কেন কর্মীরা বদলাচ্ছে, আর বসদের কীভাবে বদলাতে হবে

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
কেন কর্মীরা বদলাচ্ছে, আর বসদের কীভাবে বদলাতে হবে
সাম্প্রতিক চাকরি ছাঁটাইয়ের পরও কর্মীরা নিজেদের মূল্য কমতে দিচ্ছে না। ছবি: ফ্রিপিক

আজকের কর্মজগতে একটি কথাই সবচেয়ে বেশি শোনা যায়-“এখন আর কেউ কঠোর পরিশ্রম করতে চায় না। বড় বড় কোম্পানির নেতারা অভিযোগ করেন, নতুন প্রজন্ম কাজের জন্য ততটা ‘ক্ষুধার্ত’ নয়। অথচ যখন নিয়োগ চলছে, তখন সেই কোম্পানিগুলোই আগের মতো উচ্চাভিলাষী, সর্বস্ব দিয়ে কাজ করা কর্মীদের খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো- নতুন প্রজন্ম চাকরিতে যোগ দিয়েই তাদের অধিকার, প্রত্যাশা আর সীমারেখার কথা স্পষ্ট বলে দেয়। তারা চায় নমনীয়তা, ব্যক্তিজীবনের ভারসাম্য এবং নিজের শর্তে কাজ করার সুযোগ।

এতে ম্যানেজার ও বসেরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কারণ পুরোনো চাকরি সংস্কৃতিতে ‘আগে কঠোর পরিশ্রম, পরে স্বাধীনতা’- এই ছিল নীতি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। সাম্প্রতিক চাকরি ছাঁটাইয়ের পরও কর্মীরা নিজেদের মূল্য কমতে দিচ্ছে না। নমনীয়তা, মানসিক স্বাস্থ্যের সুবিধা, রিমোট কাজের সুযোগ–এসব চাকরির বিজ্ঞাপনই প্রমাণ করে প্রত্যাশা বদলে গেছে।

বিগত বছরগুলোতে কাজের সংস্কৃতি অনেক বদলেছে। ছবি: ফ্রিপিক
বিগত বছরগুলোতে কাজের সংস্কৃতি অনেক বদলেছে। ছবি: ফ্রিপিক

মানুষ আসলে বদলায়নি, বদলেছে কাজের ধরন

মানুষ সবসময়ই চেয়েছে কাজের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখতে, বড় কাজে অবদান রাখতে, অর্থপূর্ণ কিছু তৈরি করতে। কিন্তু এখন তারা বুঝতে পারছে, জীবন কেবল অফিসের চার দেওয়ালের ভেতর আটকা নয়। কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, জীবন আর কাজের ভারসাম্য বলতে কী বোঝায়। আগে প্রশ্ন ছিল, ‘জীবনকে কীভাবে কাজের মধ্যে ফিট করাব?’ এখন পরিস্থিতি উল্টে গেছে। এখন বেশিরভাগ কর্মীরা কাজকে জীবনের মধ্যে ফিট করাতে চায়।

গার্টনারের সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ৬৫% মানুষ মহামারির পর কাজের ভূমিকা নতুনভাবে ভাবতে শিখেছে। তারা চায় আরও মানবিক কর্মপরিবেশ, যেখানে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হবে, কেবল কর্মী হিসেবে নয়।

নতুন প্রজন্মের পরিষ্কার সীমারেখা

একটি শীর্ষ কনসাল্টিং ফার্মের মাত্র ২২ বছর বয়সী নতুন কর্মীর সঙ্গে এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কথা হয়। সংস্থাটি দীর্ঘ সময়ের কঠিন শিডিউলের জন্য পরিচিত। কিন্তু নতুন কর্মীরা শুরুতেই বলে দিচ্ছে, কী মানলে তারা থাকবে আর কী মানলে বিদায় নেবে।

অন্যদিকে, নেতৃত্ব উন্নয়ন সেশনে শীর্ষ নির্বাহীরা নিজেরাই বলছেন, তারা এ বছরে ব্যক্তিগত সুস্থতা, পরিবার বা নিজের প্রকল্পে মনোযোগ দিতে চান। ভাবুন, যারা পদোন্নতি নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের সামনেই এ কথা বলছেন! মানসিকতা যে পুরো বদলে গেছে, সেটিই এর প্রমাণ।

নতুন চাকরি-চুক্তি: স্বাধীনতা এবং ফলাফল

ম্যাককিনসির ২০২২ সালের আমেরিকান অপর্চুনিটি সার্ভে বলছে, ৮৭% কর্মী চান কখন, কোথায় এবং কীভাবে কাজ করবেন–তা নিজেরাই ঠিক করতে। অর্থাৎ শুধু বেতন নয়, ‘এজেন্সি’ বা নিজের কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ চাইছে তারা।

অনেকে মনে করেন রিমোট বা হাইব্রিড টিম কত ঘণ্টা কাজ করছে তা জানা কঠিন। ছবি: ফ্রিপিক
অনেকে মনে করেন রিমোট বা হাইব্রিড টিম কত ঘণ্টা কাজ করছে তা জানা কঠিন। ছবি: ফ্রিপিক

নেতাদের উচিত এই নতুন মানসিকতাকে স্বীকার করে নেওয়া। সেরা প্রতিভা ধরে রাখতে চাইলে অনুপ্রেরণার নতুন পদ্ধতি খুঁজতে হবে।

সেই পথেই আসে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-

আবেগের নতুন সংজ্ঞা স্বীকার করা

আজকের কর্মীরা ‘ক্ষুধার্ত’ হতে চায় না, তারা ‘পরিপূর্ণ’ হতে চায়। তাদের কাছে সাফল্য মানে শুধু পদোন্নতি নয়, নিজেকে সৃষ্টিশীল রাখা, সুস্থ থাকা, ভালো থাকা। প্রশ্ন উঠছে, একজন কর্মী যদি প্রতিদিন ঠিকঠাক কাজ শেষে বিকেলে দৌড়ের প্রশিক্ষণে যায়, সে কি কম যোগ্য? কেউ যদি পদোন্নতি না নিয়ে নিজের বর্তমান কাজটাই ভালোবাসে, সেটি কি ভুল? নেতাদের উচিত কর্মীদের আবেগ, আগ্রহ ও জীবনধারাকে সম্মান করা। আবেগী কর্মীই কোম্পানিকে এগিয়ে নেয়।

“আমি এভাবে করেছি, তাই তুমিও করবে”–এই মানসিকতা বাদ দিন

পুরোনো প্রজন্মের কর্মজীবন ছিল কঠোর, আগে এসে দেরি করে অফিস ছাড়ো, সপ্তাহান্তে কাজ করো, তারপর হয়তো স্বাধীনতা পাবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘মরীচিকা’ ছাড়া কিছুই ছিল না। কিন্তু এখন প্রযুক্তি, রিমোট কাজ, অটোমেশন, সব মিলিয়ে সেই পথ আর একমাত্র পথ নয়। বসদের ভাবতে হবে, আমি কষ্ট করেছি বলেই কি সবাইকে কষ্ট করতে হবে? নাকি সময় বদলেছে, তাই কাজের ধরনও বদলানো উচিত? বরং নতুন প্রজন্মকে পুরোনো অভিজ্ঞতার দিকে নিচে নামানোর বদলে, সবাইকে নতুন, উন্নত মানে তোলাই উত্তম।

“আমি এভাবে করেছি, তাই তুমিও করবে”- বসদের এই মানসিকতা থেকে বেরোতে হবে। ছবি: ফ্রিপিক
“আমি এভাবে করেছি, তাই তুমিও করবে”- বসদের এই মানসিকতা থেকে বেরোতে হবে। ছবি: ফ্রিপিক

সময় নয়-পারফরম্যান্স দিয়ে কাজ যাচাই

অনেক ম্যানেজার বা সুপারভাইজার মনে করেন রিমোট বা হাইব্রিড টিম কত ঘণ্টা কাজ করছে, তা জানা কঠিন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কারও কর্মঘণ্টা আপনি আগে কখনোই সঠিকভাবে জানতেন না। অফিসেও অকারণে সময় নষ্ট করা হতো। বরং লক্ষ্য হওয়া উচিত, সময় নয়, ফলাফল মাপা। যারা নিজের মতো করে কাজ করতে পারে, তারা নিজেকে বেশি দায়বদ্ধ মনে করে এবং কাজ দায়িত্বের সঙ্গে ভালোভাবে করে। এটাই নতুন কর্মচুক্তি, স্বাধীনতা ও দায়িত্ব দুই-ই থাকবে।

নিয়ন্ত্রণ বাড়াবেন না, কমান

নেতারা যখন দেখেন নিয়ন্ত্রণ কমছে, তারা বেশি নজরদারি করতে চান। ট্র্যাকিং সফটওয়্যার, কঠোর নিয়ম, বা ‘না মানলে চলে যাও’-এর মতো হুমকি। কিন্তু ভয় কখনোই দীর্ঘমেয়াদে প্রডাক্টিভিটি বাড়ায় না। ২০২০-২১ সালে মহামারির সময়ে অফিস পুরোপুরি বন্ধ থাকলেও প্রডাক্টিভিটি বেড়েছিল। অর্থাৎ স্বাধীনতা এর শত্রু নয়–বরং অনেক সময় এর উৎস।

মানুষ তখনই সেরা কাজ করে যখন তারা নিজের জীবনেও ভালো থাকে। কাজ ও জীবনের ভারসাম্য, স্বাধীনতা, নমনীয়তা- এগুলো বিলাসিতা নয়, এখনকার কর্মজগতের বাস্তবতা। বসদের উচিত এই নতুন বাস্তবতাকে স্বীকার করা। কারণ কর্মীদের ওপর বিশ্বাস, তাদের আবেগকে মূল্য দেওয়া এবং স্বাধীনতা দেওয়ার মাধ্যমেই টিকে থাকার মতো, টেকসই প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যায়।

তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড বিজনেজ রিভিউ-এর ওয়েবসাইট

সম্পর্কিত