চরচা প্রতিবেদক

তারিখটা ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
আগের দিন বিকেলেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্ত হয়েছে ঢাকা। অভ্যুদয় ঘটেছে স্বপ্নের বাংলাদেশের। পুরো দেশ আনন্দে উন্মাতাল। মুক্তির আনন্দে ভাসছে সবাই। কিন্তু ওই সময়ই ঢাকা থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার দূরে খুলনায় চলছিল ভয়াবহ এক যুদ্ধ। মরণপণ যুদ্ধ। খুলনায় শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেডিয়ার, খিজির হায়াত খান। তার অধীনে আছে ৬ পাঞ্জাব, ১২ পাঞ্জাব, ২১ পাঞ্জাব এবং ১২ ও ১৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের মতো শক্তিশালী রেজিমেন্টের একাধিক ব্যাটালিয়ন। আছে এম–২৪ যুদ্ধ ট্যাংক। সঙ্গে রাজাকার বাহিনী তো ছিলই।
খিজির হায়াত খানের বাহিনীর দখল থেকে খুলনাকে মুক্ত করতে মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যরা শুরুতে করছিল প্রচলিত পদাতিক যুদ্ধ। কিন্তু রক্ষণাত্মক অবস্থানে থাকা পাকিস্তান বাহিনীর চেয়ে মোট পদাতিক সৈনিকের সংখ্যা কম হওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথবাহিনী খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। শিরোমণি নামের এক অঞ্চলে চলছিল ভয়াবহ ট্যাংক যুদ্ধ, যা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ছিল অন্যতম বড় ও ভয়াবহ। পাকিস্তানি বাহিনীর রক্ষণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, ভারতীয় বাহিনীকে এ যুদ্ধে একাধিকবার এগিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়েছিল ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়ে। যে যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ব্যর্থ হয়েছিল, সেই যুদ্ধই মুক্তিবাহিনী জয় করে নেয় এক বীর বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তার অনন্য বীরত্বে। তার নাম মেজর আবুল মনজুর। মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার। শিরোমণির ট্যাংক যুদ্ধে তিনি পদাতিক ধারার পরিবর্তে বেছে নেন দুঃসাহসিক গেরিলা যুদ্ধ। মেজর মনজুর এ যুদ্ধ জয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন অনেকটা কমান্ডো ও গেরিলা ধারার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে। মনজুরের বাহিনীর বীরত্বে খুলনা মুক্ত হয়েছিল ‘ব্যাটল অব শিরোমণি’র পর। যুদ্ধের ইতিহাসে ‘ব্যাটল অব শিরোমণি’বিশেষ এক জায়গা করে নিয়েছে। মেজর মনজুরের এই যুদ্ধ পরিকল্পনা দুনিয়ার ৩৫টি দেশের স্টাফ কলেজের সিলেবাসে করা হয়েছে অন্তর্ভুক্ত।

মেজর আবুল মনজুর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন আগস্ট মাসে। ব্যাপারটা বলা যত সহজ, বাস্তবে ততটাই কঠিন। রীতিমতো দুঃসাহসিক। মনজুরের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আরও দুই বীর যোদ্ধা—মেজর আবু তাহের ও মেজর জিয়াউদ্দিন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার এই যাত্রাপথে পদে পদে বিপদ সামলেছিলেন তারা।
দুঃসাহসী ও অসামান্য মেধাবী এ সেনা কর্মকর্তা ১৯৫৮ সালে কানাডার স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি ডিগ্রি নিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মনজুরকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে মনজুর মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ও চট্টগ্রামে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি হিসেবে। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যার সঙ্গে চট্টগ্রাম ডিভিশনের কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন। জিওসি হিসেবে মনজুরও সেই দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। তবে রহস্যজনকভাবে মনজুরকে জিয়া হত্যার দুদিন পরই হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর সেনানির জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো ছিল দুর্ভাগ্যজনক।

‘ব্যাটল অব শিরোমণি’র শুরুটা হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভারতীয় বাহিনীর মেজর মহেন্দ্র সিং ও মুক্তিবাহিনীর মেজর ওসমান গনির নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর একটা বড় কনভয় খুলনা শহর মুক্ত করতে রওনা দেয়। কিন্তু এই কনভয়ের শিরোমণি এলাকায় পৌঁছলে পাকিস্তান বাহিনী চতুর্দিক থেকে অ্যামবুশ করে। এতে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতীয় বাহিনীর ক্ষতিই বেশি ছিল। এতে একটা ভুলও হয়েছিল বলে কথিত আছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর কয়েকটি যুদ্ধবিমান ভুল করে নিজেদের সেনাবাহিনীর ওপরই বোমাবর্ষণ করেছিল বলে শোনা যায়। ভারতীয় বাহিনীর ক্ষতি এতটাই বেশি ছিল যে, স্থানীয় লোকজন সৈনিকদের মরদেহ কয়েকটি ট্রাকে করে নিয়ে যেতে দেখেছিল বলে দাবি করে।

এরপর ভারতীয় বাহিনী মেজর মনজুরের শরণাপন্ন হয়। তাকে নতুন করে খুলনা দখলের অভিযান পরিকল্পনা করতে বলে। এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখেন মেজর দলবীর সিং নামের একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা। মনজুর পাকিস্তান বাহিনীর শক্তিমত্তা পুনর্মূল্যায়ন করেন।
মনজুর প্রায় আত্মঘাতী এক আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তিনিই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সেই অভিযানের। এ অভিযানে ভারতীয় বাহিনীর কাজ ছিল শুধু আর্টিলারি সাপোর্ট দেওয়া। আগেই বলা হয়েছে মনজুরের ফরমেশন ছিল ব্যতিক্রমী। তিনি গেরিলা যুদ্ধ ও কমান্ডো ধারার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। শিরোমণির যুদ্ধক্ষেত্রে মনজুরের প্রধান লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি টি–২৪ ট্যাংক ধ্বংস করা। সেটি করতে গিয়ে যুদ্ধটি ভয়াবহ রূপ নেয়। একই যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় ট্যাংক, আর্টিলারি ও পদাতিক ধারার যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ শিরোমণির যুদ্ধেই প্রথম একই সঙ্গে ট্যাংক, আর্টিলারি, গেরিলা ও কমান্ডো ধারার যুদ্ধ দেখা যায়।
মেজর মনজুরের বীরত্বগাথা
১৪ ডিসেম্বর ব্যাপক ক্ষয়–ক্ষতির পর মেজর মনজুরের নতুন পরিকল্পনায় ১৫ ডিসেম্বর সারাদিন ধরে থেমে থেমে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধ চলতে থাকে ১৬ ডিসেম্বরও। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ছিল ৩২টি টি–২৪ ট্যাংক। উল্টো দিকে মনজুরের বাহিনীর সঙ্গে ছিল মাত্র ৮টি ভারতীয় পিটি–৭৬ ট্যাংক। এ অভিযানে মনজুরের সাথে ছিলেন ১২ থেকে ১৫ জন দুঃসাহসী যোদ্ধা। তারা সবাই সেদিন দেশের জন্য জীবন উৎসর্গের দৃঢ় সংকল্প নিয়েই যুদ্ধে গিয়েছিলেন। কারণ, মনজুরের পরিকল্পনা ছিল ‘ডু অর ডাই’। সহযোদ্ধাদের মনোবল যেন অটুট থাকে, সেজন্য মনজুর নিজেই এসএলআর হাতে ছিলেন সবার আগে।

পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা ব্যুহে ঢুকেই মনজুরের সেই অসীম সাহসী যোদ্ধারা একে একে উঠে পড়তে থাকেন পাকিস্তানি ট্যাংকগুলোর ওপর। হ্যাচের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে থাকেন গ্রেনেড। হাতে থাকা এসএলআর নিয়ে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ তো তারা করছিলেনই। একের পর এক পাকিস্তানি ট্যাংক ধ্বংস করতে থাকেন তারা। প্রবল এই কমান্ডো আক্রমণে কিছুক্ষণের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে যায় পাকিস্তানি টি–২৪ ট্যাংকবহর। এভাবেই কেটে যায় ১৬ ডিসেম্বরের কুয়াশাঘেরা রাতটি।
১৭ ডিসেম্বর ভোর! পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার খিজির হায়াত খান বুঝে গেছেন, এরপর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মানেই নিশ্চিত মারা পড়া। কিন্তু তিনি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে। সকাল থেকে মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন যোদ্ধার সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসেন। দুপুরের দিকে পাকিস্তান বাহিনী ব্রিগেডিয়ার খিজির হায়াতের নেতৃত্ব আত্মসমর্পণ করে বাঙালি বীর মেজর মনজুর ও ভারতীয় বাহিনীর কাছে। সেদিন আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তান বাহিনীর প্রায় সাড়ে তিন হাজার সদস্য।
শিরোমণির যুদ্ধ স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর এক অসামান্য বীরত্বগাথা। অনন্য এক ইতিহাস।

তারিখটা ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
আগের দিন বিকেলেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্ত হয়েছে ঢাকা। অভ্যুদয় ঘটেছে স্বপ্নের বাংলাদেশের। পুরো দেশ আনন্দে উন্মাতাল। মুক্তির আনন্দে ভাসছে সবাই। কিন্তু ওই সময়ই ঢাকা থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার দূরে খুলনায় চলছিল ভয়াবহ এক যুদ্ধ। মরণপণ যুদ্ধ। খুলনায় শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেডিয়ার, খিজির হায়াত খান। তার অধীনে আছে ৬ পাঞ্জাব, ১২ পাঞ্জাব, ২১ পাঞ্জাব এবং ১২ ও ১৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের মতো শক্তিশালী রেজিমেন্টের একাধিক ব্যাটালিয়ন। আছে এম–২৪ যুদ্ধ ট্যাংক। সঙ্গে রাজাকার বাহিনী তো ছিলই।
খিজির হায়াত খানের বাহিনীর দখল থেকে খুলনাকে মুক্ত করতে মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যরা শুরুতে করছিল প্রচলিত পদাতিক যুদ্ধ। কিন্তু রক্ষণাত্মক অবস্থানে থাকা পাকিস্তান বাহিনীর চেয়ে মোট পদাতিক সৈনিকের সংখ্যা কম হওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথবাহিনী খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। শিরোমণি নামের এক অঞ্চলে চলছিল ভয়াবহ ট্যাংক যুদ্ধ, যা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ছিল অন্যতম বড় ও ভয়াবহ। পাকিস্তানি বাহিনীর রক্ষণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, ভারতীয় বাহিনীকে এ যুদ্ধে একাধিকবার এগিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়েছিল ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়ে। যে যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ব্যর্থ হয়েছিল, সেই যুদ্ধই মুক্তিবাহিনী জয় করে নেয় এক বীর বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তার অনন্য বীরত্বে। তার নাম মেজর আবুল মনজুর। মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার। শিরোমণির ট্যাংক যুদ্ধে তিনি পদাতিক ধারার পরিবর্তে বেছে নেন দুঃসাহসিক গেরিলা যুদ্ধ। মেজর মনজুর এ যুদ্ধ জয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন অনেকটা কমান্ডো ও গেরিলা ধারার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে। মনজুরের বাহিনীর বীরত্বে খুলনা মুক্ত হয়েছিল ‘ব্যাটল অব শিরোমণি’র পর। যুদ্ধের ইতিহাসে ‘ব্যাটল অব শিরোমণি’বিশেষ এক জায়গা করে নিয়েছে। মেজর মনজুরের এই যুদ্ধ পরিকল্পনা দুনিয়ার ৩৫টি দেশের স্টাফ কলেজের সিলেবাসে করা হয়েছে অন্তর্ভুক্ত।

মেজর আবুল মনজুর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন আগস্ট মাসে। ব্যাপারটা বলা যত সহজ, বাস্তবে ততটাই কঠিন। রীতিমতো দুঃসাহসিক। মনজুরের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আরও দুই বীর যোদ্ধা—মেজর আবু তাহের ও মেজর জিয়াউদ্দিন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার এই যাত্রাপথে পদে পদে বিপদ সামলেছিলেন তারা।
দুঃসাহসী ও অসামান্য মেধাবী এ সেনা কর্মকর্তা ১৯৫৮ সালে কানাডার স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি ডিগ্রি নিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মনজুরকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে মনজুর মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ও চট্টগ্রামে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি হিসেবে। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যার সঙ্গে চট্টগ্রাম ডিভিশনের কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন। জিওসি হিসেবে মনজুরও সেই দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। তবে রহস্যজনকভাবে মনজুরকে জিয়া হত্যার দুদিন পরই হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর সেনানির জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো ছিল দুর্ভাগ্যজনক।

‘ব্যাটল অব শিরোমণি’র শুরুটা হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভারতীয় বাহিনীর মেজর মহেন্দ্র সিং ও মুক্তিবাহিনীর মেজর ওসমান গনির নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর একটা বড় কনভয় খুলনা শহর মুক্ত করতে রওনা দেয়। কিন্তু এই কনভয়ের শিরোমণি এলাকায় পৌঁছলে পাকিস্তান বাহিনী চতুর্দিক থেকে অ্যামবুশ করে। এতে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতীয় বাহিনীর ক্ষতিই বেশি ছিল। এতে একটা ভুলও হয়েছিল বলে কথিত আছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর কয়েকটি যুদ্ধবিমান ভুল করে নিজেদের সেনাবাহিনীর ওপরই বোমাবর্ষণ করেছিল বলে শোনা যায়। ভারতীয় বাহিনীর ক্ষতি এতটাই বেশি ছিল যে, স্থানীয় লোকজন সৈনিকদের মরদেহ কয়েকটি ট্রাকে করে নিয়ে যেতে দেখেছিল বলে দাবি করে।

এরপর ভারতীয় বাহিনী মেজর মনজুরের শরণাপন্ন হয়। তাকে নতুন করে খুলনা দখলের অভিযান পরিকল্পনা করতে বলে। এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখেন মেজর দলবীর সিং নামের একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা। মনজুর পাকিস্তান বাহিনীর শক্তিমত্তা পুনর্মূল্যায়ন করেন।
মনজুর প্রায় আত্মঘাতী এক আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তিনিই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সেই অভিযানের। এ অভিযানে ভারতীয় বাহিনীর কাজ ছিল শুধু আর্টিলারি সাপোর্ট দেওয়া। আগেই বলা হয়েছে মনজুরের ফরমেশন ছিল ব্যতিক্রমী। তিনি গেরিলা যুদ্ধ ও কমান্ডো ধারার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। শিরোমণির যুদ্ধক্ষেত্রে মনজুরের প্রধান লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি টি–২৪ ট্যাংক ধ্বংস করা। সেটি করতে গিয়ে যুদ্ধটি ভয়াবহ রূপ নেয়। একই যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় ট্যাংক, আর্টিলারি ও পদাতিক ধারার যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ শিরোমণির যুদ্ধেই প্রথম একই সঙ্গে ট্যাংক, আর্টিলারি, গেরিলা ও কমান্ডো ধারার যুদ্ধ দেখা যায়।
মেজর মনজুরের বীরত্বগাথা
১৪ ডিসেম্বর ব্যাপক ক্ষয়–ক্ষতির পর মেজর মনজুরের নতুন পরিকল্পনায় ১৫ ডিসেম্বর সারাদিন ধরে থেমে থেমে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধ চলতে থাকে ১৬ ডিসেম্বরও। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ছিল ৩২টি টি–২৪ ট্যাংক। উল্টো দিকে মনজুরের বাহিনীর সঙ্গে ছিল মাত্র ৮টি ভারতীয় পিটি–৭৬ ট্যাংক। এ অভিযানে মনজুরের সাথে ছিলেন ১২ থেকে ১৫ জন দুঃসাহসী যোদ্ধা। তারা সবাই সেদিন দেশের জন্য জীবন উৎসর্গের দৃঢ় সংকল্প নিয়েই যুদ্ধে গিয়েছিলেন। কারণ, মনজুরের পরিকল্পনা ছিল ‘ডু অর ডাই’। সহযোদ্ধাদের মনোবল যেন অটুট থাকে, সেজন্য মনজুর নিজেই এসএলআর হাতে ছিলেন সবার আগে।

পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা ব্যুহে ঢুকেই মনজুরের সেই অসীম সাহসী যোদ্ধারা একে একে উঠে পড়তে থাকেন পাকিস্তানি ট্যাংকগুলোর ওপর। হ্যাচের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে থাকেন গ্রেনেড। হাতে থাকা এসএলআর নিয়ে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ তো তারা করছিলেনই। একের পর এক পাকিস্তানি ট্যাংক ধ্বংস করতে থাকেন তারা। প্রবল এই কমান্ডো আক্রমণে কিছুক্ষণের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে যায় পাকিস্তানি টি–২৪ ট্যাংকবহর। এভাবেই কেটে যায় ১৬ ডিসেম্বরের কুয়াশাঘেরা রাতটি।
১৭ ডিসেম্বর ভোর! পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার খিজির হায়াত খান বুঝে গেছেন, এরপর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মানেই নিশ্চিত মারা পড়া। কিন্তু তিনি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে। সকাল থেকে মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন যোদ্ধার সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসেন। দুপুরের দিকে পাকিস্তান বাহিনী ব্রিগেডিয়ার খিজির হায়াতের নেতৃত্ব আত্মসমর্পণ করে বাঙালি বীর মেজর মনজুর ও ভারতীয় বাহিনীর কাছে। সেদিন আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তান বাহিনীর প্রায় সাড়ে তিন হাজার সদস্য।
শিরোমণির যুদ্ধ স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর এক অসামান্য বীরত্বগাথা। অনন্য এক ইতিহাস।