চরচা ডেস্ক

খান একাডেমি একটি জনপ্রিয় অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম। সম্প্রতি একটা বিষয় দেখে শিক্ষকরা অবাক হয়ে যান। খান একাডেমি থেকে কোনো এক অদৃশ্য সহযোগীর সাহায্য নিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের গণিত অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই অদৃশ্য সহযোগী আসলে ‘পিথাগোরাস’। খান একাডেমি তাদের প্ল্যাটফর্মে এআই-সিমুলেশনের মাধ্যমে প্রাচীনকালের অনেক মহান চিন্তাবিদদের সঙ্গে কথোপকথনের সুযোগ দিচ্ছে। আর তাতে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই এখন তাদের বাড়ির কাজ করিয়ে নিতে পারছে।
শিশুরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ফলভোগী এবং একই সঙ্গে গিনিপিগও। সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড টেকনোলজি (সিডিটি) নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, আমেরিকান তরুণরা তাদের বাবা-মায়ের তুলনায় বাড়িতে এআই ব্যবহার করে বেশি। স্কুলেও তারা এআই ব্যবহার করে তাদের বাবা-মায়ের কর্মক্ষেত্রের চেয়ে বেশি।
মোদ্দাকথা, বর্তমান প্রজন্ম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন সু্যোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হচ্ছে, আগের কোনো প্রজন্ম যা কল্পনাও করতে পারেনি। তবে এতে ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
দেশে দেশে স্কুলের পাঠে এআই
দুই বছর আগেও আমেরিকার অধিকাংশ স্কুলে এআই ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন এটি শিক্ষাজীবনের নিয়মিত কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। র্যান্ড করপোরেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী এবং প্রায় ৬৯ শতাংশ শিক্ষক এখন স্কুলের কাজ বা পাঠ পরিকল্পনা সাজানোর জন্য এআই ব্যবহার করে।
সরকারও এই পরিবর্তনকে উৎসাহ দিচ্ছে। এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আমেরিকার স্কুলগুলোর সিলেবাসে এআইয়ের মৌলিক ধারণা অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এআই চালু করেছে সিঙ্গাপুর। আর চীন ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত জাতীয়ভাবে এআই শিক্ষা শুরু করার পরিকল্পনা করছে। হাংঝৌ শহরে অবস্থিত চীনের শীর্ষ এআই প্রতিষ্ঠান ডিপসিকের প্রধান কার্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অন্তত বার্ষিক দশ ঘণ্টা এআই-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
ওয়ার্কশিট, কুইজ ও অ্যাসাইনমেন্টের সময় শিক্ষার্থীরা প্রথমে এআইয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করে পরোক্ষভাবে। কারণ শিক্ষকেরা এটি ব্যবহার করছে দেদারসে। ইংল্যান্ডের ৬৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর করা একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, বিজ্ঞানের যেসব শিক্ষক চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেন, তাদের সাপ্তাহিক পাঠ-পরিকল্পনার সময় এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছিল। এআই শেখার অভিজ্ঞতাকে আরও আকর্ষণীয় ও মজাদার করতে পারে। সম্প্রতি মাইক্রোসফট একটি টুল প্রকাশ করেছে। এটি আসলে একটি পাঠ পরিকল্পনা, যা ‘মাইনক্রাফট’ গেমের মডেলে নিয়ে যায়। এর সাহায্যে শিক্ষার্থীরা পর্যায় সারণির বিষয়গুলো ভার্চুয়ালি গড়ে তুলতে পারে।
অনেক জায়গায় আবার এআই সরাসরি শিশুদের পড়াচ্ছে। বেলজিয়ামের ফ্ল্যান্ডার্সে প্রায় ৪ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী মাইক্রোসফটের একটি এআই-রিডিং টুল ব্যবহার করছে। ‘ইমারসিভ রিডার’ নামক সফটওয়্যার প্রথমে শিক্ষার্থীদের তাদের নিজের ভাষায় পড়ার সুযোগ দেয়। তারপর ডাচ ভাষায় এবং কোনো শব্দ বুঝতে না পারলে ছবি দিয়ে অর্থ বোঝায়। শিক্ষকের নির্দেশনাও এটা রিয়েল-টাইমে অনুবাদ করতে পারে।
এই প্রযুক্তিগুলো আগে শুধু ধনীদের নাগালে ছিল। গুগল ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, এআই প্রতিটি শিক্ষার্থীকে যার যার নিজের মতো করে শেখার পথ বাতলে দেবে। গুগলের লার্নিং-বিষয়ক প্রধান প্রযুক্তিবিদ বেন গোমেস বলেন, ইন্টারনেট প্রচলিত হওয়ার আগে ইলেকট্রনিক্সের বই বুঝতে তাকে অনেক বেগ পেতে হতো। কারণ তা তার স্তরের জন্য উপযোগী ছিল না। এখন ‘লার্ন ইয়োর ওয়ে’-এর মতো এআই টুল শিক্ষার্থীদের বোঝার ক্ষমতা অনুযায়ী পাঠ সাজাতে পারে, এমনকি কারো ব্যক্তিগত আগ্রহ অনুযায়ী উদাহরণও প্রদান করে।
অভিভাবকরা বাড়িতে এআই-টিউটর ব্যবহার করে তাদের সন্তানদের পড়ান। বিশেষ করে চীনে, যেখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো টিউশনের বিশাল বাজার তৈরি করেছে। ২০২১ সালে সরকার টিউশনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে এআই-টুলগুলো আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ এআইয়ের ক্ষেত্রে কোনো নিষেধজ্ঞা প্রযোজ্য ছিল না। হাংঝৌর স্টার্টআপ জেজেডএক্সের প্রধান ইয়াং রেনবিং জানান, তাদের এআই-ট্যাবের মাসিক বিক্রি গত এক বছরে দশগুণ বেড়েছে।
প্রাথমিক মনে করা হচ্ছে যে, এসব টুল পড়াশোনার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর। ভারতের ‘রিড অ্যালং’ পাইলট প্রকল্পে অংশ নেওয়া শিশুদের ৬০ শতাংশ পড়ার দক্ষতা উন্নত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নাইজেরিয়ার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যখন মাইক্রোসফটের ‘কোপাইলট’ ব্যবহার করেছে, তাদের ইংরেজি শেখার দক্ষতা প্রায় দুই বছরের স্বাভাবিক অগ্রগতির সমান।

তবে এআই-শিক্ষককে সবাই গ্রহণ করতে পারছে না। আমেরিকার ২২ শতাংশ জেলা-প্রধান মনে করেন, এআই শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ৬১ শতাংশ অভিভাবক এবং ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীও এই আশঙ্কা প্রকাশ করে। সিডিটি জানিয়েছে যে, যেসব স্কুলে এআই সবচেয়ে কম ব্যবহৃত হয়, সেখানকার শিক্ষকরা শঙ্কিত। আবার যেসব স্কুলে এআই ব্যবহারের হার বেশি, সেই স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা এটা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই অভিযোগ করেন যে, এআই ব্যবহারের যথাযথ দিকনির্দেশনা তারা খুব কম পেয়েছেন। বাড়ির কাজের জন্য এআই ব্যবহার করা উচিত কি না–তা নিয়ে অভিভাবকেরা দ্বিধান্বিত। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিক্টর লি ও সহকর্মীদের গবেষণায় পাওয়া গেছে, এ বছর আমেরিকার ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বীকার করেছে যে তারা পুরো একটি অ্যাসাইনমেন্ট এআই দিয়ে করেছে—যা ২০২৪ সালের তুলনায় ১১% বেশি।
শিশুদের সুরক্ষা
সরাসরি নকল করার চেয়েও বড় সমস্যা হলো শিশুরা এমন চিন্তাভাবনার জন্য এআইয়র ওপর নির্ভর করে, যা তারা নিজেরাই করতে পারে। একটি জাতীয় সমীক্ষায় দেখা গেছে, চীনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে চিন্তা করার বদলে এআইয়ের ওপর নির্ভর করতে বেশি পছন্দ করে। এমআইটির গবেষকরা মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ পরিমাপ করার জন্য শিক্ষার্থীদের একটি প্রবন্ধ লেখার কাজ দেন। সেখানে দেখা যায়, যারা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছিল, তাদের মস্তিষ্ক কম সক্রিয় ছিল এবং সেই শিক্ষার্থীরা নিজেদের লেখা প্রবন্ধের উদ্ধৃতিও ঠিকভাবে মনে রাখতে পারেনি।
ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলি স্কুল অব বিজনেসের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, যারা এআই-সহায়তায় একটি কাজ সম্পন্ন করেছিল তারা অন্যদের তুলনায় ১০ শতাংশ ভালো স্কোর করেছে এবং ৪০ শতাংশ দ্রুত কাজ শেষ করেছে। তবে এই কাজটিকে নিজের কাজ হিসেবে স্বীকার করতে চায়নি ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। এতে বোঝা যায় এআই ফলাফল উন্নত করতে পারলেও মালিকানার বোধ ক্ষুণ্ন করতে পারে।
এআই-সমর্থকরাও স্বীকার করেন যে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান এখনো অপরিহার্য। এআইয়ের সাহায্যে তরুণরা ছবি, ভিডিও, এমনকি গেমও তৈরি করতে পারছে—যা তরুণদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে।
এআই ঐতিহ্যবাহী খেলনাগুলোকেও নতুনভাবে জীবন্ত করছে। কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তৈরি ‘ব্রিকজিপিটি’ লেগো দিয়ে যে কোনো বস্তু বানানোর নির্দেশনা দিতে পারে। পশ্চিমা বড় খেলনা কোম্পানিগুলো সতর্ক থাকলেও এআই-এর ব্যবহার বাদ দিতে পারছে না।
ঝুঁকিহীন থাকার উপায়
নীতি-নির্ধারকরা শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে সচেতন আছেন। সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকার ফেডারেল ট্রেড কমিশন ওপেনএআইসহ সাতটি কোম্পানিকে নির্দেশ দেয় তাদের এআই চ্যাটবটগুলো কীভাবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে। চীন সম্প্রতি ‘এআই-নিরাপত্তা শাসন কাঠামো’ হালনাগাদ করেছে, যেখানে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে ‘মানবীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এআই-এর প্রতি আসক্তি ও নির্ভরতার’ ঝুঁকি সম্পর্কে। সেপ্টেম্বর মাসে ওপেনএআই চ্যাটজিপিটির জন্য ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ চালু করে। ইলন মাস্ক জানিয়েছেন যে তার কোম্পানি শিশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি একটি চ্যাটবট ‘বেবি গ্রক’ উন্নয়নে কাজ করছে।
বেশিরভাগ চ্যাটবট ব্যবহারকারী যদি নিজেদের ক্ষতি করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তাহলে তারা সাহায্য চাইতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু দীর্ঘ কথোপকথনের সময় এই সুরক্ষাবিধি সবসময় তাদের মনে থাকে না। কখনো কখনো তারা উদ্বেগজনক ভাবনাও সমর্থন করে বসে।
টেক কোম্পানিগুলো এমন এআই তৈরি করার চেষ্টা করছে, যেগুলো কম বাধ্যগত। কিন্তু এ বছরের শুরুতে ওপেনএআই যখন এমন কিছু করেছিল, তখন ব্যবহারকারীরা সন্তুষ্ট হয়নি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিলি গুডেকার বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া থেকে অনেক কিছু শিখি।’
তাহলে কী হবে, যখন কোনো শিশুর খেলাধুলার সঙ্গী এমন একটি রোবট, যে সর্বদা তার কথামতোই চলে?
শিশুকাল থেকে এআইয়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা শিক্ষা ও বিনোদন উভয়ক্ষেত্রেই নানা উপকার বয়ে আনবে। ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে এআই মডেলগুলো দক্ষ শিক্ষক হতে পারে এবং সৃজনশীলভাবে বিনোদন দিতে পারে।
কিন্তু এআইয়ের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতাই হয়তো তাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সম্প্রতি ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের একটি প্রকাশনায় শিশু-মনোবিজ্ঞানীদের একটি দল যুক্তি দেন, শিশুদের নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা শেখার জন্য কঠিন অনুভূতির মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। তারা লিখেছেন, “আমরা একেবারেই জানি না নিখুঁত একজন সঙ্গী মানুষের মস্তিষ্ক এবং পারস্পরিক সম্পর্ক কীভাবে বদলে দেবে।”
ইকনোমিস্ট থেকে অনূদিত

খান একাডেমি একটি জনপ্রিয় অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম। সম্প্রতি একটা বিষয় দেখে শিক্ষকরা অবাক হয়ে যান। খান একাডেমি থেকে কোনো এক অদৃশ্য সহযোগীর সাহায্য নিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের গণিত অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই অদৃশ্য সহযোগী আসলে ‘পিথাগোরাস’। খান একাডেমি তাদের প্ল্যাটফর্মে এআই-সিমুলেশনের মাধ্যমে প্রাচীনকালের অনেক মহান চিন্তাবিদদের সঙ্গে কথোপকথনের সুযোগ দিচ্ছে। আর তাতে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই এখন তাদের বাড়ির কাজ করিয়ে নিতে পারছে।
শিশুরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ফলভোগী এবং একই সঙ্গে গিনিপিগও। সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড টেকনোলজি (সিডিটি) নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, আমেরিকান তরুণরা তাদের বাবা-মায়ের তুলনায় বাড়িতে এআই ব্যবহার করে বেশি। স্কুলেও তারা এআই ব্যবহার করে তাদের বাবা-মায়ের কর্মক্ষেত্রের চেয়ে বেশি।
মোদ্দাকথা, বর্তমান প্রজন্ম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন সু্যোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হচ্ছে, আগের কোনো প্রজন্ম যা কল্পনাও করতে পারেনি। তবে এতে ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
দেশে দেশে স্কুলের পাঠে এআই
দুই বছর আগেও আমেরিকার অধিকাংশ স্কুলে এআই ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন এটি শিক্ষাজীবনের নিয়মিত কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। র্যান্ড করপোরেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী এবং প্রায় ৬৯ শতাংশ শিক্ষক এখন স্কুলের কাজ বা পাঠ পরিকল্পনা সাজানোর জন্য এআই ব্যবহার করে।
সরকারও এই পরিবর্তনকে উৎসাহ দিচ্ছে। এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আমেরিকার স্কুলগুলোর সিলেবাসে এআইয়ের মৌলিক ধারণা অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এআই চালু করেছে সিঙ্গাপুর। আর চীন ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত জাতীয়ভাবে এআই শিক্ষা শুরু করার পরিকল্পনা করছে। হাংঝৌ শহরে অবস্থিত চীনের শীর্ষ এআই প্রতিষ্ঠান ডিপসিকের প্রধান কার্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অন্তত বার্ষিক দশ ঘণ্টা এআই-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
ওয়ার্কশিট, কুইজ ও অ্যাসাইনমেন্টের সময় শিক্ষার্থীরা প্রথমে এআইয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করে পরোক্ষভাবে। কারণ শিক্ষকেরা এটি ব্যবহার করছে দেদারসে। ইংল্যান্ডের ৬৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর করা একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, বিজ্ঞানের যেসব শিক্ষক চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেন, তাদের সাপ্তাহিক পাঠ-পরিকল্পনার সময় এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছিল। এআই শেখার অভিজ্ঞতাকে আরও আকর্ষণীয় ও মজাদার করতে পারে। সম্প্রতি মাইক্রোসফট একটি টুল প্রকাশ করেছে। এটি আসলে একটি পাঠ পরিকল্পনা, যা ‘মাইনক্রাফট’ গেমের মডেলে নিয়ে যায়। এর সাহায্যে শিক্ষার্থীরা পর্যায় সারণির বিষয়গুলো ভার্চুয়ালি গড়ে তুলতে পারে।
অনেক জায়গায় আবার এআই সরাসরি শিশুদের পড়াচ্ছে। বেলজিয়ামের ফ্ল্যান্ডার্সে প্রায় ৪ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী মাইক্রোসফটের একটি এআই-রিডিং টুল ব্যবহার করছে। ‘ইমারসিভ রিডার’ নামক সফটওয়্যার প্রথমে শিক্ষার্থীদের তাদের নিজের ভাষায় পড়ার সুযোগ দেয়। তারপর ডাচ ভাষায় এবং কোনো শব্দ বুঝতে না পারলে ছবি দিয়ে অর্থ বোঝায়। শিক্ষকের নির্দেশনাও এটা রিয়েল-টাইমে অনুবাদ করতে পারে।
এই প্রযুক্তিগুলো আগে শুধু ধনীদের নাগালে ছিল। গুগল ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, এআই প্রতিটি শিক্ষার্থীকে যার যার নিজের মতো করে শেখার পথ বাতলে দেবে। গুগলের লার্নিং-বিষয়ক প্রধান প্রযুক্তিবিদ বেন গোমেস বলেন, ইন্টারনেট প্রচলিত হওয়ার আগে ইলেকট্রনিক্সের বই বুঝতে তাকে অনেক বেগ পেতে হতো। কারণ তা তার স্তরের জন্য উপযোগী ছিল না। এখন ‘লার্ন ইয়োর ওয়ে’-এর মতো এআই টুল শিক্ষার্থীদের বোঝার ক্ষমতা অনুযায়ী পাঠ সাজাতে পারে, এমনকি কারো ব্যক্তিগত আগ্রহ অনুযায়ী উদাহরণও প্রদান করে।
অভিভাবকরা বাড়িতে এআই-টিউটর ব্যবহার করে তাদের সন্তানদের পড়ান। বিশেষ করে চীনে, যেখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো টিউশনের বিশাল বাজার তৈরি করেছে। ২০২১ সালে সরকার টিউশনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে এআই-টুলগুলো আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ এআইয়ের ক্ষেত্রে কোনো নিষেধজ্ঞা প্রযোজ্য ছিল না। হাংঝৌর স্টার্টআপ জেজেডএক্সের প্রধান ইয়াং রেনবিং জানান, তাদের এআই-ট্যাবের মাসিক বিক্রি গত এক বছরে দশগুণ বেড়েছে।
প্রাথমিক মনে করা হচ্ছে যে, এসব টুল পড়াশোনার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর। ভারতের ‘রিড অ্যালং’ পাইলট প্রকল্পে অংশ নেওয়া শিশুদের ৬০ শতাংশ পড়ার দক্ষতা উন্নত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নাইজেরিয়ার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যখন মাইক্রোসফটের ‘কোপাইলট’ ব্যবহার করেছে, তাদের ইংরেজি শেখার দক্ষতা প্রায় দুই বছরের স্বাভাবিক অগ্রগতির সমান।

তবে এআই-শিক্ষককে সবাই গ্রহণ করতে পারছে না। আমেরিকার ২২ শতাংশ জেলা-প্রধান মনে করেন, এআই শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ৬১ শতাংশ অভিভাবক এবং ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীও এই আশঙ্কা প্রকাশ করে। সিডিটি জানিয়েছে যে, যেসব স্কুলে এআই সবচেয়ে কম ব্যবহৃত হয়, সেখানকার শিক্ষকরা শঙ্কিত। আবার যেসব স্কুলে এআই ব্যবহারের হার বেশি, সেই স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা এটা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই অভিযোগ করেন যে, এআই ব্যবহারের যথাযথ দিকনির্দেশনা তারা খুব কম পেয়েছেন। বাড়ির কাজের জন্য এআই ব্যবহার করা উচিত কি না–তা নিয়ে অভিভাবকেরা দ্বিধান্বিত। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিক্টর লি ও সহকর্মীদের গবেষণায় পাওয়া গেছে, এ বছর আমেরিকার ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বীকার করেছে যে তারা পুরো একটি অ্যাসাইনমেন্ট এআই দিয়ে করেছে—যা ২০২৪ সালের তুলনায় ১১% বেশি।
শিশুদের সুরক্ষা
সরাসরি নকল করার চেয়েও বড় সমস্যা হলো শিশুরা এমন চিন্তাভাবনার জন্য এআইয়র ওপর নির্ভর করে, যা তারা নিজেরাই করতে পারে। একটি জাতীয় সমীক্ষায় দেখা গেছে, চীনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে চিন্তা করার বদলে এআইয়ের ওপর নির্ভর করতে বেশি পছন্দ করে। এমআইটির গবেষকরা মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ পরিমাপ করার জন্য শিক্ষার্থীদের একটি প্রবন্ধ লেখার কাজ দেন। সেখানে দেখা যায়, যারা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছিল, তাদের মস্তিষ্ক কম সক্রিয় ছিল এবং সেই শিক্ষার্থীরা নিজেদের লেখা প্রবন্ধের উদ্ধৃতিও ঠিকভাবে মনে রাখতে পারেনি।
ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলি স্কুল অব বিজনেসের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, যারা এআই-সহায়তায় একটি কাজ সম্পন্ন করেছিল তারা অন্যদের তুলনায় ১০ শতাংশ ভালো স্কোর করেছে এবং ৪০ শতাংশ দ্রুত কাজ শেষ করেছে। তবে এই কাজটিকে নিজের কাজ হিসেবে স্বীকার করতে চায়নি ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। এতে বোঝা যায় এআই ফলাফল উন্নত করতে পারলেও মালিকানার বোধ ক্ষুণ্ন করতে পারে।
এআই-সমর্থকরাও স্বীকার করেন যে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান এখনো অপরিহার্য। এআইয়ের সাহায্যে তরুণরা ছবি, ভিডিও, এমনকি গেমও তৈরি করতে পারছে—যা তরুণদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে।
এআই ঐতিহ্যবাহী খেলনাগুলোকেও নতুনভাবে জীবন্ত করছে। কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তৈরি ‘ব্রিকজিপিটি’ লেগো দিয়ে যে কোনো বস্তু বানানোর নির্দেশনা দিতে পারে। পশ্চিমা বড় খেলনা কোম্পানিগুলো সতর্ক থাকলেও এআই-এর ব্যবহার বাদ দিতে পারছে না।
ঝুঁকিহীন থাকার উপায়
নীতি-নির্ধারকরা শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে সচেতন আছেন। সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকার ফেডারেল ট্রেড কমিশন ওপেনএআইসহ সাতটি কোম্পানিকে নির্দেশ দেয় তাদের এআই চ্যাটবটগুলো কীভাবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে। চীন সম্প্রতি ‘এআই-নিরাপত্তা শাসন কাঠামো’ হালনাগাদ করেছে, যেখানে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে ‘মানবীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এআই-এর প্রতি আসক্তি ও নির্ভরতার’ ঝুঁকি সম্পর্কে। সেপ্টেম্বর মাসে ওপেনএআই চ্যাটজিপিটির জন্য ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ চালু করে। ইলন মাস্ক জানিয়েছেন যে তার কোম্পানি শিশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি একটি চ্যাটবট ‘বেবি গ্রক’ উন্নয়নে কাজ করছে।
বেশিরভাগ চ্যাটবট ব্যবহারকারী যদি নিজেদের ক্ষতি করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তাহলে তারা সাহায্য চাইতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু দীর্ঘ কথোপকথনের সময় এই সুরক্ষাবিধি সবসময় তাদের মনে থাকে না। কখনো কখনো তারা উদ্বেগজনক ভাবনাও সমর্থন করে বসে।
টেক কোম্পানিগুলো এমন এআই তৈরি করার চেষ্টা করছে, যেগুলো কম বাধ্যগত। কিন্তু এ বছরের শুরুতে ওপেনএআই যখন এমন কিছু করেছিল, তখন ব্যবহারকারীরা সন্তুষ্ট হয়নি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিলি গুডেকার বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া থেকে অনেক কিছু শিখি।’
তাহলে কী হবে, যখন কোনো শিশুর খেলাধুলার সঙ্গী এমন একটি রোবট, যে সর্বদা তার কথামতোই চলে?
শিশুকাল থেকে এআইয়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা শিক্ষা ও বিনোদন উভয়ক্ষেত্রেই নানা উপকার বয়ে আনবে। ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে এআই মডেলগুলো দক্ষ শিক্ষক হতে পারে এবং সৃজনশীলভাবে বিনোদন দিতে পারে।
কিন্তু এআইয়ের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতাই হয়তো তাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সম্প্রতি ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের একটি প্রকাশনায় শিশু-মনোবিজ্ঞানীদের একটি দল যুক্তি দেন, শিশুদের নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা শেখার জন্য কঠিন অনুভূতির মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। তারা লিখেছেন, “আমরা একেবারেই জানি না নিখুঁত একজন সঙ্গী মানুষের মস্তিষ্ক এবং পারস্পরিক সম্পর্ক কীভাবে বদলে দেবে।”
ইকনোমিস্ট থেকে অনূদিত