বিজ্ঞাপনে এআইয়ের ‘প্রতারণা’, বুঝতেই পারছে না কেউ

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
বিজ্ঞাপনে এআইয়ের ‘প্রতারণা’, বুঝতেই পারছে না কেউ
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। ছবি: রয়টার্স

২২ বছর বয়সী এক তরুণী তার প্রথম চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য এআইয়ের কাছে পরামর্শ চাইল। এআই তাকে পোশাকের ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া শুরু করলো। পরামর্শটি ভালো নাকি খারাপ–বোঝার উপায় কি আছে? এই তথ্য কি স্পন্সরের মাধ্যমে এসেছে?

বিজ্ঞাপন থেকে ক্যারিয়ার কাউন্সিলরদের চেয়ে বেশি আয় করে পোশাক বিক্রেতারা। তবে এআই কি সেইদিকে হাঁটছে? হাঁটলেও ব্যবহারকারীরা কখনোই জানতে পারবে না।

অতীতের প্রযুক্তিগুলো আমাদের কাছে তথ্য সরবরাহ করতো। এর মধ্যে টিভির বিজ্ঞাপন বা গুগল সার্চ ইঞ্জিনের ওপরে বা পাশে স্পন্সর করা ফলাফল থাকতো। কিন্তু এআই আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। আমরা এআইয়ের সঙ্গে কথা বলি, সমস্যা জানাই এবং পরামর্শ নিই। এই কথোপকথনের সময় বিজ্ঞাপনগুলো এমনভাবে মিশে যায়–তা আলাদা করা প্রায় অসম্ভব।

সত্যিকার অর্থে সাহায্য করার জন্য এআইকে কোনো ব্যক্তির লক্ষ্য, ব্যক্তিত্ব ও মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা বুঝতে হয়। এই ব্যক্তিগত জ্ঞান এআইকে যেমন নিখুঁত করে তোলে, তেমনই নিখুঁত নিয়ন্ত্রক বা প্রতারক করে তুলতে পারে। একজন চিকিৎসক এবং একজন দক্ষ প্রতারক একই ধরনের মানবিক বোধ ব্যবহার করে।

প্রথাগত বিজ্ঞাপনগুলো যেখানে পরিষ্কারভাবে বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দেয়, সেখানে এআইয়ে থাকা বিজ্ঞাপনগুলো নির্দিষ্ট বিষয়কে প্রাধান্য দিতে পারে, বিশেষ শব্দ ব্যবহার করতে পারে। অথচ এআই নিরপেক্ষ থাকার ভান ধরে। যা কেবল পণ্য প্রতিষ্ঠিত করা নয়, আস্থার মৌলিক লঙ্ঘন।

এআই সিস্টেম নির্দিষ্ট কৌশল ব্যবহার করার জন্য তৈরি করা হয় না। তবে ব্যবহারকারীর ব্যস্ততা বাড়ানো বা কেনাকাটার আচরণকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে এআই কাজ করে। যদি বিজ্ঞাপনের আয় একটি সাফল্যের মাপকাঠি হয়, তবে এআই নিজেই মানুষের দুর্বলতা কাজে লাগানোর কৌশল তৈরি করবে।

এটি হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক ম্যানিপুলেশন, যা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে। এআই কোনো ব্যক্তির আগের কথোপকথন থেকে জানা দুর্বলতা, আবেগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধরন ব্যবহার করে প্রভাবিত করতে পারে।

কেউ যখন নিরপেক্ষ পরামর্শের জন্য এআই প্রযুক্তির সাহায্য চায় এবং যদি সেই প্রযুক্তিই গ্রাহকের মন বুঝে স্পনসর করা কন্টেন্ট সামনে নিয়ে আসে, তবে মানুষের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে

এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে প্রথাগত এবং অনলাইন বিজ্ঞাপনের জন্য শক্তিশালী নিয়ম তৈরি করেছে ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি)। কিন্তু এআই যদি ‘ট্রায়াল অ্যান্ড ইরোর’–এর মাধ্যমে শেখে। কথোপকথনকে একটু ঘুরিয়ে দিলেই বিক্রি বৃদ্ধি পাবে। তখন মানুষ তাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে?

গুগল ইতোমধ্যেই তার চ্যাটবটে বিজ্ঞাপন পরীক্ষা করছে। ওপেনএআই এবং ইলন মাস্কের গ্রকও বিজ্ঞাপন ইন্টিগ্রেশন নিয়ে কাজ করছে। মাস্কের মতে, “যদি কোনো ব্যবহারকারী কোনো সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে, তবে সেই সময়ে নির্দিষ্ট সমাধানটির বিজ্ঞাপন দেওয়াই ঠিক হবে।”

তাহলে প্রশ্ন হলো, কোনটা ঠিক?

প্রতিটি বড় প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম প্রায় একই পথে চলে। প্রথমে ব্যবহারকারীর জ্ঞান নিয়ে ভালো অভিজ্ঞতা তৈরি করার চেষ্টা করে। তারপর যখন প্রবৃদ্ধি কমে যায়, তখন বিজ্ঞাপন ও ডেটা বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন শুরু করে।

লেখক ও প্রযুক্তি বিষয়ক সমালোচক কোরি ডক্টরো এই প্রক্রিয়াকে ‘এনশিটিফিকেশন’ বলেন। বিষয়টি এমন, যখন প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতার চেয়ে বিজ্ঞাপন থেকে আয়কে অগ্রাধিকার দেয়, তখন প্রোডাক্টের মান কমে যেতে থাকে।

আমরা কি এমন এআই সঙ্গী চাই, যা আমাদের মৌলিক চিন্তা করার জন্য সাহায্য করে? নাকি এমন এআই চাই, যা আমাদের পছন্দকে প্রভাবিত করার জন্য আমাদের ব্যক্তিগত মুহূর্ত এবং চিন্তাভাবনা থেকে কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ তৈরি করে?

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

প্রযুক্তিবিদরা সতর্ক করেছেন, সিদ্ধান্তটি এখনও আমাদের হাতে আছে, তবে খুব বেশি দিনের জন্য নয়।

এআই ব্যক্তিগত জীবনের এত গভীরে প্রবেশ করেছে, সেখানে বিজ্ঞাপনের অনুপ্রবেশ একটি গভীর নৈতিক ও নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। স্বাধীন চিন্তাভাবনা ও আস্থার জন্য এটি হুমকিস্বরূপ।

সম্পর্কিত