গৌতম কুমার রায়
স্বাধীনতা একটা চেতনা। তা কেউ নিতে যেমন পারে না, আবার তা কাউকে কেউ দিতেও পারে না। এই চেতনার সাথে রয়েছে সাহস ও গৌরবের স্পর্শ। আবার স্বাধীনতার ধ্যান-ধারণায় হীনমন্যতার কোনো স্থান নেই। ভয়ভীতি ও সংকোচবোধ হলো স্বাধীনতার শত্রু।
১৯৭১ আমাদের স্বাধীনতার গৌরবের বছর। এ সময়ে জালেম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তাদের এদেশীয় দোসর, রাজাকার, আলবদরেরা তাদের বিষাক্ত দন্ত ও নখরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপর। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের ফলে আমরা পেয়েছিলাম বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন-স্বাধীনতাকে। স্বাধীনতা অর্জন করতে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত, জীবন, মায়েদের সম্ভ্রম, নির্যাতন ও তাদের আত্মোৎসর্গ আমাদের মোক্ষম এই অর্জনকে কাছে পেতে সাহায্য করে। হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচার, নিপীড়ন–কত ভয়াবহ ছিল, তা উপলদ্ধি করতে ‘নিউজ উইকে’র ১৯৭২ সালের ২ আগস্ট পত্রিকার একটি শিরোনামই যথেষ্ট।
পত্রিকায় লিখেছিল ‘গ্রামের সহজ সরল যুবকদের এক জায়গায় জড়ো করা হলো। হালুয়াঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর এক মেজর যুবকদেরকে বলল, আহত পাকিস্তানি এক সেনার জন্য রক্তের প্রয়োজন, তারা তাকে রক্ত দেবে কিনা? পরে ওই যুবকদেরকে ভাঙা-ফাটা চৌকিতে শুইয়ে দিয়ে তাদের শরীরে সূঁচ ঢোকানো হলো। শরীর থেকে শেষ রক্ত ফোটা শূন্য না হওয়া পর্যন্ত যুবকদের শরীর থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হলো। তারপর তাদের প্রত্যেকের মৃত্যু হলো রক্তশূন্যতায়।’’
স্বাধীনতা যুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলার সাহসী ও গৌরবময় ইতিহাস সর্বজন স্বীকৃত। বৃহত্তর এ জেলায় উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার প্রথম সূর্য। এখানকার মাটিতে বসেই শপথ গ্রহণ করেন দেশের অস্থায়ী সরকার। অকুতোভয় সূর্য সন্তানেরা পরাস্ত ও নিধন করে ইনসাফ বর্জিত পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলায় প্রায় ৫০ হাজার নিরীহ মানুষকে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী ধরে নৃংশসভাবে জবাই ও গুলি করে হত্যা করে নদীর পারে, রেলব্রিজসহ বিভিন্ন জায়গায় এবং তাদের নিথর দেহগুলোকে ফেলে দেয় যত্রতত্র স্থানে। এই সূর্যসন্তানদের নিথর দেহগুলোতে কখনো হামলে ধরেছে শকুনের সূচাল ঠোঁট, আবার কখনো শেয়ালের ধারাল দাঁত, রাজাকারদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস। স্বাধীনতার গত চুয়ান্ন বছরে কুষ্টিয়ার ২৭টি বধ্যভূমি আজও অবহেলিত। কয়েকটিতে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেই দায়মুক্ত হয়েছি আমরা। তা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।
অপারেশন কুষ্টিয়া
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। রাত ১.৩০ মিনিট। কোথাও কোনো শব্দ নেই। তবে আছে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ও ভয়। গভীর রাতে গাড়ির তীব্র আওয়াজ এবং সার্চলাইটের তীব্রতায় মেজর শোয়েব, ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ, লেফটেন্যান্ট আতাউল্লা শাহ্–এর নেতৃত্বে বেলুচ রেজিমেন্টের ২১৬ সৈন্য কুষ্টিয়া শহর দখল করে নেয়।
ঠিক তার পরদিন শহরের কেয়া হলের কাছে কুষ্টিয়াতে প্রথম শহীদ হন রনী নামের একজন। এর পর মুক্তিযোদ্ধারা, সময় ও কৌশল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ২৯ মার্চ আক্রমণের দিন নির্ধারণ করা হলেও ইপিআর সুবেদার মোজাফফর সাহেব আসতে একদিন দেরি করাতে পরদিন; অর্থাৎ, ৩০ মার্চ কুষ্টিয়ার চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ শুরু করে। এর সাথে নতুন মাত্রায় যোগ হয় সাধারণ জনগণের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের সমন্বিত শক্তি।
পাকিস্তানিদের অত্যাচারের মাত্রা এতটাই ছিল যে, তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণার কারণে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিরোধ করতে রাস্তায় নেমে আসে। ওই দিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কুষ্টিয়া শহরের জেলা স্কুল ক্যাম্প বাদে বাকি পুরো অংশ শত্রুমুক্ত হয়েছিল। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিক কুমার ঘোষ গুরুতর আহত হন। শহীদ হন ৩০ মুক্তিযোদ্ধা। তার মধ্যে মিরপুরের দেলোয়ার, মেহেরপুর জেলার বামনপাড়ার আ. রশীদ, দুধকুমড়া গ্রামের হামেদ আলী, মেহেরপুরের ফজলুর রহমান, মশান গ্রামের গোলাম শেখ ও হাচেন আলীর পরিচয় সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল।
কুষ্টিয়া শহরের দখল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হাতছাড়া হওয়ার পর পাকিস্তানিরা পালিয়ে গিয়ে প্রতিশোধ নিতে পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা কষতে লাগল। এদিকে জেলা স্কুলে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা ক্রমে তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলছিল। এ কারণে ১ এপ্রিল ভোরে দুটি জিপ ও একটি ডজ গাড়িতে করে তারা ৪০-৫০ জনের একটি দল বেরিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে মহাসড়ক ধরে ঝিনাইদহ মুখে রওনা হয়।
গাড়াগঞ্জের কাছে ব্রিজের মুখে আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা গর্ত করে তার মুখ পলিথিনে ঢেকে তার ওপর পিচের আবরণ দিয়ে রাখে। না বুঝে পাকিস্তানি বাহিনী এর ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলে দুটো জিপই পড়ে যায় এবং মেজর শোয়েবসহ কয়েকজন মারা যায়। অন্যদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ্ গুলি করতে করতে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে, তাদের লাঠির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়। ওই দলের কয়েকজন সদস্য কুষ্টিয়ার হাতিয়া গ্রাম দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ওই গ্রামের জব্বার ও ইব্রাহিমকে হত্যা করে। পরে গ্রামবাসী লাঠি, ফালা, বল্লম, সড়কিসহ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্যদের তারা বন্দী করে এবং পরে হত্যা করে।
এদিকে জেলা স্কুলের মিলনায়তনের মঞ্চের নিচ থেকে ১২ জন নারীর ক্ষত–বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। ১১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আবার কুষ্টিয়া শহরে বিমান হামলা চালায়। ১২ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে তাদের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে জেলখানার উপরে পড়ে। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া আবার হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তারা প্রথমেই শহরের প্রধান সড়কের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং গান পাউডার ব্যবহার করে তা মাটিতে গুড়িয়ে দিতে থাকে। অবশেষে ১১ ডিসেম্বরে এই শহর হানাদারমুক্ত হয়।
কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধে চৌড়হাঁসের যুদ্ধটা হানাদার ও মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে স্মরণীয়। এ যুদ্ধে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এ যুদ্ধের পর পাকিস্তান বাহিনী যেন মরিয়া হয়ে ওঠে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং শুরু করে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। প্রতিদিন শত শত নিরিহ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় হত্যা করা হতো। রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর দেওয়া গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান বাহিনী গ্রাম ও শহর থেকে অসংখ্য মানুষকে ধরে নিয়ে জবাই ও গুলি করে পাখির মতো হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। রেল ব্রিজের নিচে গণকবর দেওয়া হতো। বিশাল মাঠে একসঙ্গে চার-পাঁচজনকে কোনোরকম মাটিচাপা দিয়ে রাখত তারা। আর শহর থেকে ধরে নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে কুষ্টিয়া শহরের কয়া রেলব্রিজ, গড়াই নদীর খেয়াঘাট, চাঁদমারী গড়াই নদীর পারে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত। আজও সেসব ভয়াবহ স্মৃতি অনেকের মনে পড়ে। যুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে পাকিস্তান বাহিনী গ্রামে মুক্তিবাহিনীর হাতে পরাজিত হওয়ার পর শহরের হানা দেওয়া শুরু করে। কয়া রেল ব্রিজের ওপর দিয়ে গোয়ালন্দ থেকে আসা তাদের একটি নতুন বাহিনী কুষ্টিয়া শহরে আকষ্মিক হামলা শুরু করে। এ হামলায় অনেক মানুষ নিজ ঘরেই প্রাণ হারায়। আবার এ দেশীয় আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা রাজাকার আর আলবদর বাহিনীর হাতে কুষ্টিয়া শহরের কোহিনুর ভিলায় ১৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন–রবিউল হক, বেগম রবিউল, রবিউল, মান্নান, হান্নান, আফরোজা, অশরাফ, আনু, আসাদ, বাতাসি, জরিনা, আরশেদ আলী ও তার স্ত্রী, রেজাউল হক ও রিজিয়া খাতুন। তারপর তাদের বাড়ির পেছনে নিয়ে গণকবর দেওয়া হয়।
বংশীতলা
১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া সদর উপজেলা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আমাদের দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা পড়ন্ত বিকেলে দূর্বাচারা ক্যাম্পে বিশ্রাম নিতে যাবেন। এমন সময় জেলার কুমারখালী উপজেলার দুধকুমড়া গ্রামের রাজাকার কমান্ডার আমজাদ হোসেন ফটিকের লেখা গোপন একটা চিরকুট মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসে। সেই চিঠিতে ছিল ৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিযেদ্ধাদের ক্যাম্পে সম্ভাব্য আক্রমণের তথ্য। চিঠিটি মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করে। ফটিকের ছোট ভাই ফেরদৌসকে ভুলবশত রাজাকার মনে করে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে গেলে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধারাই তাকে ছাড়িয়ে আনেন। সেই কৃতজ্ঞতার কারণে রাজাকার কমান্ডার ফটিক পাকিস্থানি বাহিনীর অনেক গোপন সংবাদ জানিয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করতেন। ফটিকের তথ্যকে বিবেচনায় নিয়ে ওইদিন সকালে সব মুক্তিযোদ্ধাকে বংশীতলাতে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ পালন করেন মুক্তিযোদ্ধারা। যথাসময়ে মুক্তিযোদ্ধারা দূর্বাচারার প্রায় দেড় কিলোমিটার আগে বংশীতলায় এসে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করতে প্রস্তুতি নেয়। মুক্তিযোদ্ধদের আয়ত্তের মধ্যে আসামাত্রই উভয়পক্ষের মধ্যে শুরু হয় তুমূল যুদ্ধ। এটিই জেলার প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। এ যুদ্ধে প্রায় ৭০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং চরমভাবে পরাজিত হয়। আর পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব, খোরশেদ আলম, তাজু, দীদার, সরোয়ার, শহিদুল, রাজ্জাক , মিরাজসহ আরও কয়েকজন।
বিত্তিপাড়া
বিত্তিপাড়া বদ্ধভূমি দেশের সবচেয়ে বড়, যা সর্বোচ্চসংখ্যক মুক্তিকামী মানুষের নিধন এলাকা হিসেবে বিবেচিত। কুষ্টিয়া–ঝিনাইদহ মহাসড়কের কারণে আশপাশের বিভিন্ন এলাকার সাথে এখানকার যোগাযোগ ছিল ভালো। আর এটি ব্যবহার করে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিপাগল মানুষকে ধরে এনে এবং বাস থেকে লোকজনকে নামিয়ে বিত্তিপাড়াতে নিধন করা হতো। একটি তথ্যমতে এখানে নয় মাসের যুদ্ধে প্রায় ৪ হাজার ব্যাক্তিকে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হয়। তারা এমনকি অনেককে এখানে জীবন্ত মাটি চাপাও দিত। এদের অনেকের মৃত্যু সংবাদটুকু আজও তাদের স্বজনেরা পায়নি। এদের অনেকে ছিলেন ছাত্র, শ্রমিক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।
দৌলতপুর
কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুরের মুক্তিকামী মানুষের আত্মত্যাগের স্মৃতিকে আজো বহন করে রেখেছে উপজেলার ক্যাম্পাসে ইউএনও’র বাসা ও সেখানকার পুকুরের পেছনের বধ্যভূমি। এখানে আজও চিরনিদ্রায় শায়িত আছে শতশত নারী-পুরুষ। উপজেলার গোয়ালগ্রামে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে কবর দেওয়া হয়েছিল। এই বধ্যভূমি আজও অরক্ষিত। বড়গাংদিয়ার ঘোগাতে চারজন মুক্তিযোদ্ধার সমাহিত স্মৃতি আজও অম্লান। প্রাগপুর বাজারে উচ্চবিদ্যালয়ের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের গণকবর এখন স্মৃতি শুধু। এখানে বধ্যভূমির ওপর এখন জনৈক ব্যক্তির বাড়ি। এ ছাড়া হোসেনাবাদের তহশিলদারের আঙিনার কুয়াটি নরপশুদের কসাইবৃত্তির পরিচয়কে এখনো স্মরণ করিয়ে দেয়। এসব বধ্যভূমি স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৪০ বছর পরও অনাদৃত ও অবহেলিত।
এভাবে কুষ্টিয়া শহর, ছয়টি উপজেলার প্রায় ২৭টি জায়গায় নিরীহ মানুষকে ধরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায়। কিন্তু সেসব বধ্যভূমির অনেকগুলোই সংরক্ষণ করা হয়নি। আবার এর বাইরেও জেলায় অনেক বধ্যভূমি রয়েছে, যা এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়নি। তবে সাম্প্রতিককালে কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড বর্তমান প্রজন্মের মাঝে স্বাধীনতার ইতিহাস, বধ্যভূমির সংরক্ষণ করতে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।
কুষ্টিয়ার চিহ্নিত ২৭টি বধ্যভূমিতে ১৯৭১ সালে প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। তার পর তাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, কাউকে রেল ব্রিজের নিচে বা নদীর চরে কিংবা মাঠে পুঁতে রাখা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়নি অন্য বধ্যভূমিগুলো। আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে এসব বধ্যভূমির সংরক্ষণ জরুরি।
গৌতম কুমার রায়: গবেষক, উদ্ভাবক ও পরিবেশ বিজ্ঞানী
স্বাধীনতা একটা চেতনা। তা কেউ নিতে যেমন পারে না, আবার তা কাউকে কেউ দিতেও পারে না। এই চেতনার সাথে রয়েছে সাহস ও গৌরবের স্পর্শ। আবার স্বাধীনতার ধ্যান-ধারণায় হীনমন্যতার কোনো স্থান নেই। ভয়ভীতি ও সংকোচবোধ হলো স্বাধীনতার শত্রু।
১৯৭১ আমাদের স্বাধীনতার গৌরবের বছর। এ সময়ে জালেম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তাদের এদেশীয় দোসর, রাজাকার, আলবদরেরা তাদের বিষাক্ত দন্ত ও নখরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপর। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের ফলে আমরা পেয়েছিলাম বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন-স্বাধীনতাকে। স্বাধীনতা অর্জন করতে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত, জীবন, মায়েদের সম্ভ্রম, নির্যাতন ও তাদের আত্মোৎসর্গ আমাদের মোক্ষম এই অর্জনকে কাছে পেতে সাহায্য করে। হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচার, নিপীড়ন–কত ভয়াবহ ছিল, তা উপলদ্ধি করতে ‘নিউজ উইকে’র ১৯৭২ সালের ২ আগস্ট পত্রিকার একটি শিরোনামই যথেষ্ট।
পত্রিকায় লিখেছিল ‘গ্রামের সহজ সরল যুবকদের এক জায়গায় জড়ো করা হলো। হালুয়াঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর এক মেজর যুবকদেরকে বলল, আহত পাকিস্তানি এক সেনার জন্য রক্তের প্রয়োজন, তারা তাকে রক্ত দেবে কিনা? পরে ওই যুবকদেরকে ভাঙা-ফাটা চৌকিতে শুইয়ে দিয়ে তাদের শরীরে সূঁচ ঢোকানো হলো। শরীর থেকে শেষ রক্ত ফোটা শূন্য না হওয়া পর্যন্ত যুবকদের শরীর থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হলো। তারপর তাদের প্রত্যেকের মৃত্যু হলো রক্তশূন্যতায়।’’
স্বাধীনতা যুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলার সাহসী ও গৌরবময় ইতিহাস সর্বজন স্বীকৃত। বৃহত্তর এ জেলায় উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার প্রথম সূর্য। এখানকার মাটিতে বসেই শপথ গ্রহণ করেন দেশের অস্থায়ী সরকার। অকুতোভয় সূর্য সন্তানেরা পরাস্ত ও নিধন করে ইনসাফ বর্জিত পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলায় প্রায় ৫০ হাজার নিরীহ মানুষকে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী ধরে নৃংশসভাবে জবাই ও গুলি করে হত্যা করে নদীর পারে, রেলব্রিজসহ বিভিন্ন জায়গায় এবং তাদের নিথর দেহগুলোকে ফেলে দেয় যত্রতত্র স্থানে। এই সূর্যসন্তানদের নিথর দেহগুলোতে কখনো হামলে ধরেছে শকুনের সূচাল ঠোঁট, আবার কখনো শেয়ালের ধারাল দাঁত, রাজাকারদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস। স্বাধীনতার গত চুয়ান্ন বছরে কুষ্টিয়ার ২৭টি বধ্যভূমি আজও অবহেলিত। কয়েকটিতে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেই দায়মুক্ত হয়েছি আমরা। তা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।
অপারেশন কুষ্টিয়া
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। রাত ১.৩০ মিনিট। কোথাও কোনো শব্দ নেই। তবে আছে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ও ভয়। গভীর রাতে গাড়ির তীব্র আওয়াজ এবং সার্চলাইটের তীব্রতায় মেজর শোয়েব, ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ, লেফটেন্যান্ট আতাউল্লা শাহ্–এর নেতৃত্বে বেলুচ রেজিমেন্টের ২১৬ সৈন্য কুষ্টিয়া শহর দখল করে নেয়।
ঠিক তার পরদিন শহরের কেয়া হলের কাছে কুষ্টিয়াতে প্রথম শহীদ হন রনী নামের একজন। এর পর মুক্তিযোদ্ধারা, সময় ও কৌশল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ২৯ মার্চ আক্রমণের দিন নির্ধারণ করা হলেও ইপিআর সুবেদার মোজাফফর সাহেব আসতে একদিন দেরি করাতে পরদিন; অর্থাৎ, ৩০ মার্চ কুষ্টিয়ার চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ শুরু করে। এর সাথে নতুন মাত্রায় যোগ হয় সাধারণ জনগণের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের সমন্বিত শক্তি।
পাকিস্তানিদের অত্যাচারের মাত্রা এতটাই ছিল যে, তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণার কারণে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিরোধ করতে রাস্তায় নেমে আসে। ওই দিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কুষ্টিয়া শহরের জেলা স্কুল ক্যাম্প বাদে বাকি পুরো অংশ শত্রুমুক্ত হয়েছিল। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিক কুমার ঘোষ গুরুতর আহত হন। শহীদ হন ৩০ মুক্তিযোদ্ধা। তার মধ্যে মিরপুরের দেলোয়ার, মেহেরপুর জেলার বামনপাড়ার আ. রশীদ, দুধকুমড়া গ্রামের হামেদ আলী, মেহেরপুরের ফজলুর রহমান, মশান গ্রামের গোলাম শেখ ও হাচেন আলীর পরিচয় সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল।
কুষ্টিয়া শহরের দখল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হাতছাড়া হওয়ার পর পাকিস্তানিরা পালিয়ে গিয়ে প্রতিশোধ নিতে পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা কষতে লাগল। এদিকে জেলা স্কুলে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা ক্রমে তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলছিল। এ কারণে ১ এপ্রিল ভোরে দুটি জিপ ও একটি ডজ গাড়িতে করে তারা ৪০-৫০ জনের একটি দল বেরিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে মহাসড়ক ধরে ঝিনাইদহ মুখে রওনা হয়।
গাড়াগঞ্জের কাছে ব্রিজের মুখে আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা গর্ত করে তার মুখ পলিথিনে ঢেকে তার ওপর পিচের আবরণ দিয়ে রাখে। না বুঝে পাকিস্তানি বাহিনী এর ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলে দুটো জিপই পড়ে যায় এবং মেজর শোয়েবসহ কয়েকজন মারা যায়। অন্যদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ্ গুলি করতে করতে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে, তাদের লাঠির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়। ওই দলের কয়েকজন সদস্য কুষ্টিয়ার হাতিয়া গ্রাম দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ওই গ্রামের জব্বার ও ইব্রাহিমকে হত্যা করে। পরে গ্রামবাসী লাঠি, ফালা, বল্লম, সড়কিসহ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্যদের তারা বন্দী করে এবং পরে হত্যা করে।
এদিকে জেলা স্কুলের মিলনায়তনের মঞ্চের নিচ থেকে ১২ জন নারীর ক্ষত–বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। ১১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আবার কুষ্টিয়া শহরে বিমান হামলা চালায়। ১২ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে তাদের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে জেলখানার উপরে পড়ে। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া আবার হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তারা প্রথমেই শহরের প্রধান সড়কের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং গান পাউডার ব্যবহার করে তা মাটিতে গুড়িয়ে দিতে থাকে। অবশেষে ১১ ডিসেম্বরে এই শহর হানাদারমুক্ত হয়।
কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধে চৌড়হাঁসের যুদ্ধটা হানাদার ও মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে স্মরণীয়। এ যুদ্ধে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এ যুদ্ধের পর পাকিস্তান বাহিনী যেন মরিয়া হয়ে ওঠে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং শুরু করে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। প্রতিদিন শত শত নিরিহ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় হত্যা করা হতো। রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর দেওয়া গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান বাহিনী গ্রাম ও শহর থেকে অসংখ্য মানুষকে ধরে নিয়ে জবাই ও গুলি করে পাখির মতো হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। রেল ব্রিজের নিচে গণকবর দেওয়া হতো। বিশাল মাঠে একসঙ্গে চার-পাঁচজনকে কোনোরকম মাটিচাপা দিয়ে রাখত তারা। আর শহর থেকে ধরে নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে কুষ্টিয়া শহরের কয়া রেলব্রিজ, গড়াই নদীর খেয়াঘাট, চাঁদমারী গড়াই নদীর পারে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত। আজও সেসব ভয়াবহ স্মৃতি অনেকের মনে পড়ে। যুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে পাকিস্তান বাহিনী গ্রামে মুক্তিবাহিনীর হাতে পরাজিত হওয়ার পর শহরের হানা দেওয়া শুরু করে। কয়া রেল ব্রিজের ওপর দিয়ে গোয়ালন্দ থেকে আসা তাদের একটি নতুন বাহিনী কুষ্টিয়া শহরে আকষ্মিক হামলা শুরু করে। এ হামলায় অনেক মানুষ নিজ ঘরেই প্রাণ হারায়। আবার এ দেশীয় আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা রাজাকার আর আলবদর বাহিনীর হাতে কুষ্টিয়া শহরের কোহিনুর ভিলায় ১৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন–রবিউল হক, বেগম রবিউল, রবিউল, মান্নান, হান্নান, আফরোজা, অশরাফ, আনু, আসাদ, বাতাসি, জরিনা, আরশেদ আলী ও তার স্ত্রী, রেজাউল হক ও রিজিয়া খাতুন। তারপর তাদের বাড়ির পেছনে নিয়ে গণকবর দেওয়া হয়।
বংশীতলা
১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া সদর উপজেলা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আমাদের দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা পড়ন্ত বিকেলে দূর্বাচারা ক্যাম্পে বিশ্রাম নিতে যাবেন। এমন সময় জেলার কুমারখালী উপজেলার দুধকুমড়া গ্রামের রাজাকার কমান্ডার আমজাদ হোসেন ফটিকের লেখা গোপন একটা চিরকুট মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসে। সেই চিঠিতে ছিল ৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিযেদ্ধাদের ক্যাম্পে সম্ভাব্য আক্রমণের তথ্য। চিঠিটি মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করে। ফটিকের ছোট ভাই ফেরদৌসকে ভুলবশত রাজাকার মনে করে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে গেলে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধারাই তাকে ছাড়িয়ে আনেন। সেই কৃতজ্ঞতার কারণে রাজাকার কমান্ডার ফটিক পাকিস্থানি বাহিনীর অনেক গোপন সংবাদ জানিয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করতেন। ফটিকের তথ্যকে বিবেচনায় নিয়ে ওইদিন সকালে সব মুক্তিযোদ্ধাকে বংশীতলাতে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ পালন করেন মুক্তিযোদ্ধারা। যথাসময়ে মুক্তিযোদ্ধারা দূর্বাচারার প্রায় দেড় কিলোমিটার আগে বংশীতলায় এসে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করতে প্রস্তুতি নেয়। মুক্তিযোদ্ধদের আয়ত্তের মধ্যে আসামাত্রই উভয়পক্ষের মধ্যে শুরু হয় তুমূল যুদ্ধ। এটিই জেলার প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। এ যুদ্ধে প্রায় ৭০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং চরমভাবে পরাজিত হয়। আর পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব, খোরশেদ আলম, তাজু, দীদার, সরোয়ার, শহিদুল, রাজ্জাক , মিরাজসহ আরও কয়েকজন।
বিত্তিপাড়া
বিত্তিপাড়া বদ্ধভূমি দেশের সবচেয়ে বড়, যা সর্বোচ্চসংখ্যক মুক্তিকামী মানুষের নিধন এলাকা হিসেবে বিবেচিত। কুষ্টিয়া–ঝিনাইদহ মহাসড়কের কারণে আশপাশের বিভিন্ন এলাকার সাথে এখানকার যোগাযোগ ছিল ভালো। আর এটি ব্যবহার করে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিপাগল মানুষকে ধরে এনে এবং বাস থেকে লোকজনকে নামিয়ে বিত্তিপাড়াতে নিধন করা হতো। একটি তথ্যমতে এখানে নয় মাসের যুদ্ধে প্রায় ৪ হাজার ব্যাক্তিকে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হয়। তারা এমনকি অনেককে এখানে জীবন্ত মাটি চাপাও দিত। এদের অনেকের মৃত্যু সংবাদটুকু আজও তাদের স্বজনেরা পায়নি। এদের অনেকে ছিলেন ছাত্র, শ্রমিক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।
দৌলতপুর
কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুরের মুক্তিকামী মানুষের আত্মত্যাগের স্মৃতিকে আজো বহন করে রেখেছে উপজেলার ক্যাম্পাসে ইউএনও’র বাসা ও সেখানকার পুকুরের পেছনের বধ্যভূমি। এখানে আজও চিরনিদ্রায় শায়িত আছে শতশত নারী-পুরুষ। উপজেলার গোয়ালগ্রামে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে কবর দেওয়া হয়েছিল। এই বধ্যভূমি আজও অরক্ষিত। বড়গাংদিয়ার ঘোগাতে চারজন মুক্তিযোদ্ধার সমাহিত স্মৃতি আজও অম্লান। প্রাগপুর বাজারে উচ্চবিদ্যালয়ের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের গণকবর এখন স্মৃতি শুধু। এখানে বধ্যভূমির ওপর এখন জনৈক ব্যক্তির বাড়ি। এ ছাড়া হোসেনাবাদের তহশিলদারের আঙিনার কুয়াটি নরপশুদের কসাইবৃত্তির পরিচয়কে এখনো স্মরণ করিয়ে দেয়। এসব বধ্যভূমি স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৪০ বছর পরও অনাদৃত ও অবহেলিত।
এভাবে কুষ্টিয়া শহর, ছয়টি উপজেলার প্রায় ২৭টি জায়গায় নিরীহ মানুষকে ধরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায়। কিন্তু সেসব বধ্যভূমির অনেকগুলোই সংরক্ষণ করা হয়নি। আবার এর বাইরেও জেলায় অনেক বধ্যভূমি রয়েছে, যা এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়নি। তবে সাম্প্রতিককালে কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড বর্তমান প্রজন্মের মাঝে স্বাধীনতার ইতিহাস, বধ্যভূমির সংরক্ষণ করতে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।
কুষ্টিয়ার চিহ্নিত ২৭টি বধ্যভূমিতে ১৯৭১ সালে প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। তার পর তাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, কাউকে রেল ব্রিজের নিচে বা নদীর চরে কিংবা মাঠে পুঁতে রাখা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়নি অন্য বধ্যভূমিগুলো। আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে এসব বধ্যভূমির সংরক্ষণ জরুরি।
গৌতম কুমার রায়: গবেষক, উদ্ভাবক ও পরিবেশ বিজ্ঞানী