কাজী সাজিদুল হক

লুচি। বাঙালির ঘরের অন্যতম এই পদ নিয়ে মানুষের আবেগ কম নয়। আলুর তরকারি হোক বা মাংস কিংবা সুজির হালুয়া/ মোহনভোগের সঙ্গে লুচি থাকলে সকাল কিংবা সন্ধ্যার খাবার সাক্ষাৎ স্বর্গ হয়ে ওঠে অনেকের কাছে। ঢাকার মতো ব্যস্ত নগরীতে বাসা-বাড়িতে লুচি হয়ত দৈনন্দিন তৈরি হয় না। কিন্তু রাজধানীতে কাবাব-চাপের সঙ্গে লুচি খেতে অনেকেই মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বেইলি রোডে চলে যান। লুচি বাঙালির ঘরে অনেক দিন ধরেই রাজত্ব করলেও এর নামটি এসেছে হিন্দি শব্দ থেকে। চলুন তাহলে লুচির তত্ত্ব-তালাশ করা যাক।
কোথা থেকে লুচি এলো
লুচি তৈরি মূল উপাদান ময়দা। আর ময়দা আসে গম থেকে। গম এই উপমহাদেশে বসবাস করছে বহু বহু বছর ধরে। পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো সিন্ধু সভ্যতায় গম চাষের প্রধান মিলেছে। অর্থাৎ এই উপমহাদেশের আদি পুরুষদের মধ্যে গম থেকে তৈরি নানা পদের প্রচলন ছিল ধরেই নেওয়া যায়। হিন্দি ভাষায় নির্মিত ধারবাহিক তথ্যচিত্র ‘রাজা, রসুই অর কাহানিয়া’তে বলা হয়েছে আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার পর তাদের খাদ্যাভ্যাসে চালের প্রভাব বেশি দেখা যায়। সেই সময় আর্যরা গমকে নিচু শ্রেণির মানুষের খাবার হিসেবে মনে করত। এ থেকেও বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের মধ্যে গম থেকে তৈরির খাবারের জনপ্রিয়তা ছিল।
লুচির বর্ণনা প্রথম পাওয়া যায় একটি আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত বইয়ে। সুশ্রুতের ভেষজ শাস্ত্রের পুঁথি নিয়ে প্রথম ভাষ্য লেখেন চক্রপাণি দত্ত। তিনি বাঙালি ছিলেন। পাল যুগের বিখ্যাত এই চিকিৎসক তার ‘দ্রব্যগুণ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সুমিতায়া ঘৃতাক্তায়া লোপ্ত্রীং কৃত্বা চ বেল্লয়েৎ। আজ্যে তাং ভর্জয়েৎ সিদ্ধাং শষ্কুলী ফেনিকা গুণাঃ।।’ যার বাংলা অর্থ হল, ‘গম চূর্ণকে ঘি দিয়ে মেখে, লেচি করে বেলে, গরম ঘিয়ে ভেজে তৈরী হয় শষ্কুলী, যার গুণ ফেনিকার (খাজা) মত’। এই শষঙ্কুলীই হচ্ছে আজকের লুচি।
তা হলে লুচিকে আদি বাঙালি খাবারগুলোর একটি সিংহাসনে বসানো যেতেই পারে। চক্রপাণি দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, লুচির তিন প্রকার। সেগুলো হলো- খাস্তা, সাপ্তা ও পুরি। বেশি করে ময়ান দিয়ে ময়দা দিয়ে যা তৈরি করা হতো তা ছিল খাস্তা লুচি। ময়ান ছাড়া ময়দা দিয়ে তৈরি লুচি ছিল সাপ্তা লুচি। আর ময়দার পরিবর্তে আটা দিয়ে যে লুচি তৈরি হত তা ছিল পুরি। পাল যুগের সেই খাস্তা লুচিই বর্তমানের প্রচলিত লুচি। সাধারণ বাঙালি বাড়িতে এই খাস্তা লুচিই তৈরি হয়।

আটা দিয়ে যে পুরি তথা লুচির কথা বলা হচ্ছে তা এখনকার ভারতের উত্তরাংশের প্রচলিত খাবার।
কিন্তু ‘লুচি’ শব্দটি এলো কীভাবে? জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির চতুর্থ প্রজন্মের মানুষ ঋতেন্দ্র নাথ ঠাকুর ‘মুদীর দোকান’ বইয়ে লিখেছেন, “কোন সংস্কৃত প্রাচীন গ্রন্থেই ‘লুচি’, ‘লুচিকা’ অথবা লুচির অনুরূপ শব্দ কোন খাদ্যদ্রব্যের নামরূপে পাওয়া যায় না। ‘লুচি’ বস্তুত সংস্কৃত শব্দপ্রসূত নহে। কি মাহাভারতাদি পুরাণ, কি বৈদিক গ্রন্থ কি আয়ুর্ব্বেদীয় গ্রন্থ কোথাও ‘লুচি’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় না। ভার প্রকাশের ন্যায় গন্থে যাহাতে ‘রুটী’ ‘পুরী’ প্রভৃতি আধুনিক প্রায় সকল প্রকার খাবারের প্রস্তুত প্রণালী লিখিত আছে তাহাতে কিন্তু লুচির কোন উল্লেখ নাই। লুচি দেশজ অর্থাৎ বাঙ্গালার প্রাকৃত শব্দও নহে। লুচির মূল হিন্দি ভাষায়। লুচি প্রকৃতপক্ষে হিন্দি শব্দ। অথচ আশ্চর্য্য যে এক্ষণে বঙ্গবাসীরা যেরূপ লুচির ভক্ত হিন্দুস্থানীয়রা তাহার একাংশও নহে….।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র ঋতেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “কোন জিনিস হাত হইতে পিছলিয়া পড়িবার মত হইলে হিন্দিতে ‘লুচ্-যাতা’ বলে। আবার কোন কোমল পিচ্ছিল দ্রব্যকে ‘লুচ্লুচিয়া’ বলে। লুচি সচরাচর ঘৃতে পিচ্ছিল থাকে বলিয়াই হিন্দিভাষায় ‘লুচি’ নাম প্রাপ্ত হইয়া থাকিবে।”
ঋতেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বিশ্বকোষে ‘লুচি’ দেশজ শব্দ অর্থাৎ বাঙ্গলার প্রাকৃত শব্দ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে তাহা ভ্রমাত্মক।
‘রামচরিতমানস’-এর লেখক সন্তকবি তুলসী দাস লিখেছেন, “পূর্বে ভিক্ষা করলে মেড়ুয়ার আটা মিলত না। কিন্তু এখন রাম নামের প্রতাপে দুবেলা লুচি পাচ্ছি।”
তবে অনেকের মতে, লুচি সংস্কৃত শব্দ ‘লোচক’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘চোখের মনি’। লুচি যেহেতু চোখের মনির মত গোল তা বোঝাতেই এই রকম নামকরণ।

লুচি। বাঙালির ঘরের অন্যতম এই পদ নিয়ে মানুষের আবেগ কম নয়। আলুর তরকারি হোক বা মাংস কিংবা সুজির হালুয়া/ মোহনভোগের সঙ্গে লুচি থাকলে সকাল কিংবা সন্ধ্যার খাবার সাক্ষাৎ স্বর্গ হয়ে ওঠে অনেকের কাছে। ঢাকার মতো ব্যস্ত নগরীতে বাসা-বাড়িতে লুচি হয়ত দৈনন্দিন তৈরি হয় না। কিন্তু রাজধানীতে কাবাব-চাপের সঙ্গে লুচি খেতে অনেকেই মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বেইলি রোডে চলে যান। লুচি বাঙালির ঘরে অনেক দিন ধরেই রাজত্ব করলেও এর নামটি এসেছে হিন্দি শব্দ থেকে। চলুন তাহলে লুচির তত্ত্ব-তালাশ করা যাক।
কোথা থেকে লুচি এলো
লুচি তৈরি মূল উপাদান ময়দা। আর ময়দা আসে গম থেকে। গম এই উপমহাদেশে বসবাস করছে বহু বহু বছর ধরে। পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো সিন্ধু সভ্যতায় গম চাষের প্রধান মিলেছে। অর্থাৎ এই উপমহাদেশের আদি পুরুষদের মধ্যে গম থেকে তৈরি নানা পদের প্রচলন ছিল ধরেই নেওয়া যায়। হিন্দি ভাষায় নির্মিত ধারবাহিক তথ্যচিত্র ‘রাজা, রসুই অর কাহানিয়া’তে বলা হয়েছে আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার পর তাদের খাদ্যাভ্যাসে চালের প্রভাব বেশি দেখা যায়। সেই সময় আর্যরা গমকে নিচু শ্রেণির মানুষের খাবার হিসেবে মনে করত। এ থেকেও বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের মধ্যে গম থেকে তৈরির খাবারের জনপ্রিয়তা ছিল।
লুচির বর্ণনা প্রথম পাওয়া যায় একটি আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত বইয়ে। সুশ্রুতের ভেষজ শাস্ত্রের পুঁথি নিয়ে প্রথম ভাষ্য লেখেন চক্রপাণি দত্ত। তিনি বাঙালি ছিলেন। পাল যুগের বিখ্যাত এই চিকিৎসক তার ‘দ্রব্যগুণ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সুমিতায়া ঘৃতাক্তায়া লোপ্ত্রীং কৃত্বা চ বেল্লয়েৎ। আজ্যে তাং ভর্জয়েৎ সিদ্ধাং শষ্কুলী ফেনিকা গুণাঃ।।’ যার বাংলা অর্থ হল, ‘গম চূর্ণকে ঘি দিয়ে মেখে, লেচি করে বেলে, গরম ঘিয়ে ভেজে তৈরী হয় শষ্কুলী, যার গুণ ফেনিকার (খাজা) মত’। এই শষঙ্কুলীই হচ্ছে আজকের লুচি।
তা হলে লুচিকে আদি বাঙালি খাবারগুলোর একটি সিংহাসনে বসানো যেতেই পারে। চক্রপাণি দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, লুচির তিন প্রকার। সেগুলো হলো- খাস্তা, সাপ্তা ও পুরি। বেশি করে ময়ান দিয়ে ময়দা দিয়ে যা তৈরি করা হতো তা ছিল খাস্তা লুচি। ময়ান ছাড়া ময়দা দিয়ে তৈরি লুচি ছিল সাপ্তা লুচি। আর ময়দার পরিবর্তে আটা দিয়ে যে লুচি তৈরি হত তা ছিল পুরি। পাল যুগের সেই খাস্তা লুচিই বর্তমানের প্রচলিত লুচি। সাধারণ বাঙালি বাড়িতে এই খাস্তা লুচিই তৈরি হয়।

আটা দিয়ে যে পুরি তথা লুচির কথা বলা হচ্ছে তা এখনকার ভারতের উত্তরাংশের প্রচলিত খাবার।
কিন্তু ‘লুচি’ শব্দটি এলো কীভাবে? জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির চতুর্থ প্রজন্মের মানুষ ঋতেন্দ্র নাথ ঠাকুর ‘মুদীর দোকান’ বইয়ে লিখেছেন, “কোন সংস্কৃত প্রাচীন গ্রন্থেই ‘লুচি’, ‘লুচিকা’ অথবা লুচির অনুরূপ শব্দ কোন খাদ্যদ্রব্যের নামরূপে পাওয়া যায় না। ‘লুচি’ বস্তুত সংস্কৃত শব্দপ্রসূত নহে। কি মাহাভারতাদি পুরাণ, কি বৈদিক গ্রন্থ কি আয়ুর্ব্বেদীয় গ্রন্থ কোথাও ‘লুচি’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় না। ভার প্রকাশের ন্যায় গন্থে যাহাতে ‘রুটী’ ‘পুরী’ প্রভৃতি আধুনিক প্রায় সকল প্রকার খাবারের প্রস্তুত প্রণালী লিখিত আছে তাহাতে কিন্তু লুচির কোন উল্লেখ নাই। লুচি দেশজ অর্থাৎ বাঙ্গালার প্রাকৃত শব্দও নহে। লুচির মূল হিন্দি ভাষায়। লুচি প্রকৃতপক্ষে হিন্দি শব্দ। অথচ আশ্চর্য্য যে এক্ষণে বঙ্গবাসীরা যেরূপ লুচির ভক্ত হিন্দুস্থানীয়রা তাহার একাংশও নহে….।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র ঋতেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “কোন জিনিস হাত হইতে পিছলিয়া পড়িবার মত হইলে হিন্দিতে ‘লুচ্-যাতা’ বলে। আবার কোন কোমল পিচ্ছিল দ্রব্যকে ‘লুচ্লুচিয়া’ বলে। লুচি সচরাচর ঘৃতে পিচ্ছিল থাকে বলিয়াই হিন্দিভাষায় ‘লুচি’ নাম প্রাপ্ত হইয়া থাকিবে।”
ঋতেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বিশ্বকোষে ‘লুচি’ দেশজ শব্দ অর্থাৎ বাঙ্গলার প্রাকৃত শব্দ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে তাহা ভ্রমাত্মক।
‘রামচরিতমানস’-এর লেখক সন্তকবি তুলসী দাস লিখেছেন, “পূর্বে ভিক্ষা করলে মেড়ুয়ার আটা মিলত না। কিন্তু এখন রাম নামের প্রতাপে দুবেলা লুচি পাচ্ছি।”
তবে অনেকের মতে, লুচি সংস্কৃত শব্দ ‘লোচক’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘চোখের মনি’। লুচি যেহেতু চোখের মনির মত গোল তা বোঝাতেই এই রকম নামকরণ।