কেবল একটি এয়ারলাইনসের কারণে ভারতের আকাশপথে সংকট, কারণ কী

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
কেবল একটি এয়ারলাইনসের কারণে ভারতের আকাশপথে সংকট, কারণ কী
ভারতের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাজারের ৬৬ শতাংশই ইন্ডিগোর দখলে। ছবি: রয়টার্স

সাধারণভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানের কেন্দ্রে থাকেন বর-কনে। তাদের বিশেষ দিনটিকে আরেকটু আনন্দপূর্ণ করতে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবসহ অনেকে জমায়েত হন। বর-কনের সঙ্গে ছবি তোলেন, নেচে গেয়ে উপভোগ করেন।

কিন্তু যদি এমন হয়, বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, অতিথিরা সবাই চলে এসেছেন অথচ বর-কনেই অনুপস্থিত! শুনতে অদ্ভূত শোনা গেলেও সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতের হুবলি শহরে এমনই এক ঘটনা ঘটেছে।

গত ৩ ডিসেম্বর নিজেদের বিয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেনি মেধা ক্ষিরসাগর ও সংগ্রাম দাস নামে এক দম্পতি। শেষমেষ নিজেদের অনুষ্ঠানে তারা ভার্চুয়ালি ভিডিও কলে যুক্ত হন। কারণ ভারতে নজিরবিহীন ফ্লাইট বিপর্যয়ের কারণে তারা ভেন্যু থেকে কয়েক মাইল দূরে আটকা পড়েছিলেন।

এই ফ্লাইট বিপর্যয়ের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েন ভারতীয়রা। মেধা ও সংগ্রামের ঘটনা তো সামান্য উদাহরণ মাত্র। এমন হাজারো সংকটে পড়েছেন দেশটির সাধারণ জনগণ।

চলতি মাসের শুরুর দিকে কিছু ফ্লাইট দেরি ও বাতিল হওয়ার মাধ্যমে এই সমস্যার সূত্রপাত। এরপর ৫ ডিসেম্বর ভারতের সবচেয়ে বড় এয়ারলাইনস ইন্ডিগো যখন দৈনিক নিজেদের ২ হাজার ৩০০ ফ্লাইটের অর্ধেকই বাতিল করে দেয়, তখন পরিস্থিতি চরমে ওঠে। এতে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ভারতের আকাশপথ।

কিন্তু একটা এয়ারলাইনসের পরিচালনায় তৈরি হওয়া জটিলতা রাতারাতি জাতীয় সমস্যায় রূপ নেওয়ার বিষয়টি সবাইকে বিস্মিত করেছে। ভারতের মতো বৃহৎ একটি অর্থনীতির দেশে এমনটা হওয়ার কথা নয়। এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ইকনোমিস্ট।

এতে বলা হয়েছে, অন্য কোনো বড় অর্থনীতিতে বাজারের ২০ শতাংশের বেশি কোনো একক সংস্থার দখলে না থাকলেও ভারতের পরিস্থিতি ভিন্ন।

ভারতের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাজারের ৬৬ শতাংশই ইন্ডিগোর দখলে। ছবি: রয়টার্স
ভারতের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাজারের ৬৬ শতাংশই ইন্ডিগোর দখলে। ছবি: রয়টার্স

ভারতের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাজারের ৬৬ শতাংশই ইন্ডিগোর দখলে। অন্যদিকে, ডেল্টা, ইউনাইটেড, সাউথওয়েস্ট ও আমেরিকান এয়ারলাইনস- এই চারটি মিলিয়ে আমেরিকার বাজারের ৬৮ শতাংশ ধরে রেখেছে।

তিন বছর আগে আমেরিকায় সাউথওয়েস্ট ইন্ডিগোর মতো একই ধরনের সংকটে পড়লেও অন্যান্য বিমান সংস্থা সহজেই সেই ঘাটতি পুষিয়ে দিতে পেরেছিল। কিন্তু ইন্ডিগোর ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুরো ভারতীয় বিমান চলাচল ব্যবস্থাই যেন একসঙ্গে অচল হয়ে পড়ে।

এই পরিস্থিতির মূল দায় বিমান সংস্থাটিরই। দুই বছর আগে ঘোষণা দেওয়া হলেও, পাইলটদের বিশ্রাম সময় বাড়ানোর নতুন নিয়ম কার্যকরের জন্য তারা যথাযথ প্রস্তুতি নেয়নি।

ইন্ডিগোর আধিপত্য গড়ে উঠেছে অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে অপ্টিমাইজড অপারেশনের ওপর, যেখানে সময়সূচি থাকে খুবই টাইট। নতুন নিয়ম কার্যকর হওয়ায় সেই ব্যবস্থায় খুব একটা নমনীয়তা দেখানো হয়নি। ফলে ছোটখাট বিঘ্ন ঘটতে ঘটতে পুরো নেটওয়ার্কই ভেঙে পড়ে।

মূল দায় ইন্ডিগোর হলেও এই পরিস্থিতির জন্য কমবেশি সবাই দায়ী। কারণ ভারতে বিমান ব্যবসায় মুনাফা করা অনেক কঠিন। জ্বালানির ওপর উচ্চ কর মুনাফা গ্রাস করে ফেলে। আবার বিমানবন্দর পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা, একটি সংস্থার অধীনে দেশের অর্ধেক বেসরকারি বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয় খরচ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। সেইসঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ দেউলিয়া আইন অনেক সময় টালমাটাল বিমান সংস্থাকে রক্ষা করার সুযোগ না দিয়ে সরাসরি বন্ধ করে দেয়।

যে কারণে ইন্ডিগোর এই বিপর্যয়ের পর যাত্রীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেও তারা তেমন বিকল্প খুঁজে পাচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া বাজারের ২৭ শতাংশ ধরে রেখেছে এবং সেটিই একমাত্র উল্লেখযোগ্য বিকল্প।

তাছাড়া আকাশপথ ছাড়া ভারতীয় যাত্রীদের সামনে খুব ভালো বিকল্পও নেই। ভারতে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিস্তৃত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভারতীয় রেলমন্ত্রীর দাবি, তাদের ৮০ শতাংশ ট্রেন সময়মতো চলাচল করে। তবে ট্রেন সময়মতো চললেও যাত্রা খুব একটা সুখকর নাও হতে পারে।

রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া বাজারের ২৭ শতাংশ ধরে রেখেছে। ছবি: রয়টার্স
রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া বাজারের ২৭ শতাংশ ধরে রেখেছে। ছবি: রয়টার্স

কারণ স্টেশনগুলো বিশৃঙ্খল ও নোংরা, বেশির ভাগ ট্রেন ধীরগতির, আর বহু পরিষেবার টিকিট অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সড়ক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে বড় বিনিয়োগ করেছে ভারত। শত শত মাইল এক্সপ্রেসওয়ে, ডুয়াল ক্যারেজওয়ে (মাঝখানে বিভক্তি দিয়ে দ্বিমুখী সড়ক) ও গ্রামীণ সড়ক নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এসব সড়কে রয়েছে লাইসেন্সবিহীন চালক, বিভ্রান্তিকর সাইনবোর্ড, গর্ত, থেমে থাকা যানবাহন ও রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো পশুর মতো বাধা। ফলে ভারতের সড়ক এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনকগুলোর মধ্যে একটি বলে বিবেচিত।

পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দীর্ঘদিনের অগ্রাধিকার। তার সরকার সংযোগব্যবস্থা উন্নত করেছে। কিন্তু এখন কেবল ঝকঝকে বিমানবন্দর, রাস্তা বা নতুন ট্রেন কোচ নয়, প্রয়োজন সড়ক আইনের কঠোর প্রয়োগ, আধুনিক রেল পরিষেবা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিমান চলাচলে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা।

নাহলে মেধা ও সংগ্রামের মতো অন্য কোনো দম্পতিকেও হয়তো বিয়ের সংবর্ধনাতে ভিডিও কলে যোগ দিতে হতে পারে!

সম্পর্কিত