ভোটের মার্কা: মুখোমুখি অন্তর্বর্তী সরকার-বিএনপি

সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
ভোটের মার্কা: মুখোমুখি অন্তর্বর্তী সরকার-বিএনপি

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করাকে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ বলছে বিএনপি। দলটি এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে দুষছে। বলছে, এটি অন্তর্বর্তী সরকার ‘চাপিয়ে দিয়েছে’। এ নিয়ে আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি বলছে–বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকার এখন মুখোমুখি অবস্থানে।

নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে অংশ নিলেও প্রার্থীদের নিজের দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে বলে আরপিওতে আনা সংশোধনী নিয়ে এতদিন দলীয় অবস্থান থেকে আপত্তি জানিয়ে আসছিল বিএনপি। এবার আইনি লড়াইয়েও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি।

গত ৩ নভেম্বর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশোধিত আইন অনুযায়ী, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে একাধিক নিবন্ধিত দল জোট করলেও জোট মনোনীত প্রার্থী বড় দলের বা অন্য দলের প্রতীকে ভোট করতে পারবে না, নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে।

আগের বিধান অনুযায়ী, নিবন্ধিত দলের জোটের প্রার্থীরা যেকোনো প্রতীকে ভোট করতে পারতেন। প্রধান দলগুলোর প্রতীক জোটভুক্ত ছোট দলের কয়েকজন প্রার্থীর ব্যবহারের সুযোগ ছিল এবং অনেকে অন্য দলের প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্যও হয়েছেন।

শুরু থেকেই এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে বিএনপি। বিধানটি বাদ দিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কাছে লিখিত আবেদনও করেছিল দলটি। তবে ইসি বা সরকার তাদের কথা শোনেনি।

বিএনপি বলছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই সরকার আরপিওতে এই সংশোধনী এনেছে। এ জন্য আইনি লড়াইয়ের পথ বেছে নেওয়া হয়েছে।

আরপিও’র সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে গত ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএমের মহাসচিব মোমিনুল আমিন এ রিট দায়ের করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়েছে। গতকাল বুধবার এই রিটের পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চরচাকে বলেন, “অতীতের নির্বাচনগুলোতে প্রার্থী চাইলে তার জোটের প্রতীকে নির্বাচন করেছে। এটি প্রার্থীর গণতান্ত্রিক অধিকার। এ নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।”

দলের আরেক নেতা নজরুল ইসলাম খানের মতে সরকারের এই সিদ্ধান্ত ‘উদ্দেশ্যমূলক’। চরচাকে তিনি বলেন, “কোনো রাজনৈতিক দল কি সরকারকে বলেছে যে, তারা স্ব স্ব দলীয় প্রতীকে নির্বাচন চায়, নাকি জনগণ ম্যান্ডেট দিয়েছে? এই সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার জোর করে চাপিয়ে দিল। তারা এটি ভালো উদ্দেশ্যে করেনি। ঠিক আছে আমরাও আইনি লড়াইয়ে গেছি, কোর্ট সিদ্ধান্ত দিক।”

নির্বাচনের বিএনপির প্রস্তুতি কেমন?

প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও লন্ডন থেকে কবে ফিরবেন, তা এখনো ঠিক নেই।

গত ২৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া। শুরুতে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হলেও, হৃদরোগসহ শরীরের নানা জটিলতায় তার জীবন এখন সংকটাপন্ন। মাঝে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেওয়ার সকল প্রস্তুতি নিয়েও তা বাতিল করা হয়। দেশ-বিদেশের চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড সবশেষ ১০ নভেম্বর রাতে মতামত দেয়, এমন সংকটাপন্ন অবস্থায় বিমানযাত্রা করতে পারবেন না খালেদা জিয়া। তাই তাকে দেশে রেখেই আপাতত চিকিৎসা দেওয়া হবে। তারেক রহমান দেশে না এলেও মায়ের চিকিৎসার তত্ত্বাবধানের জন্য স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানকে দেশে পাঠিয়েছেন।

সবশেষ বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তারেক জানিয়েছিলেন ‘খুব শিগগিরই’ তিনি দেশে ফিরছেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতা এবং খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ করা নিয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর দেড় মাস পার হলেও ফেরেননি তিনি। এর মধ্যেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য কতটা প্রস্তুত বিএনপি, সে প্রশ্নও উঠেছে।

তবে এই অবস্থাকে মোটেও সংকট বলে মনে করছেন না বিএনপি নেতারা। তারা বলছেন, সব সংকটকে মোকাবিলা করে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি-সামর্থ্য আছে বলেই বিএনপি দেশের বড় রাজনৈতিক দল। আবার বড় দল বলেই দলীয় আদর্শ-শৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ড বিদ্যামান রয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মাঝে। যে কারণে শীর্ষ দুই নেতৃত্বের শারীরিক অনুপস্থিতি দলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চরচাকে বলেন, “বিএনপি দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল। যেকোনো বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেও নির্বাচনের প্রস্তুতি বিএনপি নিতে পারে। আর দেশের এবং জনগণের স্বার্থে ৫ আগস্টের পর থেকে দ্রুত নির্বাচন চেয়ে আসছে বিএনপি। তাই নির্বাচন নিয়ে পুরো প্রস্তুতি বিএনপির আছে। আমার সবসময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের নিয়মিত দলীয় কার্যক্রম চলছে, অধিকাংশ আসনে বিএনপির প্রার্থী দেওয়া হয়েছে, যেকটি আসন বাকি রয়েছে, তাতে দু-একদিনের মধ্যে প্রার্থী চূড়ান্ত হয়ে যাবে।”

যথাসময়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরবেন বলে মনে করছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ এই নেতা। বলেন, “তার (তারেক রহমান) অনুপস্থিতিতে কোনো সংকট নয়, বরং একদিকে মায়ের চিকিৎসা অন্যদিকে দলের পরিচালনা, দুটিই খুব দক্ষতার সঙ্গে সামলে নিচ্ছেন তারেক রহমান।”

একই মত জানান দলটির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। চরচাকে তিনি বলেন, “দেশের জনগণ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ৫ আগস্ট যখন আমরা স্বৈরাচার বিদায় করলাম, তখনো আমাদের চেয়ারপারসন অসুস্থ ছিলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে ছিলেন। এত বড় আন্দোলন যদি আমরা করতে পারি, দেশ থেকে স্বৈরাচার বিদায় করতে পারি, তাহলে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি কেন নিতে পারব না? নির্বাচনের জন্য আমাদের সকল প্রস্তুতি আছে।”

সম্পর্কিত