ভারত–পাকিস্তানের দ্বৈরথ এখন ‘খামাখা’ ক্রিকেট!

ভারত–পাকিস্তানের দ্বৈরথ এখন ‘খামাখা’ ক্রিকেট!
ভারত–পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ কি এখন দ্বৈরথ?

দ্বৈরথ কাকে বলে?

ভারতের টি–টোয়েন্টি অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এশিয়া কাপ ক্রিকেটের সুপার ফোরে পাকিস্তানের বিপক্ষে আরেকটি সহজ জয়ের পর তিনি সোজা–সাপ্টাই জানিয়েছেন, পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের ক্রিকেট লড়াই এখন আর কোনো দ্বৈরথ নয়। ম্যাচ শেষে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে তিনি বেশ বিরক্তি নিয়েই বলেছেন, তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের ক্রিকেট দ্বৈরথ নিয়ে প্রশ্ন করা বন্ধ হওয়া উচিত।

সূর্যকুমার এরপর যেটি বলেছেন, তার সারসংক্ষেপ হলো, একটা ক্রিকেট ম্যাচকে দ্বৈরথ তখনই বলা যায়, যখন সেটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ থাকে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার রোমাঞ্চ থাকে। কিন্তু যে লড়াইয়ে এক প্রতিপক্ষ শুধু জিততেই থাকে, সেটিকে কি দ্বৈরথ বলা ঠিক?

ভারতীয় টি–টোয়েন্টি অধিনায়কের মুখের কথা গত বেশকিছুদিন ধরে আকাশে–বাতাসে ভেসে বেড়ানো কানাঘুষারই আনুষ্ঠানিক রূপ। যে ভারত–পাকিস্তান ক্রিকেট লড়াই এক সময় উপমহাদেশে ঝড় তুলত উত্তেজনার, যে লড়াই জায়গা করে নিয়েছে উপমহাদেশীয় ক্রিকেট কিংবদন্তিতে, সেই লড়াইকে সত্যিকার অর্থেই হালে আর দ্বৈরথ তকমা দিতে চাচ্ছেন না অনেকেই। কারণ, এই লড়াই যে গত কয়েক বছর ধরেই রীতিমতো একপেশে। যত দিন যাচ্ছে, ক্রিকেটপ্রেমীরা এই ম্যাচের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

এশিয়া কাপের প্রাথমিক রাউন্ডে ভারত–পাকিস্তান লড়াইটা দেখে বোঝার কোনো উপায় ছিল না, দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি মাঠে লড়াই করছে। ম্যাচটা ছিল রীতিমতো একপেশে। ভারতও খুব সম্ভবত ভাবতে পারেনি, এত সহজেই তারা জিতে যাবে। ক্রিকেটের ঐতিহ্যবাহী শক্তি হিসেবে পাকিস্তানের কাছ থেকে যে ন্যুনতম লড়াই ক্রিকেটপ্রেমীরা আশা করেন, সেটি দেখাতে ব্যর্থ তারা। রোববার সুপারফোরেও প্রায় একই দৃশ্যপট। এবার ব্যাট হাতে পাকিস্তান কিছুটা ভালো করলেও স্কোরবোর্ডে তারা যে সংগ্রহটা তুলেছিল, সেটি তাড়া করে জিততে ভারতকে কোনো কষ্টই করতে হয়নি।

টি–টোয়েন্টি ফরম্যাটে এই দুই দলের লড়াইয়ের পরিসংখ্যানই আসলে অনেক কিছু বলে দেয়। ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২০ ওভারের ক্রিকেটে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে ১৫ বার। এর মধ্যে ১১ বারই জিতেছে ভারত। পাকিস্তান জিতেছে ৩ বার। একটি ম্যাচ টাই। ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তান যেকোনো ফরম্যাটেই সর্বশেষ জিতেছে ২০২২ সালে। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে সর্বশেষ ৭ লড়াই পাকিস্তানের কোনো জয় নেই। এটাকে কি আর দ্বৈরথ বলা যায়?

ভারত–পাকিস্তান লড়াই এখন বড্ড একপেশে।
ভারত–পাকিস্তান লড়াই এখন বড্ড একপেশে।

তবে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসি কিংবা এর অধীনস্থ আঞ্চলিক সংস্থা এসিসিও ভারত–পাকিস্তান ক্রিকেট লড়াইটাকে মনে করে সোনার ডিমপাড়া হাঁস। ১৯৯২ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট হয়েছে (ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টি মিলিয়ে), এরমধ্যে শুধু ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মিনি বিশ্বকাপেই (চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আদি সংস্করণ) শুধু ভারত–পাকিস্তান মুখোমুখি হয়নি। এর বাইরে ছুতোয়–নাতায়, নানাভাবে এই দুই দলের লড়াই ফেলা হয়েছে। কোনো কোনো টুর্নামেন্টে একাধিকবার। আইসিসি বা এসিসির লক্ষ্যই এ ম্যাচকে পুঁজি করে যতটা সম্ভব টাকা কামানো। আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে ভারত–পাকিস্তানের লড়াইয়ের ঝাঁজ বা এর নস্টালজিয়াকে এতদিন ব্যবহার করা গেছে। আরও বহুদিন হয়তো ব্যবহার করা যেত, কিন্তু বাঁধ সেঁধেছে পাকিস্তানের ক্রিকেট। ভারত গত কুড়ি বছরে নিজেদের ক্রিকেটের মান যতটা উন্নত করতে পেরেছে। পাকিস্তান সে তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। একটা সময় পাকিস্তান ক্রিকেট তারকার মেলা দেখেছিল। ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, ইনজামাম–উল–হক, মঈন খান, শোয়েব আখতার, আবদুল রাজ্জাকের মতো নাম যে দলটিকে আলোকিত করেছে, সেই দলটিই সময়ের ফেরে ম্রিয়মান এক দলে পরিণত। ভারতীয় দলে যে পরিমাণ তারকার সংখ্যা বেড়েছে, পাকিস্তানে ততটাই কমেছে। আইসিসি বা এসিসি বুঝতেই পারছে না, এই লড়াই রোমাঞ্চ হারিয়ে আর দশটা ম্যাচের মতোই হয়ে গেছে। সুপারফোরের ম্যাচে দুবাই ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের গ্যালারির দিকে চোখ রেখে এসিসির কর্মকর্তারা কি অনুভব করেছেন বিষয়টা?

ফুটবলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে ধরা হয় যেসব দেশকে, তারা কত বছর পরপর বৈশ্বিক আসরে মুখোমুখি হয় বা হয়েছে? ধরা যাক, ব্রাজিল–আর্জেন্টিনা। লাতিন অঞ্চলই শুধু নয়, বিশ্ব ফুটবলের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি। বিশ্বকাপে যদি এই দুই দল একটা ম্যাচও খেলে, সেটি টেলিভিশন কিংবা ওটিটিতে ঝড় তুলতে বাধ্য। একটা ম্যাচ দিয়েই বিলিয়ন ডলার এসে যাবে ফিফার কোষাগারে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে কোপা আমেরিকায় এই দুই দল বেশ কয়েকবার মুখোমুখি হলেও বিশ্বকাপে তারা মুখোমুখি হয়েছে মাত্র ৪ বার। যার সর্বশেষটি ৩৫ বছর আগে, ১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপে। আর ক্রিকেটে? ভারত–পাকিস্তান ম্যাচকে রীতিমতো ‘খামাখা’ এক ম্যাচে পরিণত করে এর আকর্ষণ, এর রোমাঞ্চ সবটাই ধ্বংস করেছে ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রকেরা।

২০১২ সাল থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক কোনো সিরিজ হয় না। ক্রিকেটের ধ্রুপদী সংস্করণ টেস্টে এই দুই দলের দেখা হয় না ২০০৭ সালের পর থেকে । ক্রিকেটপ্রেমীদের একটা প্রজন্ম সাদা পোশাকে দুই দলের লড়াই উপভোগ থেকে বঞ্চিত। তারপরেও ক্রিকেট নিয়ন্ত্রকেরা পয়সার লোভে এই দুই দলের লড়াইকে এমন জায়গায় ঠেলে দিয়েছেন, যাকে ফাজলামো ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।

সম্পর্কিত