২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানী ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারত চলে যান। সেখানে তিনি এখনো নির্বাসনে আছেন। বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধ, দুর্নীতি ও আদালত অবমাননা। দেশের অন্তর্বর্তী সরকার তার প্রত্যর্পণ চেয়েছে এবং তার পাসপোর্ট বাতিল করেছে। কিন্তু ভারত, যারা হাসিনাকে নিজেদের মিত্র মনে করত, তারা বাংলাদেশের এই অনুরোধের এখনো কোনো জবাব দেয়নি।
২০২৪ সালের গ্রীষ্মকাল জুড়ে ছাত্র ও আন্দোলনকারীরা রাস্তায় মিছিল করেছিল। এর সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে, যা হাইকোর্টের নির্দেশে হয়েছিল। কার্যকরভাবে এটি ছিল আওয়ামী লীগ, তথা হাসিনার দলের সমর্থকদের সন্তানদের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা। যে দেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক বেশি, সেখানে ছাত্ররা এই বিষয়টিকে পছন্দ করেনি।
কিন্তু শেখ হাসিনা জাতির মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হন। তিনি বিক্ষোভকারীদের উপহাস করেন এবং তাদের ‘রাজাকার’ বলে অভিহিত করেন। এটি একটি অবমাননাকর শব্দ, যা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সহযোগিতাকারীদের বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বাড়তেই থাকে এবং পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর বেপরোয়া শক্তি প্রয়োগ করে। এতে শত শত মানুষ মারা যান এবং ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে।
শেখ হাসিনার বিদায়ের পর রাজনৈতিক পালাবদল ছিল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। ৮৫ বছর বয়সী অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস । তিনি ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য পরিচিত (এবং হাসিনা কর্তৃক সমালোচিতও হয়েছিলেন)। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি দেশ পরিচালনার জন্য সুশীল সমাজের কর্মী, টেকনোক্র্যাট, প্রশাসক এবং রাজনীতিবিদদের নিয়ে একটি জোট গঠন করেন। এতে দেশে এক ধরনের আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। কারণ মানুষ রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য সত্যিকারের আশা দেখতে পেয়েছিল।
কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দুটি পরিবারের মধ্যে আবর্তিত হয়েছে- প্রথমটি হলো শেখ হাসিনার পরিবার। তাদের আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এবং ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত দেশ শাসন করেছে। এর আগে তার বাবা, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন (ওই বছরই তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালে হত্যার শিকার হন)।
দ্বিতীয়টি হলো-জিয়া পরিবার। তাদের দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যার নেত্রী খালেদা জিয়া ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তারও আগে, তার স্বামী জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ওই বছর তিনিও ক্ষমতায় থাকাকালে হত্যার শিকার হন।
বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘকাল ধরে তথাকথিত ‘মাইনাস-টু সমাধান’-এর আকাঙ্ক্ষা করেছে, অর্থাৎ তারা এমন একটি সরকার যেখানে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনোটিই নেতৃত্বে থাকবে না।
এক বছর আগে ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশের মনোভাব বদলে গেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে এবং তার কিছু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কারাগারে আছেন। ধর্মীয় মৌলবাদীরা উদার গণতন্ত্র ও নারীর অধিকারের জন্য হুমকি হিসেবে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বল হয়েছে, এবং আমেরিকার বাড়তি শুল্ক বা ট্যারিফের সিদ্ধান্ত দেশটির পোশাক রপ্তানির জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন স্থগিত করেছে, যা এখন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে বলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সম্ভবত তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। তাই এই প্রতিযোগিতা সম্ভবত একপেশে হবে।
ছবি: চরচানিঃসন্দেহে, বাংলাদেশ বহু বছর ধরে অব্যবস্থাপনার শিকার হয়েছে। হাসিনা দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন। কিন্তু শুধু ২০০৮ সালের শেষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দলের জয় ছিল অবাধ ও সুষ্ঠু। এর পরের তিনটি নির্বাচনে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে, যার মধ্যে দুটিতে প্রধান প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। দুর্নীতি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করেছিল এবং বেকারত্বও বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের রাজনীতি অত্যন্ত বিভেদপূর্ণ। দেশটি দুটি দলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যারা একে অপরকে ঘৃণা করে এবং দ্বিদলীয় কাঠামোয় কাজ করতে অক্ষম। দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগের শাসনের পর, অনেক বিরোধী রাজনীতিবিদ প্রতিশোধ নিতে চাইছেন। বস্তুত, গত গ্রীষ্মের সহিংসতার ঘটনায় হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইননজীবীরা একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছেন। হাসিনার দেশে ফিরে এসে অভিযোগের মোকাবিলা করার কোনো পরিকল্পনা নেই এবং ভারতও তাকে হস্তান্তর করতে প্রস্তুত নয়। যদি বিচার প্রক্রিয়া এগোয়ও, তবে তা হবে তার অনুপস্থিতিতে এবং সেই কারণে হয়তো এর বৈধতা থাকবে না।
হাসিনা যখন ক্ষমতাচ্যুত হন, তখন বাংলাদেশে সুস্পষ্ট স্বস্তির নিশ্বাস দেখা গিয়েছিল। মানবাধিকার কর্মীরা ভেবেছিলেন, তারা আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন। একটি তদন্ত কমিশন বছরের পর বছর বিচার ছাড়া আটক থাকা মানুষদের বিষয়ে উত্তর খুঁজে বের করবে। তাদের মুক্তি দেবে এবং নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বহু মানুষের পরিবার কিছুটা শান্তি পাবে। ড. ইউনূসের প্রতি সুশীল সমাজের সমর্থন ছিল এবং মনে হচ্ছিল যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বাংলাদেশের লাগামহীন নিরাপত্তাবাহিনী জবাবদিহির আওতায় আসবে। আর নিরাপত্তা খাতে সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।
যদিও কিছু মানুষ এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে হাসিনার অনুপস্থিতিতে (তিনি হিন্দু এবং অন্যদের সমর্থন পেয়েছিলেন) মৌলবাদীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তবুও এই আশা ছিল যে ড. ইউনূস দৃঢ়ভাবে মৌলবাদের মোকাবিলা করবেন। অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এটাও প্রত্যাশা করেছিল যে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা ব্যাংক থেকে পাচার হওয়া কিছু অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
কিন্তু গত বছরটি বেশ কয়েকটি দিক থেকে হতাশাজনক ছিল। গণতন্ত্রের ঘড়ি আবার নতুন করে চলতে শুরু করবে–এই আকাঙ্ক্ষা কেবল আকাঙ্ক্ষাই থেকে গেছে। যদিও হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের বিশৃঙ্খলা দূর করতে সময় লাগবে। তবুও ইউনূস প্রশাসন ধীর গতিতে কাজ করেছে। আমলাতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিবেদনগুলো অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। গণতান্ত্রিক সংস্কার চলছে মন্থর গতিতে। অনেকেই মনে করছেন, একসময়ের নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী যদি সংসদে তাদের আসন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে এবং নতুন নির্বাচিত সরকারে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তবে ধর্মীয় মৌলবাদীরা নারীর অধিকার খর্ব করতে তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেবে।
নারীর ক্ষমতায়ন ক্ষমতাসীন বাংলাদেশি সরকারগুলোর একটি অর্জন ছিল। দেশে এমন অনেক সংস্থা আছে যারা নারীর অধিকারের পক্ষে লড়াই করেছে। নারী সাক্ষরতার হার বাড়ছে। পার্শ্ববর্তী ভারতের তুলনায় নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার বেড়েছে। কিন্তু এই অর্জনগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম-এর মতো সংগঠনগুলো তাদের শক্তি প্রদর্শন করছে। হেফাজতে ইসলাম ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দল ও সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই একটি রাষ্ট্রের কাছে নারীদের সমান উত্তরাধিকারের অধিকার দেওয়ার সুপারিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে।
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী কখনো ১৩ শতাংশের বেশি জনসমর্থন পায়নি। তবে তারা ব্যাপক জনসভা করার মাধ্যমে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এদিকে হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা ইসলামী আইনের দাবিতে রাস্তায় মিছিল করেছে। এই গোষ্ঠীগুলো তাদের কট্টর মনোভাব প্রকাশ্যে জাহির করে এবং এমন লিঙ্গভিত্তিক নিয়ম চাপিয়ে দিতে চায় যা বাংলাদেশি সমাজের সঙ্গে বেমানান।
তবে এই ধরনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো সবচেয়ে ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারেন রাজনৈতিক ম্যান্ডেট পাওয়া নেতারা। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকর্তারা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করলেও, তাদের বৈধতার অভাব রয়েছে। তাদের এমন আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে, যাদের গত বছর ছাত্র ও বিক্ষোভকারীদের ওপর সহিংস দমন-পীড়নের কারণে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ড. ইউনূসের প্রধান কাজ ছিল দেশকে নির্বাচনের দিকে চালিত করা। কিন্তু অগ্রগতি মন্থর হওয়ায় গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিগুলো আবার সংগঠিত হচ্ছে।
এই বিরাজমান জড়তার মধ্যে, বিএনপি ও মৌলবাদী সংগঠনগুলো নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করেছে। বিএনপি অতীতে জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট বেঁধেছিল। আওয়ামী লীগ যদি প্রার্থী দিতে না পারে, তবে সেই জোটটি আদৌ হবে কি না তা অস্পষ্ট। ছাত্র আন্দোলনকারীরা, যারা হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, তাদের দ্বারা গঠিত জাতীয় নাগরিক পর্টি বা ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)ও একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হতে পারে। তবে নিশ্চিতভাবে জানার জন্য নির্বাচন এখনও অনেক দূরে।
এই সময়ের মধ্যে, প্রতিশোধ গ্রহণ প্রবল হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী এবং কর্মী–যাদের মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং কেউ কেউ ইসলামী মৌলবাদী এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতাকারী অন্যদের কঠোর শাস্তির জন্য প্রচার চালিয়েছিলেন–তারা এখন কারাাগারে আছেন। তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে বর্তমানে গণহত্যায় সহায়তার মতো ভয়াবহ অভিযোগ আনা হয়েছে।
ছবি: চরচাযদিও সেই সুশীল সমাজের নেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত, যারা অতীতে মানবাধিকারের পক্ষে সরব ছিলেন কিন্তু সরকারের ছাত্র বিক্ষোভে সহিংস প্রতিক্রিয়ার সময় নীরব ছিলেন। কিন্তু নিপীড়নমূলক আইনে তাদের কারারুদ্ধ করা অন্তর্বর্তী সরকারের সেই দাবিকে ক্ষুণ্ণ করে যে তারা বাংলাদেশের প্রতিশোধ-নির্ভর রাজনীতির সংস্কৃতি থেকে নতুন দিকে যাত্রা করবে। সরকার যেন এই উইচ হান্ট বা নির্বিচার ধরপাকড় থামাতে অক্ষম এবং গুরুতর অভিযোগে অনেককে আটক করে তারা নিজেরাই এতে ভূমিকা রেখেছে। এদের মধ্যে রয়েছেন একজন অভিনেতা ও ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষাবিদ এবং জ্যেষ্ঠ সম্পাদকেরা।
এই লোকদের অধিকাংশই রাজনৈতিক সহিংসতার মামলায় হত্যা বা হত্যার চেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই অভিযোগগুলো বিক্ষোভ চলাকালীন বা তার পরে সংঘটিত সহিংস ঘটনায় আহত ব্যক্তি বা তাদের স্বজনদের দ্বারা দায়ের করা ‘প্রাথমিক তথ্য প্রতিবেদন’ বা অভিযোগ থেকে নেওয়া সামান্য প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কয়েকজনকে আওয়ামী শাসনের সুবিধাভোগী হিসেবে দেখা হয়। আইনজীবীরা আটককৃতদের জামিন দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন এবং আদালতগুলো তা মেনে নিয়েছে। এই ধরনের স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তার ছিল আওয়ামী লীগ শাসনের বৈশিষ্ট্য; এখন তা অন্য রূপে দেখা যাচ্ছে।
এটা সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত, গত বছরের বিক্ষোভের সময় আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কমপক্ষে আট শ লোককে হত্যা করেছে। আর এটা খুবই সম্ভব যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত কিছু কর্মকর্তা এতে জড়িত ছিলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে জেলে থাকা সব ব্যক্তি এই সহিংসতার সঙ্গে জড়িত–এমনটা প্রমাণ করার জন্য বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাব রয়েছে। তাদের একমাত্র অপরাধ সম্ভবত এটাই যে তারা হাসিনার দলকে সমর্থন করতেন।
বাংলাদেশে মানবাধিকারের অবনতি হলো হাসিনা-পরবর্তী যুগের সবচেয়ে নির্মম পরিহাসগুলোর মধ্যে অন্যতম। তার শাসনামলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শত শত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং স্বেচ্ছাচারী কায়দায় আটকের জন্য দায়ী ছিল। নতুন সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করার এবং অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনার প্রতিজ্ঞা করেছিল।
ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম সম্প্রতি যেমনটি জিজ্ঞাসা করেছেন, “আমরা বারবার বলছি, আমরা সফলভাবে হাসিনার ক্ষমতা কুক্ষিগতকারী এবং স্বাধীনতা-দমণকারী শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছি। কিন্তু এর বদলে আমরা কী প্রতিষ্ঠা করেছি?” বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির দুর্ভাগ্য হলো, রাজনৈতিক বিভাজনটি হলো দ্বৈতসত্তার, অর্থাৎ যেখানে সবকিছুকে কেবল ভালো বা খারাপের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। মানুষ কেবল নিজের পক্ষের প্রতিই সহানুভূতিশীল।
সুতরাং, আওয়ামী লীগের সমর্থকরা এই দেখে স্তম্ভিত যে হাসিনার পিতা শেখ মুজিবের মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং তার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত বছর নিহত শত শত মানুষ সম্পর্কে তাদের খুব বেশি কিছু বলার নেই। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের বিরোধীরা কেবল সেই সব মৃত্যুর কথাই বলেন এবং মুজিব বা তার উত্তরাধিকারকে মুছে ফেলার চেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসের যে গুরুতর ক্ষতি করা হচ্ছে, তা স্বীকার করতে অনিচ্ছুক।
বাংলাদেশের উচিত এই প্রতিশোধের চক্র থেকে বেরিয়ে আসা; গতকালকের শিকারেরা যেন আজকের অপরাধী না হন। প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচার–এই নীতি হওয়া উচিত পথনির্দেশক সূত্র।
ছবি: চরচাইউনূস সম্ভবত অর্থনীতির মতো কম বিতর্কিত বিষয়গুলোতে মনোযোগ সরাতে পারলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। তিনি যে স্থিতিশীলতার কথা বলছেন, তাতে উৎসাহিত হয়ে বহুপাক্ষিক ঋণদাতা সংস্থাগুলি বাংলাদেশে ঋণ দেওয়া আবার শুরু করেছে। গত এক বছরে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১২ শতাংশ থেকে কমে ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ শতাংশ শুল্ক, যা ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে, তা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকে আঘাত হানবে।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিও বাংলাদেশের বাণিজ্যের জন্য একটি সমস্যা সৃষ্টি করছে। হাসিনার শাসনামলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের উষ্ণ সম্পর্ক ছিল। দীর্ঘ সময় কক্ষমতায় থাকা নেত্রীর পতন নয়াদিল্লির জন্য একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে। আর ভারতও দ্রুত ঢাকার কাছে বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের প্রতি হুমকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে কিছু প্রতিশোধপ্রবণ গোষ্ঠী হিন্দুদের সম্পত্তিতে আক্রমণ করে। এই আক্রমণগুলো যেমন ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, তেমনি এর পেছনে এই ধারণাও কাজ করেছিল যে হিন্দুরা বহুলাংশে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। তবে একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন করার জন্য এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না। যে মধ্যপন্থী ব্যক্তিরা একটি বহুত্ববাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ে তোলার আশা করেছিলেন, তারা এখন নিজেদের আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে দেখতে পাচ্ছেন। ইউনূস চীন ও পাকিস্তানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছেন, যা ভারত বা আমেরিকা কেউই সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখবে না।
ইউনূসের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে বাস্তবতা মেনে একটি নির্বাচনী সময়সূচিতে রাজি করানো। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যায় বাড়ছে এবং আওয়ামী লীগের ওপর দূরদৃষ্টিহীন নিষেধাজ্ঞা শেষ পর্যন্ত সাবেক এই শাসক দলকে শহীদে পরিণত করতে পারে। আওয়ামী লীগের জন্য এখনো অনেক সমর্থন বিদ্যমান, যদিও তা ততটা দৃশ্যমান নয়। এই দলটিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত রাখলে তা বাংলাদেশকে দুর্নীতিগ্রস্ত বা মৌলবাদী শক্তির হাতে তুলে দেওয়ার শামিল হতে পারে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে কতটা শাস্তি দেওয়া উচিত, সে ব্যাপারে ভোটারদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ওই দলের যে কমবয়সী সমর্থকেরা হাসিনা-পর্বের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন করে শুরু করতে চান, তাদের রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে উৎসাহিত করা ইউনূস প্রশাসনের জন্য সঠিক পদক্ষেপ হবে। কিন্তু দলটি যদি নিবন্ধন হারায় এবং নিষিদ্ধ থাকে, তবে তা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ হওয়ার দরকার নেই। বাংলাদেশের প্রধান গুণ হলো দেশটি সরকারের স্পিরিটে চলে, এর প্রাণবন্ত সুশীল সমাজের কারণে নয়। দেশটির সম্পদশালী মানুষজন জানে কীভাবে বাঁচতে ও সমৃদ্ধি লাভ করতে হয়।
বাংলাদেশের সামনের পথটি চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ। গত জুলাইয়ে যে আশা জ্বলে উঠেছিল, তা হয়তো নিভে গেছে, কিন্তু ধ্বংস হয়ে যায়নি। গণতান্ত্রিক নবজাগরণের স্বপ্ন পূরণের জন্য কেবল একজন স্বৈরশাসকের পতনই যথেষ্ট নয়; এর জন্য প্রয়োজন হবে প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন, সবার অধিকার রক্ষা এবং সমন্বিত রাজনীতি গড়ে তোলার প্রতি অবিচল অঙ্গীকার।
ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি অপেক্ষমান জাতি হিসেবেই থেকে যাবে, যতদিন দেশটি তার অতীতের ছায়া এবং একটি উন্নত ভবিষ্যতের ভঙ্গুর প্রতিশ্রুতির মাঝে ঝুলে থাকবে।
(ফরেন পলিসির সৌজন্যে প্রকাশিত)