বাংলাদেশে অস্থিরতা, উদ্ধারের উপায় কী?

বাংলাদেশে অস্থিরতা, উদ্ধারের উপায় কী?

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই গুলি করা হয় ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদিকে। বাংলাদেশ ফের উত্তাল পরিস্থিতির দিকে যেতে থাকে। রাজনৈতিক নেতারা একে অপরকে দুষতে থাকেন। আর গত ১৮ ডিসেম্বর ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর আসার পর আরও উত্তাল হয় দেশ। হামলা হয় সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এযাবৎকালের সবচেয়ে তিক্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এসব ছাপিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে এখন একটাই প্রশ্ন–এই অস্থিরতা থেকে কবে মুক্তি মিলবে? নির্বাচন নিয়েও সংশয় রয়েছে অনেকের মনে। কেউ কেউ রাজনীতিকদের মধ্যে ঐক্যের ওপর জোর দিলেও অদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে সম্পর্কও নতুন করে ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং চট্টগ্রামের ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভের জেরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভিসা সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। গত রোববার (২১ ডিসেম্বর) ভারত চট্টগ্রামের ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র থেকে সেবা প্রদান অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেয়।

এর একদিন পরই সোমবার (২২ ডিসেম্বর) দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনও ভারতীয়দের জন্য ভিসা ও কনস্যুলার সেবা স্থগিতের ঘোষণা দেয়। ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ হচ্ছে–মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে এনডিটিভি, ইন্ডিয়া টুডেসহ বেশ কয়েকটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম।

এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মঙ্গলবারই সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আমরা অবশ্যই ভারতের সাথে ভালো সম্পর্ক করতে চাই। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি কোনোভাবেই যেন ভারতের মতো বড় প্রতিবেশীর সাথে তিক্ত সম্পর্ক না হোক। ভারতের সাথে আমাদের ট্রেড এবং পলিসি আলাদা করে দেখতে হবে। ভারতের সাথে সম্পর্ক খুব খারাপ হবে না। সম্পর্ক বাইরে যতটা শোনা যায়, বাস্তবে অতটা খারাপ নয়।”

হাদির মারা যাওয়ার খবরের পর ভাঙচুর চালানো হয় ছায়ানটে। ছবি: চরচা
হাদির মারা যাওয়ার খবরের পর ভাঙচুর চালানো হয় ছায়ানটে। ছবি: চরচা

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “ভারতের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আর কূটনৈতিক সম্পর্ক আলাদা। রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করতে অন্তবর্তী সরকার কাজ করছে।”

তাহলে উপায় কী?

বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই স্থগিতাদেশ সম্ভবত একটি সাময়িক পদক্ষেপ। তবে এটি বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে ভারতের গভীর উদ্বেগের প্রতিফলন। হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হচ্ছে।

ভারতের হরিয়ানার ও পি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেন, “যদিও বর্তমান পরিস্থিতি কঠিন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না, তবে এটি একটি সাময়িক প্রতিবন্ধকতা। আশা করা যায়, উভয় পক্ষই পুনরায় তাদের সম্পৃক্ততা শুরু করবে। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরই কেবল স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।”

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ৮৫ বছর বয়সী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস গত সপ্তাহে হাদির ওপর গুলিবর্ষণকে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের ‘সুপরিকল্পিত হামলা’হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যারা জাতীয় নির্বাচন নস্যাৎ করতে চায়। তবে তিনি অভিযুক্ত ষড়যন্ত্রকারীদের কারও নাম প্রকাশ করেননি।

শ্রীরাধা দত্ত আরও জানান, সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে নিকট ভবিষ্যতে ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করা বেশ কঠিন বলেই মনে হচ্ছে।

শ্রীরাধা দত্ত বলেন, সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক হলেও এর অর্থ এই নয় যে, উগ্রবাদী ইসলামি গোষ্ঠীগুলো দেশ দখল করে নিয়েছে, যেমনটি ভারতের কিছু পর্যবেক্ষক আশঙ্কা করছেন। তিনি বলেন, “যদিও এটি স্পষ্ট যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সহিংসতা মোকাবিলায় অত্যন্ত অদক্ষ বলে মনে হয়েছে। তবে এ ধরনের প্রতিবাদ বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। পুরো দেশের নয়।”

ক্ষতিগ্রস্ত ডেইলি স্টার ভবন। ছবি: চরচা
ক্ষতিগ্রস্ত ডেইলি স্টার ভবন। ছবি: চরচা

দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষজ্ঞ এবং লন্ডনভিত্তিক লেখক প্রিয়জিৎ দেব সরকার বলেন, ‘‘নির্বাচন নিরাপদে সম্পন্ন করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে এই অস্থিরতা প্রশ্ন তুলেছে। সহিংস ঘটনা ও বিক্ষোভ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটেছে এবং তা কেবল একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ ছিল না।”

প্রিয়জিৎ বলেন, “এগুলোকে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা বলা চলে না। এই বিক্ষোভকারীরা এমন সব প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা চালাচ্ছে, যারা বহুত্ববাদী নীতির মূল ভিত্তিগুলোকে ধরে রেখেছে।”

লক্ষ্যবস্তু হওয়া সংবাদপত্র দুটি (প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার) আগে হাসিনা সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত ছিল উল্লেখ করে প্রিয়জিৎ বলেন, যদি বিক্ষোভকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল কোনো গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসে, তবে গণমাধ্যম এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

‘মুশকিল আসান’ নির্বাচন?

কিছু বিশ্লেষক বলছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে ‘সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল’বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যদি এই মাসে তার স্বেচ্ছায় নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন, তবে রাজনৈতিক চিত্র আবারও পাল্টে যেতে পারে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তারেক রহমানের দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। যদিও তার মা দলের চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতার সঙ্গে লড়াই করছেন।

প্রিয়জিৎ দেব সরকার মনে করছেন, বিএনপি যদি নির্বাচনে জয়ী হয়, তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তার মতে, অতীতে ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতার কারণে দলটি রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল সম্পর্কে পরিচিত। তিনি বলেন, “তারা জানে কীভাবে দেশ চালাতে হয় এবং তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।”

স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীলঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে ভারতে যে উদ্বেগ রয়েছে, তা মূলত বৃহত্তর আঞ্চলিক ধর্মীয় মেরুকরণের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যখন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট, তখন এই উদ্বেগ আরও জোরালো হচ্ছে।”

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকেও ইঙ্গিত করেন নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, যেখানে সেনাবাহিনী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে।

গত মে মাসে ভারত ও পাকিস্তান একটি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তীব্র সামরিক সংঘাতে লিপ্ত হয়। এবার ভারতের নতুন উদ্বেগ, ইসলামাবাদ হয়তো উভয় দেশের উগ্রপন্থী ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এই অনেকগুলো দুশ্চিন্তা দূর এবং পুরো অঞ্চলের সম্পর্ক স্থিতিশীল করতে সহায়তা করতে পারে। তবে এই ‘আভাস’বাস্তবে পরিণত হবে কি না, তা সময়েই বলে দেবে।

সম্পর্কিত