বর্তমান করপোরেট বিশ্বে এক বিপ্লব চলছে। এক সময় পেশাগত সাফল্য মানেই ছিল দ্রুত পদোন্নতি, বড় পদবি আর দিন-রাত এক করে পরিশ্রম। কিন্তু আধুনিক কর্মীরা এখন সেই পথ থেকে সরে আসছেন। গ্লাসডোরের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ জেন জি কর্মী বড় বেতন বা ক্ষমতার হাতছানি না থাকলে ব্যবস্থাপক বা নেতৃত্বের পথে হাঁটতে নারাজ। এই প্রবণতাকেই বলা হচ্ছে ‘কর্মজীবনের মিনিমালিজম’ (Career Minimalism)।
শুরুতে একে কেবল তরুণ প্রজন্মের খেয়াল মনে করা হলেও, বর্তমানে মিলেনিয়াল, জেন এক্স এমনকি বেবি বুমার্সদের মধ্যেও এই মানসিকতা ছড়িয়ে পড়ছে। ক্যারিয়ার এখন আর অন্ধ প্রতিযোগিতার নাম নয় বরং জীবনের সাথে কাজের ভারসাম্য রক্ষার এক সচেতন কৌশল।
কেন ভেঙে পড়ছে চিরাচরিত ক্যারিয়ারের ধারণা?
একটা কথা প্রচলিত ছিল যে, কঠোর পরিশ্রম করলে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা আর পদোন্নতি নিশ্চিত। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন। ‘শুষ্ক পদোন্নতি’ বা ড্রাই প্রমোশন (দায়িত্ব বাড়লেও বেতন না বাড়া), এআই-চালিত কর্মসংস্থান পুনর্গঠন এবং ক্রমবর্ধমান ‘বার্নআউট’ কর্মীদের বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। গ্যালপের তথ্যমতে, মাত্র ২১ শতাংশ কর্মী এখন তাদের কাজে পুরোপুরি নিবেদিত। যখন পরিশ্রমের বিপরীতে যোগ্য পুরস্কার মেলে না, তখন কর্মীরা স্বাভাবিকভাবেই ক্যারিয়ারের পেছনে অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় করার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চান।
নেতৃত্বের চেয়ে যখন স্বাধীনতা প্রিয়
নেতৃত্বের বড় পদগুলো এখন আর আগের মতো আকর্ষণীয় নয়। কারণ এসব পদের সঙ্গে আসে মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং ব্যক্তিগত সময়ের বিসর্জন। অন্যদিকে, প্রযুক্তির কল্যাণে ‘সাইড হাসল’ বা পার্শ্ব-উদ্যোগ এখন অনেক বেশি লাভজনক। জেন জি-এর ৫৭ শতাংশ, মিলিনিয়ালদের ৪৮ শতাংশ এবং জেন এক্স-এর ৩১ শতাংশ কর্মী এখন মূল চাকরির পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসা বা ফ্রিল্যান্সিং করছেন।
এই পার্শ্ব-উদ্যোগগুলো কর্মীদের এমন কিছু দিচ্ছে যা বড় কোম্পানিগুলো দিতে পারছে না। সেগুলো হলো-
- নিজের সিদ্ধান্তে কাজ করার স্বাধীনতা।
- আয়ের বৈচিত্র্যকরণ যা ছাঁটাইয়ের ভয় কমায়।
- করপোরেট কাঠামোর বাইরে ব্যক্তিগত শখকে আয়ের উৎসে রূপান্তর।
বার্নআউট এবং নতুন কর্মসংস্কৃতি
মুডল -এর গবেষণা বলছে, ২০২৫ সালে এসে ৬৬ শতাংশ মার্কিন কর্মী মারাত্মক বার্নআউটে ভুগছেন। বিষাক্ত কর্মপরিবেশ এবং সারাক্ষণ অনলাইনে থাকার চাপ মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। এর প্রতিক্রিয়াই হলো কর্মজীবনের মিনিমালিজম। এটি কর্মীদের শেখায় নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা মেনে চলতে, ব্যক্তিগত সময় সুরক্ষিত রাখতে এবং কাজের চারপাশে একটি সুস্থ সীমারেখা টানতে। এখনকার কর্মীরা পদবির চেয়ে ‘এনার্জি ম্যানেজমেন্ট’ বা নিজের শক্তি সাশ্রয় করাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
অ-রৈখিক কর্মজীবন
আগে ক্যারিয়ার ছিল একটি মইয়ের মতো, যা কেবল ওপরের দিকেই উঠত। এখন সেটি হয়ে দাঁড়িয়েছে শাপলা পাতার পথের মতো নমনীয় এবং বহুমুখী। রিমোট ওয়ার্ক এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে। যাতায়াতের সময় সাশ্রয় এবং নিজের সুবিধামতো কাজ করার সুযোগ পাওয়ার পর কর্মীরা আর আগের সেই কঠোর অফিস কাঠামোতে ফিরে যেতে চাইছেন না। প্রজেক্ট-ভিত্তিক কাজ এবং ল্যাটারাল মুভ (একই স্তরের অন্য বিভাগে যাওয়া) এখন অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।
নিয়োগকর্তাদের করণীয়
স্মার্ট কোম্পানিগুলো বুঝতে পারছে যে, কর্মীদের এই পরিবর্তনকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই প্রতিভা ধরে রাখতে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন চার দিনের কর্মসপ্তাহ, মিটিং-মুক্ত দিন এবং স্বচ্ছ কাজের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে, একজন কর্মী কেবল তখনই সেরাটা দেবেন যখন তার জীবন কেবল কাজের গ্রাসে হারিয়ে যাবে না।
কর্মজীবনের মিনিমালিজম মানে অলসতা নয়, বরং এটি একটি সচেতন পরিবর্তন। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কাজ জীবনের একটি অংশ মাত্র, পুরো জীবন নয়। জেন জি থেকে শুরু করে প্রবীণ পেশাদার-সবাই এখন এমন একটি ক্যারিয়ার খুঁজছেন যা টেকসই, সম্মানজনক এবং যা তাদের ব্যক্তিগত বিকাশের সুযোগ দেয়। ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রে তারাই সফল হবে, যারা সাফল্যের সংজ্ঞাকে কেবল টাকার অঙ্কে নয় বরং জীবনের গুণগত মানের মাপকাঠিতে বিচার করতে শিখবে।
তথ্যসূত্র: ফোর্বস