পাইলটরা মানসিক অসুস্থতার তথ্য গোপন করে কেন

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
পাইলটরা মানসিক অসুস্থতার তথ্য গোপন করে কেন
মানসিক স্বাস্থ্যের তথ্য কাউকে জানায় না পাইলটেরা। ছবি: রয়টার্স

অ্যানি ভার্গাস বুঝতে পারছিলেন, তার ছেলে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। এ কারণে তিনি তাকে চিকিৎসা নিতেও অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তার ছেলে ডেলটা এয়ারলাইনসের পাইলট ও তিন সন্তানের জনক ৪১ বছর বয়সী ব্রায়ান উইটকে বলেছিলেন, বিষণ্নতার চিকিৎসা নিলে তার লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। তিনি চাকরি হারাতে পারেন বলে ভয়ও পাচ্ছেন। করোনা মহামারির সময় উইটকে বাড়িতে সময় কাটাতেন। আর এটি তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছিল বলে জানান ভার্গাস।

২০২২ সালের ১৪ জুন সকালে ভার্গাস তার ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তাকে পাচ্ছিলেন না। পরে দেখা গেল, উইটকে তার বাড়ির কাছাকাছি সল্ট লেক সিটির বাইরে ইউটা পর্বতমালায় আত্মহত্যা করেছেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, বাণিজ্যিক এয়ারলাইনসের পাইলটরা প্রায়ই তাদের মানসিক সমস্যাগুলো লুকিয়ে রাখেন। কারণ থেরাপি, ওষুধ ব্যবহার বা শুধু মানসিক চিকিৎসা-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করলে লাইসেন্স বাতিল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এতে শুধু তারা নিজেদের নয়, যাত্রীদের জীবনও ঝুঁকিতে ফেলেন।

রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এসব তথ্যই জানান পাইলট, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও এ খাতের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা।

এই প্রতিবেদনের জন্য আমেরিকা ও বিদেশি এয়ারলাইনসের কমপক্ষে ২৪ জন বাণিজ্যিক পাইলটের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। তারা বলেন, মানসিক সমস্যা যতই ক্ষুদ্র বা নিরাময়যোগ্য হোক না কেন, তারা তা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করেন। কারণ এর ফলে সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ, ব্যয়বহুল চিকিৎসা-পর্যালোচনা শুরু হতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত তাদের ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে পারে। মানসিক সমস্যার কথা সামনে না আনার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণ। যেমন–এয়ারলাইনসের নীতি-সম্পর্কিত শর্তাবলী এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতা।

বাস্তব জীবনের বাস্তব সমস্যা
ভার্গাস রয়টার্সকে বলেন, তিনি তার ছেলের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। কারণ তিনি আশা করেছিলেন যে, তার পরিবারের এই ঘটনা বিমান চলাচল শিল্পে বিদ্যমান মানসিক স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনবে। তিনি বলেন, ‘‘মানুষের জীবনে বিভিন্ন সমস্যা থাকে। এবং এসব সামলানোর জন্য তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত নয়।’’

উইটকের মৃত্যুর পর ডেলটা এয়ারলাইনস জানায়, তিনি তাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তার মৃত্যু দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক। সংস্থাটি আরও বলেছে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে গেলে পাইলটদের মধ্যে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার অনুভূতি কাজ করে।

অন্যান্য বড় মার্কিন এয়ারলাইনস কোম্পানির মতো ডেলটাও তাদের কর্মীদের জন্য গোপনে কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করে। সম্প্রতি তারা পাইলটদের জন্য একটি নতুন কর্মসূচি চালু করেছে, যেখানে থেরাপি ও কোচিংয়ের সুযোগ রয়েছে। চিকিৎসা সনদ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয়তাগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে একজন ব্যক্তিকে কোনো চিকিৎসা বা মানসিক চিকিৎসা নিতে হলে নিয়োগকর্তা বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে না জানালেও চলে। কিন্তু বিমান চলাচল খাত কঠোর মানদণ্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। এফএএ (ফেডারাল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) মেডিকেল সার্টিফিকেশন বজায় রাখতে পাইলটদের কঠোর শারীরিক ও মানসিক মানদণ্ড পূরণ করতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে প্রতি ছয় মাস পরপর মেডিকেল পরীক্ষা দিতে হয়। পাইলটরা যদি উদ্বেগ বা বিষণ্নতার কথা জানান, তবে তাদের উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এরপর কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত ছাড়পত্র মিললেও গুরুতর অবস্থায় এফএএর বিস্তৃত পর্যালোচনার জন্য এক বছর বা তার বেশি সময় লাগতে পারে।

এফএএ এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা পাইলটদের মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান আধুনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়মিতভাবে আধুনিক করছে।

পাইলটদের মেনে চলতে হয় কঠোর নিয়ম। ছবি: রয়টার্স
পাইলটদের মেনে চলতে হয় কঠোর নিয়ম। ছবি: রয়টার্স

নিষেধাজ্ঞার ভয়
এক দশক আগে বিষণ্নতায় আক্রান্ত জার্মানউইংসের এক পাইলট একটি এ–৩২০ বিমান ইচ্ছাকৃতভাবে ফ্রান্সের একটি পর্বতে বিধ্বস্ত করেন। তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। কিন্তু এখন পর্যন্তও বৈশ্বিক বিমান শিল্প পাইলটদের মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যার জন্য একটি অভিন্ন কাঠামো তৈরি করতে পারেনি।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এভিয়েশন সেফটি এজেন্সি বিমানসংস্থাগুলোকে পাইলটদের জন্য পিয়ার-সাপোর্ট প্রোগ্রাম চালুর বিধান আবশ্যক করেছে এবং মেডিকেল পরীক্ষকদের ওপর তদারকি আরও জোরদার করেছে। বিষণ্নতা ও অন্যান্য মানসিক রোগের জন্য তাদের অনুমোদিত ওষুধের তালিকা তৈরি করেছে আমেরিকা। পাশাপাশি এয়ারলাইনস ও পাইলট ইউনিয়নগুলো গোপন পিয়ার-সাপোর্ট প্রোগ্রামও সম্প্রসারিত করেছে।

অস্ট্রেলিয়ার সিভিল এভিয়েশন সেফটি অথরিটি (সিএএসএ) বিষণ্নতা ও উদ্বেগে আক্রান্ত পাইলটদের চিকিৎসা চলমান অবস্থায় ক্ষেত্রবিশেষে সনদ বজায় রাখতে দেয়, যদি তারা নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সিএএসএর প্রধান মেডিকেল অফিসার কেট ম্যান্ডারসন বলেন, তার দল সাধারণত ২০ দিনের মধ্যেই এসব সনদ পর্যালোচনা সম্পন্ন করে।

২০২৩ সালে ৫ হাজার ১৭০ জন মার্কিন ও কানাডীয় পাইলটকে নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের অর্ধেকের বেশি চিকিৎসা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। কারণ, তাদের লাইসেন্স হারানোর আশঙ্কা। এই অনুভূতিটাই পাইলটদের মধ্যে এক ধারণার জন্ম দিয়েছে, “যদি তুমি সত্য গোপন না করো, তুমি উড়তেও পারবে না।”

পাইলট ইউনিয়ন এবং শিল্প সংস্থাগুলো এফএএকে তাদের এভিয়েশন রুলমেকিং কমিটির সুপারিশ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে। যেসব পদক্ষেপ পাইলটদের সমস্যা প্রকাশের পর সুরক্ষা দেবে এবং দ্রুত দায়িত্বে ফেরার সুযোগ তৈরি করবে, সেসব ক্ষেত্রে। সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ এফএএকে দুই বছরের মধ্যে এই পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশ দিতে সম্মতি জানায়।

ছাড়পত্র পাওয়ার অপেক্ষা
মার্কিন বাণিজ্যিক এয়ারলাইনসের পাইলট এলিজাবেথ কার্লের (৩৬) জন্য এসব সংস্কার-প্রস্তাব যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর হওয়া দরকার। ২০২১ সালে তিনি অল্প মাত্রার অ্যান্টি-অ্যাংজাইটির ওষুধ গ্রহণের বিষয়টি জানানো মাত্রই প্রশিক্ষণ চলাকালে তার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বাধ্যতামূলক ছয় মাসের অপেক্ষা শেষে, এফএএ-অনুমোদিত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে তাকে আবার ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়। এরপর কর্তৃপক্ষ তার রিপোর্টটি পর্যালোচনা করতে এক বছরেরও বেশি সময় নেয়, শেষে সেটিকে ‘পুরোনো’ বলে পুনরায় পরীক্ষা দিতে বলে।

প্রশিক্ষণের সময় ফ্লাইট ডিসপ্যাচার হিসেবে কাজ করা কার্ল আর্থিক সংকটে পড়েননি। তবে তিনি রয়টার্সকে বলেন, তার ওষুধে সামান্য পরিবর্তন হলে একই দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়ে যেতে পারে।

এফএএর এক মুখপাত্র রয়টার্সকে জানান, সংস্থাটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা হালনাগাদ করছে। কার্লের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি এবং মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা নেওয়া পাইলটদের মেডিকেল রিপোর্ট পর্যালোচনার সময়সীমা প্রকাশ করেননি।

তিনি বলেন, ‘‘আমরা পাইলটদের উৎসাহিত করি যেন মানসিক সমস্যা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশ করেন। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসা পেলে পাইলটের লাইসেন্স বাতিল করা হয় না।
পাইলটদের মানসিক স্বাস্থ্য আবার আলোচনায় আসে গত জুনে, যখন এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৭১ উড্ডয়নের পরপরই বিধ্বস্ত হয়ে ২৬০ জনের মৃত্যু ঘটে। প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায়, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেনি। ভারত সরকার জানায়, দুর্ঘটনার পর এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলটদের অসুস্থতাজনিত ছুটি নেওয়া বেড়েছে। এয়ারলাইনসটি এই ঘটনার পরে পাইলটদের একটি মানসিক সুস্থতা বিষয়ক অ্যাপ ব্যবহারের নির্দেশ দেয়।

গত নভেম্বরে আলাস্কা এয়ারলাইনসের সাবেক পাইলট জোসেফ ডেভিড এমারসনকে তিন বছরের দণ্ড দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে দায়িত্ব-বহির্ভূত সময়ে ককপিটে বসে একটি যাত্রীবাহী বিমানের ইঞ্জিন বন্ধ করার চেষ্টা ও ফ্লাইট ক্রুকে বাধা দেওয়ার অভিযোগ স্বীকারও করেন তিনি। আদালতের নথিপত্রে দেখা যায়, এমারসন পুলিশকে জানান, তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। তাই সাইকেডেলিক মাশরুম নিয়েছিলেন, যা মাঝে মাঝে বিষণ্নতা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

‘‘আমি এখন আগের চেয়ে ভালো পাইলট’’

যখন কোনো পাইলট মানসিক স্বাস্থ্যগত কারণে বিধিনিষেধের শিকার হন, তখন তারা আর্থিক সমস্যায় পড়েন। তাছাড়া অসুস্থতাজনিত ছুটি শেষ হয়ে গেলেও তাদেরকে সাধারণত অক্ষমতা ভাতায় (ডিসএবিলিটি) যুক্ত করা হয়, যা তাদের মূল আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়।

৩৩ বছর বয়সী মার্কিন বাণিজ্যিক এয়ারলাইন পাইলট ট্রয় মেরিট বলেন, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তিনি স্বেচ্ছায় নিজেকে সরিয়ে নেন এবং বুঝতে পারেন বিষণ্নতা ও উদ্বেগ তার নিরাপদে উড্ডয়নের সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এরপর থেকে তিনি ওষুধ সেবন শুরু করেন।

ককপিটে ফিরে আসার মতো স্থিতিশীল অবস্থায় আসতে ওষুধ সেবন করতে হয় এবং একাধিক মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা দিতে হয়, যার কিছু স্বাস্থ্যবীমার আওতায় ছিল না। তিনি রয়টার্সকে বলে, পুরো প্রক্রিয়াটিতে তার প্রায় ১১ হাজার ডলার খরচ হয়েছে।

এফএএর রুলমেকিং কমিটি উল্লেখ করেছে, উচ্চমাত্রার চিকিৎসার খরচ পাইলটদের চিকিৎসা নিতে নিরুৎসাহিত করে। কারণ এটা তাদের নিজেদেরই ব্যয় করতে হয়। গত বছরের এক প্রতিবেদনে কমিটি জানায়, মানসিক রোগ সংক্রান্ত অসুস্থতায় বীমা সুবিধা সাধারণত সীমিত, এমনকি সমন্বিত স্বাস্থ্য পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও।

মেরিট পুনরায় উড্ডয়ন শুরু করার আগে প্রায় ১৮ মাস ককপিট থেকে দূরে ছিলেন এবং তার কোম্পানি থেকে দেওয়া ভাতার ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করছিলেন। তিনি বলেন, যারা চিকিৎসায় দ্রুত সুস্থ হন, তাদের ক্ষেত্রে মেডিকেল সার্টিফিকেটের জন্য পুনরায় আবেদন করতে ছয় মাস অপেক্ষা করার নিয়ম ঠিক নয়। এফএএর উচিত এসব আবেদন ৩০ দিনের মধ্যে পর্যালোচনা করা।

মেরিট বলেন, ‘‘মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এড়িয়ে চলার অর্থ হলো এমন পাইলটদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করা, যারা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যত্নবান না। আর তখনই ককপিটে সমস্যা তৈরি হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাইলটদের আরও ভালো করে তোলে।’’

এর উদাহরণ তিনি নিজেই। সুস্থ হয়ে ওঠার পর তিনি বড় আকারের বিমান এবং সাংহাই ও হংকংয়ের মতো দূরপাল্লার গন্তব্যে উড্ডয়নের জন্য প্রশিক্ষণ নেন, যা একসময় তার কাছে ভীতিকর মনে হতো।

মেরিটের ভাষ্যমতে, ‘‘আমি এখন আগের চেয়ে ভালো পাইলট।’’

সম্পর্কিত