পগুলো সাধারণত সামরিক বাহিনী সংক্রান্ত হয়ে থাকে।
তবে কি ফ্যাসিবাদের অর্থনীতি কম্যুনিজমের শত্রু, আর পুঁজিবাদের বন্ধু?
এ বিষয়ে বেনিতো মুসোলিনি নিজের আত্মজীবনীতে কিছু বক্তব্য দিয়েছিলেন। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত সেই আত্মজীবনীতে উদারবাদী পুঁজিবাদ ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য টেনেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের একজন নাগরিক কখনো স্বার্থপর ব্যক্তির মতো থাকেন না এবং সমষ্টির পক্ষে থাকা কোনো আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার তার থাকে না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র তার জনগণকে এবং তাদের সম্ভাবনাকে উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করে এবং এটিকে তাদের দায়িত্ব হিসেবেই পূর্ণ করার কথা বলে।’

অর্থাৎ, এর মধ্যে প্রবল জাতীয়তাবাদী ধারণার উপস্থিতি দৃশ্যমান। এর মধ্য দিয়ে কর্মক্ষম জনতাকে কাজ করতে বলা হয় দায়িত্ব হিসেবে। যেন এই কাজ করাটা মজুরির জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রের জন্য তার পবিত্র দায়িত্ব। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কম্যুনিজমের মতোই ফ্যাসিজমেও প্রত্যেক নাগরিককে এক–একজন বাধ্যগত কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভাড়াটিয়া হিসেবে মনে করা হয়। একইসাথে যেকোনো ধরনের বিরোধিতা, এমনকি তা শান্তিপূর্ণ হলেও, সেটিকে শক্তিপ্রয়োগে দমন করার বিশেষাধিকার দেওয়া হয় একমাত্র রাষ্ট্রকে।
মুসোলিনির ইতালির মতো হিটলারের জার্মানিতেও ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। সেখানেও একই ধরনের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। হিটলার নিজেই বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রকে অবশ্যই তত্ত্বাবধান জারি রাখতে হবে এবং সম্পদের মালিকদের প্রত্যেককে এটি মাথায় রাখতে হবে যে, তারা রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগকৃত। দেশের মানুষদের স্বার্থের বিপক্ষে নিজের সম্পদের ব্যবহার যেন না হয়, সেটি নিশ্চিত করা প্রত্যেক মালিকের দায়িত্ব। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সম্পদের মালিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ সব সময়ই ধরে রাখবে থার্ড রাইখ।’
এ ছাড়া জার্মানিতে করপোরেশনগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ন্যাশনাল কাউন্সিল অব করপোরেশনস। রাষ্ট্রীয় সংস্থাই এ ক্ষেত্রে সব ধরনের সিদ্ধান্ত নিত। অন্যদিকে নাৎসি পার্টির একটি অঙ্গসংগঠন, দ্য লেবার ফ্রন্ট শ্রমবিষয়ক সব ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করত। এমনকি মজুরি নির্ধারণ ও কে কোন কাজ করবে, সেটিও ঠিক করে দেওয়া হতো।
সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন শুরুর আগে মুসোলিনি ও হিটলারের এ ধরনের ফ্যাসিবাদী অর্থনীতির প্রশংসায় ছিলেন আমেরিকা–ইউরোপের নেতারাও। আমেরিকা–ইউরোপের কিছু দেশেও ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কিছু কিছু চালু হয়েছিল। খোদ আমেরিকাতেই এ ঘরানার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে মার্কিন মুলুকের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ‘নিউ ডিল’ নামের যে নীতি আরোপের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, অনেক বিশ্লেষকই সেটিকে ফ্যাসিস্ট কাঠামোর অনুরূপ বলে মনে করে থাকেন। তাদের মতে, ফ্যাসিস্ট করপোরেট স্টেট হিসেবে আমেরিকার রূপান্তরের শুরু ছিল সেটাই। এ নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। রুজভেল্টের শত্রু হওয়ার আগে বেনিতো মুসোলিনি কিন্তু ‘নিউ ডিল’–এর বেশ প্রশংসাই করেছিলেন, সেটিকে ‘সাহসী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। পাল্টা হিসেবে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টও মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন যে, মুসোলিনি ইতালির পুনর্জন্মের জন্য সৎভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি ইতালির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়েও বেশ আশাবাদী ছিলেন রুজভেল্ট। তবে এর কিছুকাল পরেই ইতালি ও জার্মানি ফ্যাসিবাদের সম্প্রসারণবাদী রূপে নিজেদের রাঙানোয় সেই ঘনিষ্ঠতা রূপান্তরিত হয় ঘোর শত্রুতায়।
আমেরিকার মেরিল্যান্ডের লোয়োলা ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন থমাস জে ডিলরেনজো। তার মতে, ফ্যাসিবাদের অর্থনীতি হলো করপোরেটিজম। ১৯২০ ও ১৯৩০–এর দশকে এটি যেমন ইতালি ও জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তেমনি ওই সময়ে এর একটি রূপ আমেরিকাতেও আবির্ভূত হয়েছিল। তখন মার্কিন মুলুকে একে বলা হতো, ‘পরিকল্পিত পুঁজিবাদ’। এই ফ্যাসিবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য এখনো আমেরিকাতে বর্তমান আছে ভালোভাবেই এবং এর প্রভাব ক্রমশ বাড়বে বলেই মনে করেন থমাস ডিলরেনজো। তবে যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদ শব্দের ব্যবহার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, সেহেতু একে ভিন্ন মোড়কে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে এই ব্যবস্থাটিই বিশ্বব্যাপী বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এ ক্ষেত্রে দোহাই হিসেবে বলা হতো যে—আর যাই হোক, মুসোলিনি ঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়ার ব্যবস্থা তো করেছিলেন!
অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে যে ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুণগ্রাহী ছিল এবং আছেও। এই ব্যবস্থাটি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন থমাস জে ডিলরেনজো। তার কথায়, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে ফ্যাসিবাদ আসলে একটি হস্তক্ষেপবাদী শিল্পনীতি। এর প্রবল ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থাকে, সুরক্ষাবাদী মনোভাব দেখায় এবং এটি এমন এক আদর্শের কথা বলে যা ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের অধীন বা আজ্ঞাবহ হতে বাধ্য করে। নাগরিকদের প্রতি ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক দর্শনের মূল নির্দেশনা হলো—‘রাষ্ট্র আপনার জন্য কী করতে পারে, সেটি নিয়ে কথা নয়। বরং আপনি নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের জন্য কী করতে পারেন, তা নিয়ে ভাবতে হবে সব সময়।’

এভাবে ফ্যাসিবাদে নাগরিককে পুরোপুরি আজ্ঞাবহ বানানোর চেষ্টা চলে এবং উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সম্পদের বণ্টনের নিয়ন্ত্রণও চলে যায় কিছু মুষ্টিমেয় অভিজাতদের হাতে। এ বিষয়ে মার্কিন ফ্যাসিস্ট অর্থনীতিবিদ লরেন্স ডেনিস বলেছিলেন, মুক্তবাজার ব্যবস্থায় ভোক্তা ও বিক্রেতার সার্বভৌম অবস্থানের যে নীতি উদারবাদে থাকে, সেটি ফ্যাসিবাদ সমর্থন করে না। বরং বাজার স্বাধীনতা ও প্রতিযোগিতামূলক উপায়ে যত খুশি লাভ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে কেবলই একটি অভিজাত গোষ্ঠীর হাতে।
থমাস জে ডিলরেনজো তাই মনে করেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, মুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে ধ্বংস করতে চায় ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কারণ, কেবলমাত্র এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করা গেলেই ফ্যাসিবাদ যে ধরনের একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গঠন করতে চায়, সেটি সম্ভব হয়।
এবার তবে সারসংক্ষেপ বানানো যাক। ওপরের আলোচনা অনুযায়ী এতটুকু বোঝা গেছে যে, একটি ফ্যাসিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র—এই দুইয়ের মিশেল থাকে। দুটি ব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদানই ফ্যাসিবাদের অর্থনীতিতে স্থান পায়। জাতীয় স্বনির্ভরতা বা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে লাভ করার বিষয়টিতে বাধা দেওয়া হয় না, বরং গুরুত্ব দেওয়া হয়। আবার বিভিন্ন করপোরেশনগুলোতে সরকারি প্রণোদনা বাড়ানোর কথা বলা হয়। ফ্যাসিবাদী অর্থনীতিতে ব্যক্তি ও জাতীয় মালিকানার একটি মিশ্রণকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ক্রোনিজম বা ফ্যাসিবাদের ঘনিষ্ঠ অভিজাতদের নিয়ে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী গড়ে তোলা হয় এবং সেটিই অর্থনীতি সংক্রান্ত সর্বেসর্বা হয়ে দাঁড়ায়। স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত পরিলক্ষিত হয়। এবং ব্যক্তিমালিকানায় মুনাফা অর্জনকে উৎসাহিত করা হলেও, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষাকে। এভাবেই গড়ে ওঠে ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।

ফ্যাসিবাদ বললেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সবাই বিবেচনা করে একটি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থাকে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও। এবং এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এটিই ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক বন্দোবস্তকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

ডেভিসকে সবচেয়ে অবাক করেছিল পাকিস্তানিদের মনস্তত্ত্ব। নারী ধর্ষণকে তারা যুদ্ধের ময়দানে জায়েজ মনে করত। এ ব্যাপারে কোনো ধর্মীয় বিধিনিষেধ নিয়ে তাদের ভয় ছিল না। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত, ধর্ষণের পর যে শিশুটির জন্ম হবে, তার শরীরে থাকবে পাঞ্জাবি, পশতুন, বালুচি কিংবা সিন্ধি রক্ত মোটকথা, পশ্চিম পাকিস্তানি