নাইর ইকবাল
খালেদা জিয়া যখন বিএনপির দায়িত্ব নেন, দলটি তখন এলোমেলো, দিগ্ভ্রান্ত। ১৯৮১ সালের ৩০ মে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি ১৯৭৮ সালে সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে বিএনপি গঠন করেন। বিভিন্ন মত ও পথের রাজনীতিকদের এক প্ল্যাটফর্মে জড়ো করে গঠিত হয়েছিল বিএনপি। দলটিতে প্রগতিশীল রাজনীতিকেরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন ডানপন্থী রাজনীতিকেরা। বাম–ডান ও মধ্যপন্থার মিশেল বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঐক্যবদ্ধ ছিল জিয়াউর রহমানের কঠোর ব্যক্তিত্বের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু জিয়া নিহত হওয়ার পর বিএনপির নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দলটি ভেতর থেকেই হয়ে পড়ে অস্থির।
সেই অস্থির বিএনপিকেই নিজের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন খালেদা জিয়া। ক্যান্টনমেন্টের অলিন্দে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলটিকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন জনতার কাছে। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অগ্নিপরীক্ষায় নিজে উত্তীর্ণ হয়েছেন, দলকেও করেছেন উত্তীর্ণ। আন্দোলন–সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দল নির্বাচনে জিতে দুবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরেছে। বিরোধী দলীয় রাজনীতিতেও রাজপথ কিংবা সংসদ—দুই জায়গাতেই বিএনপিকে পরিণত এক রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করেছেন। আজকের বিএনপি তাই খালেদা জিয়ার আন্দোলন–সংগ্রামেরই ফসল।

১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি তখন স্বামীর শোকে মূহ্যমান। রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণা থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল তার পক্ষে। কারণ, রাজনীতির কারণেই স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি। কিন্তু খালেদা জিয়া স্বামীর রাজনৈতিক স্বপ্ন ও লক্ষ্য পূরণকেই ব্রত হিসেবে নিলেন। খালেদার রাজনীতিতে পা রাখার দুই মাসের মাথায় দেশে সামরিক আইন জারি করেছিলেন সে সময়ের সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। বিএনপি সময়ের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করেই। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় তখন যোগ হয় সামরিক শাসন থেকে দেশের মুক্তিও। ১৯৮৩ সালে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও ১৯৮৪ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন তিনি।
আগেই বলা হয়েছে, দলের ভেতর তখন অনেক চ্যালেঞ্জ। খালেদা রাজনীতির প্রায় কিছুই বোঝেন না তখন। স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা বিপথে পরিচালিত হওয়ার ঝুঁকি ছিল প্রবলভাবেই। খালেদা জিয়া নিজের প্রজ্ঞা আর ব্যক্তিত্ব দিয়ে সেই ঝুঁকি সামলেছেন। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। রাজনীতির বন্ধুর পথে হেঁটেছেন। দলের ওপর শতভাগ কর্তৃত্ব আর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
আশির দশকে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। যে মানুষটা কোনোদিন রাজনীতির কথা ভাবেনইনি। যিনি ছিলেন আটপৌরে এক গৃহিনী, স্বামী ও সন্তানদের কল্যাণই ছিল যার একমাত্র লক্ষ্য, সেই মানুষটিই রাজনীতি করতে গিয়ে দুর্ভোগ সয়েছেন, জেল–জুলুমের শিকার হয়েছেন। মঞ্চ কাঁপিয়ে বক্তৃতা করেছেন, দলের নেতা–কর্মীসহ সবার আস্থা অর্জন করেছেন। রাজনীতিতে এমন স্বশিক্ষিত নেতৃত্ব সত্যিই অনন্য ঘটনা।

দলের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ অনেকবারই সামনে এসেছে। ১৯৮৮ সালে দলের মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল তিনি দল ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে গিয়ে এরশাদের দলে যোগ দেবেন। খবর রটতেই চুপেচাপে কে এম ওবায়েদকে পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। পুরোপুরি সরাননি, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন। আবদুস সালাম তালুকদারকে মহাসচিব করে দলে গতি ফিরিয়েছিলেন, আস্থার সংকট নিরসন করেছিলেন। এমন অনেক কঠোর সিদ্ধান্তই খালেদা জিয়াকে নিতে হয়েছে দল চালাতে গিয়ে। এই কঠোর সিদ্ধান্তগুলোই দলের ওপর খালেদা জিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করেছিল।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতন হয়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের ইতিহাসে প্রথম নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপি রাজপথের রাজনীতিতে উত্তীর্ণ; কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে দলটি আওয়ামী লীগের সামনে কতটা টিকতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ ছিলই। সাংগঠনিক দিক দিয়েও বিএনপি, আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। কিন্তু তারপরও ’৯১ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। দেশজুড়ে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে খালেদা ছিলেন অক্লান্ত। অনেকেই বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি আওয়ামী লীগকে হারাতে পেরেছিল ব্যক্তি খালেদার ইমেজের ওপর ভর করেই। সেই নির্বাচনের প্রচারে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কথাবার্তার বিপরীতে খালেদা জিয়া ছিলেন পুরোপুরি ভিন্ন মেরুতে। তার বিনয়ী অথচ দৃঢ়তায় মোড়া রাজনৈতিক ভাষা দেশের ভোটাররা গ্রহণ করেছিল।

এরপর এল দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশ চালানোর অধ্যায়। রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞতার পরও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম কালটা ছিল সফলতার। যদিও মাঠে বিরোধী দলগুলোর জ্বালাও–পোড়াও রাজনীতিতে খালেদা বেকায়দায় পড়েছিলেন; কিন্তু অমন পরিস্থিতি খালেদা জিয়াকে নেতা হিসেবে করেছে আরও পরিশীলিত।
রাজনীতি করতে এসে চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে, খালেদা সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। কিন্তু রাজনীতি যদি ব্যক্তিকে লক্ষ্যবস্তু করে ফেলে, সেটি ভয়াবহ। খালেদা ওই পরিস্থিতিও মোকাবিলা করেছেন। ২০০৬ সালে তার প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয় মেয়াদ শেষে রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটল, তাকে গ্রেপ্তার করা হলো, রাজনীতি থেকে তার উত্তরাধিকারকে বিনাশ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলল। এই সময়েই এক সন্তানকে হারালেন তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই নিপীড়নের মাত্রা নিয়ে গেল অসহনীয় পর্যায়ে। তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হলো। তাতেও নিস্তার মিলল না। দুটি মামলায় তাকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হলো। যে কেন্দ্রীয় কারাগার পরিত্যক্ত, সেখানেই হলো তার কারাবাস। অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার চিকিৎসা নিয়েও রাজনীতি চলল। এর মধ্যেও অপেক্ষা করতে থাকলেন শুভ সময়ের জন্য। রাজনীতিতে ত্যাগের কথা বলা হয়, খালেদা জিয়া রাজনীতিতে ত্যাগের প্রতীক।
খালেদা জিয়ার এই ত্যাগের ফলেই আজকের বিএনপি। ক্যান্টনমেন্টে এক সামরিক শাসকের হাতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া দলটাই আজ দেশের রাজনীতিতে মহীরূহ।
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, চরচা
খালেদা জিয়া যখন বিএনপির দায়িত্ব নেন, দলটি তখন এলোমেলো, দিগ্ভ্রান্ত। ১৯৮১ সালের ৩০ মে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি ১৯৭৮ সালে সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে বিএনপি গঠন করেন। বিভিন্ন মত ও পথের রাজনীতিকদের এক প্ল্যাটফর্মে জড়ো করে গঠিত হয়েছিল বিএনপি। দলটিতে প্রগতিশীল রাজনীতিকেরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন ডানপন্থী রাজনীতিকেরা। বাম–ডান ও মধ্যপন্থার মিশেল বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঐক্যবদ্ধ ছিল জিয়াউর রহমানের কঠোর ব্যক্তিত্বের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু জিয়া নিহত হওয়ার পর বিএনপির নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দলটি ভেতর থেকেই হয়ে পড়ে অস্থির।
সেই অস্থির বিএনপিকেই নিজের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন খালেদা জিয়া। ক্যান্টনমেন্টের অলিন্দে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলটিকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন জনতার কাছে। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অগ্নিপরীক্ষায় নিজে উত্তীর্ণ হয়েছেন, দলকেও করেছেন উত্তীর্ণ। আন্দোলন–সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দল নির্বাচনে জিতে দুবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরেছে। বিরোধী দলীয় রাজনীতিতেও রাজপথ কিংবা সংসদ—দুই জায়গাতেই বিএনপিকে পরিণত এক রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করেছেন। আজকের বিএনপি তাই খালেদা জিয়ার আন্দোলন–সংগ্রামেরই ফসল।

১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি তখন স্বামীর শোকে মূহ্যমান। রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণা থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল তার পক্ষে। কারণ, রাজনীতির কারণেই স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি। কিন্তু খালেদা জিয়া স্বামীর রাজনৈতিক স্বপ্ন ও লক্ষ্য পূরণকেই ব্রত হিসেবে নিলেন। খালেদার রাজনীতিতে পা রাখার দুই মাসের মাথায় দেশে সামরিক আইন জারি করেছিলেন সে সময়ের সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। বিএনপি সময়ের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করেই। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় তখন যোগ হয় সামরিক শাসন থেকে দেশের মুক্তিও। ১৯৮৩ সালে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও ১৯৮৪ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন তিনি।
আগেই বলা হয়েছে, দলের ভেতর তখন অনেক চ্যালেঞ্জ। খালেদা রাজনীতির প্রায় কিছুই বোঝেন না তখন। স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা বিপথে পরিচালিত হওয়ার ঝুঁকি ছিল প্রবলভাবেই। খালেদা জিয়া নিজের প্রজ্ঞা আর ব্যক্তিত্ব দিয়ে সেই ঝুঁকি সামলেছেন। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। রাজনীতির বন্ধুর পথে হেঁটেছেন। দলের ওপর শতভাগ কর্তৃত্ব আর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
আশির দশকে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। যে মানুষটা কোনোদিন রাজনীতির কথা ভাবেনইনি। যিনি ছিলেন আটপৌরে এক গৃহিনী, স্বামী ও সন্তানদের কল্যাণই ছিল যার একমাত্র লক্ষ্য, সেই মানুষটিই রাজনীতি করতে গিয়ে দুর্ভোগ সয়েছেন, জেল–জুলুমের শিকার হয়েছেন। মঞ্চ কাঁপিয়ে বক্তৃতা করেছেন, দলের নেতা–কর্মীসহ সবার আস্থা অর্জন করেছেন। রাজনীতিতে এমন স্বশিক্ষিত নেতৃত্ব সত্যিই অনন্য ঘটনা।

দলের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ অনেকবারই সামনে এসেছে। ১৯৮৮ সালে দলের মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল তিনি দল ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে গিয়ে এরশাদের দলে যোগ দেবেন। খবর রটতেই চুপেচাপে কে এম ওবায়েদকে পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। পুরোপুরি সরাননি, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন। আবদুস সালাম তালুকদারকে মহাসচিব করে দলে গতি ফিরিয়েছিলেন, আস্থার সংকট নিরসন করেছিলেন। এমন অনেক কঠোর সিদ্ধান্তই খালেদা জিয়াকে নিতে হয়েছে দল চালাতে গিয়ে। এই কঠোর সিদ্ধান্তগুলোই দলের ওপর খালেদা জিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করেছিল।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতন হয়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের ইতিহাসে প্রথম নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপি রাজপথের রাজনীতিতে উত্তীর্ণ; কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে দলটি আওয়ামী লীগের সামনে কতটা টিকতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ ছিলই। সাংগঠনিক দিক দিয়েও বিএনপি, আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। কিন্তু তারপরও ’৯১ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। দেশজুড়ে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে খালেদা ছিলেন অক্লান্ত। অনেকেই বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি আওয়ামী লীগকে হারাতে পেরেছিল ব্যক্তি খালেদার ইমেজের ওপর ভর করেই। সেই নির্বাচনের প্রচারে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কথাবার্তার বিপরীতে খালেদা জিয়া ছিলেন পুরোপুরি ভিন্ন মেরুতে। তার বিনয়ী অথচ দৃঢ়তায় মোড়া রাজনৈতিক ভাষা দেশের ভোটাররা গ্রহণ করেছিল।

এরপর এল দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশ চালানোর অধ্যায়। রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞতার পরও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম কালটা ছিল সফলতার। যদিও মাঠে বিরোধী দলগুলোর জ্বালাও–পোড়াও রাজনীতিতে খালেদা বেকায়দায় পড়েছিলেন; কিন্তু অমন পরিস্থিতি খালেদা জিয়াকে নেতা হিসেবে করেছে আরও পরিশীলিত।
রাজনীতি করতে এসে চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে, খালেদা সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। কিন্তু রাজনীতি যদি ব্যক্তিকে লক্ষ্যবস্তু করে ফেলে, সেটি ভয়াবহ। খালেদা ওই পরিস্থিতিও মোকাবিলা করেছেন। ২০০৬ সালে তার প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয় মেয়াদ শেষে রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটল, তাকে গ্রেপ্তার করা হলো, রাজনীতি থেকে তার উত্তরাধিকারকে বিনাশ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলল। এই সময়েই এক সন্তানকে হারালেন তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই নিপীড়নের মাত্রা নিয়ে গেল অসহনীয় পর্যায়ে। তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হলো। তাতেও নিস্তার মিলল না। দুটি মামলায় তাকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হলো। যে কেন্দ্রীয় কারাগার পরিত্যক্ত, সেখানেই হলো তার কারাবাস। অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার চিকিৎসা নিয়েও রাজনীতি চলল। এর মধ্যেও অপেক্ষা করতে থাকলেন শুভ সময়ের জন্য। রাজনীতিতে ত্যাগের কথা বলা হয়, খালেদা জিয়া রাজনীতিতে ত্যাগের প্রতীক।
খালেদা জিয়ার এই ত্যাগের ফলেই আজকের বিএনপি। ক্যান্টনমেন্টে এক সামরিক শাসকের হাতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া দলটাই আজ দেশের রাজনীতিতে মহীরূহ।
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, চরচা