শুধু দুই দলই দেশ শাসন করে যাবে?

ভোটাররা তাদের ভোট নষ্ট করতে পছন্দ করেন না এবং প্রায়শই হয় ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন অথবা দুটি প্রধান দলের মধ্যে যাকে সবচেয়ে কম আপত্তিকর মনে হয়, তাকে ভোট দেন। আমেরিকাসহ অনেক দেশেই তৃতীয় রাজনৈতিক দলগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। বিশেষ করে আমেরিকায় তো সরকার ব্যবস্থা দ্বি-দলীয় পদ্ধতির। কার্যকর তৃতীয় দল পেতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে, যা সহজ কাজ নয়।

কিথ নটন
কিথ নটন
শুধু দুই দলই দেশ শাসন করে যাবে?
প্রতীকী ছবি

খারাপ মুদ্রার মতো তৃতীয় দলের ধারণা নিয়মিতই আমেরিকান রাজনৈতিক আলোচনায় দেখা যায়। তবে এটি কখনো ফলপ্রসূ হয় না। আপত দৃষ্টিতে মনে হয়, বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাও এই ব্যর্থ প্রচেষ্টায় শামিল হন। ইলন মাস্ক, অ্যান্ড্রু ইয়াং ও মার্ক কিউবানের মতো ব্যক্তিরা এতে যোগ দেওয়ায় কেবল এটিই প্রমাণ হয় যে ব্যবসা ও প্রকৌশলের জন্য কার্যকর বুদ্ধিমত্তা রাজনীতিতে খুব কমই কাজে লাগে।

সুযোগ বুঝে, ইয়াং এখন মাস্কের সাথে যুক্ত হতে চান। তবে তিনি জানতে চান ‘চলার পথটি আদপে কেমন হবে’। যদি এটা ‘কানা গলি’ হয় তাহলে কেমন হয়?

যাই হোক এটা কোনো ষড়যন্ত্রের কারণে নয়, যদিও হ্যাঁ, ক্ষমতায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার সহজাত প্রবৃত্তি তো আছেই। আমেরিকায় তৃতীয় রাজনৈতিক দলগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে, কারণ আমাদের সরকার ব্যবস্থা দ্বি-দলীয় পদ্ধতিতে তৈরি। কার্যকর তৃতীয় দল পেতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে, যা সহজ কাজ নয়।

দেশটির প্রতিষ্ঠাতারা নিশ্চিতভাবে এমনটা যে হবে তা অনুমান করতে পারেননি। কিন্তু অতীতে, বর্তমানে ও ভবিষ্যতে নির্বাচিত প্রতিনিধি তাদের সৃষ্ট ভৌগলিক অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় নির্বাচনে দুটি দলকে সমর্থন করে এসেছে ও করবে। তৃতীয় দলগুলো ভোট কেবল নষ্ট প্রতিবাদে পরিণত হয় এবং অনিবার্যভাবে তা বিলীন হয়ে যায়। আর তারা একটি রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠলে হয় প্রধান দল দুটির একটিকে প্রতিস্থাপন করে, অথবা সেই দুটি দলের কোনো একটিতে (বা উভয়) বিলীন হয়, অথবা বড় জোর আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠে।

মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক। ছবি: পিক্সাবে
মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক। ছবি: পিক্সাবে

অবশ্যই, আমেরিকায় সময়ে সময়ে তৃতীয় দলের উত্থান হয়েছে। রিপাবলিকান পার্টি এভাবেই শুরু হয়েছিল। একটি দৃঢ় বিলোপবাদী দল হিসেবে, রিপাবলিকান পার্টি ১৮৫০-এর দশকে অকর্মণ্য হুইগদেরকে সরিয়ে দিয়েছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে, পপুলিস্ট পার্টি উঠে আসে। কিন্তু ১৮৯৬ সালে ডেমোক্র্যাট উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান তাদের জনপ্রিয়তা ও কর্মসূচী আত্মসাৎ করেন। যার ফলে পপুলিস্টরা বেশির ভাগই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাথে মিশে যায়। পরবর্তীতে, বিংশ শতাব্দীর প্রগ্রেসিভরা মহামন্দা পর্যন্ত উভয় দলের মধ্যে অবস্থান করে, শেষমেষ ডেমোক্র্যাট হয়ে ওঠে।

বিকল্প তৃতীয় দল হিসেবে সর্বশেষ চেষ্টা ছিল রস পেরো-র রিফর্ম পার্টি। পেরো ১৯৯২ সালে সময় পেলেও চাপের মুখে ভেঙে পড়েন। তাঁর আন্দোলন, তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং জাতীয় ঘাটতি নামক একটি বিষয়ের ওপর তার ওই আন্দোলন বড্ড বেশি নির্ভরশীল ছিল। এগুলো ব্যর্থ হলে রিফর্ম পার্টিও নিভে যায়।

এই অভিজ্ঞতা কেবল আমেরিকার একার নয়। ব্রিটেন ও কানাডার উদাহরণ থেকে দেখা যায় কীভাবে এই নির্বাচনী কাঠামো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দুটি দলের দিকে ঠেলে দেয়।

ব্রিটেনের ইতিহাস যা বলে

ব্রিটেন রাজনৈতিক দলগুলোর আবির্ভাবের পর থেকেই দুটি দলের প্রভাবই দেখা যায়। তৃতীয় দলগুলো মাঝেমধ্যে জোটবদ্ধ হয়ে সামান্য প্রভাব বিস্তার করেছে। শুরুতে কনজারভেটিভ ও লিবারেল (যারা হুইগ হিসেবে শুরু করেছিল) দল দুটি প্রভাবশালী ছিল। এরপর বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বামপন্থী লেবার পার্টির উত্থান ঘটে। কিন্তু লেবার পার্টি তৃতীয় শক্তি হয়ে ওঠেনি, তারা লিবারেলদের স্থলাভিষিক্ত হয়। লিবারেলরা ১৯১০ সালে ২৭৪টি আসন নিয়ে সরকারের নেতৃত্ব দিলেও ১৯২৯ সালের মধ্যে তাদের আসন সংখ্যা ৫৯-এ নেমে আসে।

britain parliament

যদিও বর্তমানে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস নামে পরিচিত দলটি মাঝেমধ্যে নির্বাচনী সাফল্য অর্জন করেছে, তারা সেই গতি ধরে রাখতে পারেনি। ২০১০ সালে তারা ৫৭টি আসন পেয়েছিল এবং কনজারভেটিভদের জোটে অংশ নেয়, কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে তাদের আসন সংখ্যা আটে নেমে আসে। একটি স্থানীয় দল, স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি তাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

কেবল স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোই ভালো করতে পারে। ব্রিটেনে জাতীয় ভোটের ৫ শতাংশের বেশি কখনোই না পেয়েও স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি) নিয়মিতভাবে লিবারেলদের ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৭ সালে লিবারেলদের অর্ধেকেরও কম ভোট পেয়েও এসএনপি ৩৫টি আসন পায়, যেখানে লিবারেলরা পেয়েছিল মাত্র ১২টি আসন।

কানাডার রাজনৈতিক ব্যবস্থা

কানাডাও ব্রিটেনের মতো একই ব্যবস্থা দেখা যাবে। এখানেও এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে কনজারভেটিভ ও লিবারেল পার্টি একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। তবে আরও দুটি দল কানাডার রাজনৈতিক গল্পের অংশ হয়েছে: নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি (একটি বামপন্থী দল) এবং ব্লক ক্যুবেকুয়া (একটি আঞ্চলিক দল)।

লেবার পার্টির মতো নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) লিবারেলদের চ্যালেঞ্জ জানাতে উঠে এসেছিল। তবে লেবার পার্টির মতো তাদের সামনে সুযোগ এলেও তারা লিবারেলদের জায়গা নিতে ব্যর্থ হয়। ২০১১ সালে এনডিপি লিবারেলদের চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে ১০৩টি আসন লাভ করে। যেখানে লিবারেলরা পেয়েছিল মাত্র ৩৪টি আসন। কিন্তু পরের নির্বাচনে, দলটি মাত্র ৪৪টি আসনে নেমে আসে। তারপর থেকে এটি কেবল দুর্বলই হয়েছে এবং সর্বশেষ নির্বাচনে মাত্র সাতটি আসন ধরে রাখতে পেরেছে।

ভোটারের মনস্তত্ত্ব এবং তৃতীয় পক্ষের সীমাবদ্ধতা

ভোটাররা তাদের ভোট নষ্ট করতে পছন্দ করেন না এবং প্রায়শই হয় ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন অথবা দুটি প্রধান দলের মধ্যে যাকে সবচেয়ে কম আপত্তিকর মনে হয়, তাকে ভোট দেন। সংসদীয় ব্যবস্থায়, একটি জোট সরকারে সামান্য কিছু আসন পেলেও তৃতীয় দল নির্বাহী ক্ষমতার জন্য দর কষাকষি করতে পারে। কিন্তু আমেরিকান ফেডারেল ব্যবস্থায়, তৃতীয় দলগুলোর নির্বাহী শাখায় কোনো ক্ষমতা নেই। বড়জোর, প্রয়োজনে কংগ্রেসে ভোটের বিনিময়ে কিছু সুবিধা চাইতে পারে।

free pik

যারা হাউস ও সেনেটে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত হন, তারা ছোট রাজ্যের স্বতন্ত্র ভোটদান প্রবণতা থেকে আসেন। আলাস্কা, মেইন এবং ভারমন্ট–এইসব কম ভোটার সংবলিত প্রত্যন্ত অঙ্গরাজ্যগুলো স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনের রেকর্ড রাখে।

বর্তমান অবস্থায় এটি উল্লেখ্য যে, দুই স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স (ভারমন্ট) এবং অ্যাঙ্গাস কিং (মেইন) কেবল নামেই স্বতন্ত্র। তারা ডেমোক্র্যাটদের সাথে ককাস করেন এবং সবকিছুতে তাদের সাথে একমত হয়ে ভোট দেন। যখন প্রাক্তন ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর জো ম্যানচিন এবং কার্স্টেন সিনেমা মধ্যপন্থীদের সাথে আপোস করার চেষ্টা করেছিলেন, তখন কিং এবং স্যান্ডার্সকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তাই মাস্ক, ইয়াং ও কিউবান নিজেদের যতটা বুদ্ধিমান মনে করেন, ততটা বুদ্ধিমান হতেন, তাহলে তারা হয় দুটি প্রধান দলের যেকোনো একটিকে প্রতিস্থাপন বা দখল করার পরিকল্পনা করতেন। তা না হলে, তারা একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ তৈরি করতে পারতেন, যা রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিগুলোতে নিজেদের জড়িত রাখত এবং একটি সুসংহত প্ল্যাটফর্মের চারপাশে ঘোরা প্রার্থীদের সমর্থন করত। তাদের গ্রুপটি একটি সত্যিকারের নির্দলীয় সংস্থা হতো। ওয়াশিংটনে আগাছার মতো গজিয়ে ওঠা ছদ্ম নিরপেক্ষ অ্যাডভোকেসি গ্রুপের মতো নয়।

শেষ কথা হলো, মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’ যদি একই ব্যর্থ পথ অনুসরণ করে, তবে ‘নো লেবেলস’ এবং ‘ফরওয়ার্ড পার্টি’র মতোই তাদের পরিণতি হবে, অর্থাৎ কোথাও পৌঁছাতে পারবে না।

কিথ নটন: দীর্ঘদিন ধরে রিপাবলিকান রাজনৈতিক পরামর্শক

[লেখাটি মার্কিন ওয়েবসাইট দ্য হিলের সৌজন্যে প্রকাশিত]

সম্পর্কিত