Google Zero কী, এতেই কি ওয়েব দুনিয়া পাল্টে যাবে?

Google Zero কী, এতেই কি ওয়েব দুনিয়া পাল্টে যাবে?
ছবি: রয়টার্স

বেশ কিছুদিন ধরেই টেক দুনিয়ায় আলোচনা হচ্ছে সার্চ ইঞ্জিন গুগলের এক ফিচার নিয়ে। এ নিয়ে অনুচ্চারে হলেও আলাপ চলছে। যদিও এর গতি ঢিমেতালের, তবে শঙ্কা বড় মাপেরই!

ফিচারটি মূলত গুগলের সার্চ ইঞ্জিনে যুক্ত করা এআই ওভারভিউ। গুগলে কোনো বিষয় নিয়ে সার্চ করতে গেলেই এখন চোখের সামনে আগে ভেসে ওঠে এই ফিচার। এতে সার্চ করা বিষয়ের ওপর একটি সামারি বা সারসংক্ষেপ তুলে ধরে গুগলের এআই। মূলত বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়েই এই সামারি তৈরি করা হয়। তথ্যের সাথে সাথে সেসব ওয়েবসাইটের লিংকও জুড়ে দেওয়া হয়।

আর এই বিষয়টিকেই Google Zero তৈরির প্রেক্ষাপট বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘গুগল জিরো’ নামের এই শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার শুরু করেন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য ভার্জ–এর প্রধান সম্পাদক নিলয় প্যাটেল। ২০২৪ সালের মে মাসে লেখা এক নিবন্ধে তিনি এই ‘গুগল জিরো’কে সামনে আনেন।

নিলয় মনে করেন, গুগলের সার্চ ইঞ্জিনে এআই ওভারভিউ চালু হওয়ায় গুগল জিরো’র দরজা খুলে গেছে। এআই এখন সার্চ করা বিষয় নিয়ে ব্যবহারকারীদের কোনো ক্লিক করার আগেই জানিয়ে দিচ্ছে সামারি। শুরুতে এই এআই ওভারভিউ অনেকটা কাঁচা ছিল। কিন্তু দিনে দিনে এটি উন্নত হচ্ছে। এখন যেকোনো ব্যবহারকারী চাইলেই যেকোনো বিষয়ে প্রাথমিক ধারণাটি পেয়ে যেতে পারেন গুগলের এআই ওভারভিউ থেকে। ফলে সাধারণ তথ্য খোঁজা ব্যবহারকারীদের কাজ অনেকটাই করে দিতে পারছে গুগলের নতুন ফিচারটি।

আর এই জায়গাতেই আশঙ্কার শুরু। যেটি নিয়ে একটু গভীরে চিন্তা করতে গেলে আতঙ্ক লাগেই! এমনকি এক নতুন ধরনের প্রযুক্তিগত ব্ল্যাকমেইলিংয়ের গন্ধও মেলে।

গুগলের একাধিপত্য

WWW বা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আবিষ্কার হয় ১৯৮৯ সালে। একে ‘দ্য ওয়েব’ও বলা হয়। ব্রিটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী টিম বার্নার্স–লি ওই বছর এটি আবিষ্কার করলেও, এটি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয় ১৯৯৩ সালে। সেই থেকে বিশ্বজুড়ে মানুষের জন্য এক নতুন দুনিয়া সৃষ্টির পাশাপাশি ক্রমশ সেটির বিস্তার হয়ে আসছে। এটি হলো ওয়েব দুনিয়া বা দ্য ওয়েব।

বলা যায় যে, এই ওয়েব দুনিয়ার পুরোটাই এখন অনেকটা গুগলের দখলে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বেশির ভাগই ওয়েব দুনিয়ায় কনটেন্ট খোঁজেন গুগলের সার্চ ইঞ্জিন দিয়ে। সেক্ষেত্রে ব্রাউজারও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয় গুগল ক্রোম। আবার ওয়েবসাইটে ভালো ট্রাফিক পেতে হলে গুগলে ক্রল করাতে হয়। অর্থাৎ, গুগল থেকে সব ওয়েবসাইটে ট্রাফিক যায়। আবার ওয়েবকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপনী কাঠামোও অনেকটাই গুগলের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং, ওয়েবসাইটকেন্দ্রিক বাণিজ্যের কলকাঠি এখন পুরোটাই গুগলের কাঠামোর প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল বললেও ভুল হবে না।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বেশির ভাগই ওয়েব দুনিয়ায় কনটেন্ট খোঁজেন গুগলের সার্চ ইঞ্জিন দিয়ে। সেক্ষেত্রে ব্রাউজারও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয় গুগল ক্রোম। ছবি: রয়টার্স
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বেশির ভাগই ওয়েব দুনিয়ায় কনটেন্ট খোঁজেন গুগলের সার্চ ইঞ্জিন দিয়ে। সেক্ষেত্রে ব্রাউজারও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয় গুগল ক্রোম। ছবি: রয়টার্স

যদিও গুগলকে ঠেকাতে একসময় ইয়াহু বেশ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষে প্রায় হারিয়ে গেছে ইয়াহু’ই। এখন মাইক্রোসফট তাও কিছু লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু গুগলের কাঠামোর কাছে তা খালি চোখে দেখলেও যৎসামান্যই বোধ হবে।

এক কথায়, পুরো ওয়েব সাম্রাজ্যে গুগল হয়ে উঠেছে অঘোষিত সম্রাট। গুগল এতটাই বিশাল ও অনিবার্য হয়ে উঠেছে যে, ওয়েব দুনিয়ায় এই প্রতিষ্ঠান একটি অদৃশ্য জাল বিছিয়ে রেখেছে। একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তাই না চাইলেও এক না এক পর্যায়ে আটকেই যাবেন গুগলের জালে।

গুগল জিরো কী

ইন্টারনেটের দুনিয়ায় এমন একাধিপত্যই সৃষ্টি করছে গুগলের এআই ওভারভিউ সংক্রান্ত শঙ্কা। গুগলের এই নতুন ফিচারে যেহেতু প্রাথমিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা গভীরে থাকা তথ্যও উঠে আসছে, ফলে গুগলের সার্চ ইঞ্জিন থেকে একজন ব্যবহারকারীর বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসতে পারে।

দ্য ভার্জ–এর নিলয় প্যাটেলের দেওয়া তত্ত্ব অনুযায়ী, এই প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসার পাশাপাশি সেটি না ফুরোলেও গুগলের ইচ্ছাতেই তা ঘটতে পারে। গুগল যদি ওয়েব দুনিয়া পুরোপুরি নিজের দখলে নিতে এক্সটার্নাল ওয়েবসাইট বা থার্ড পার্টি ওয়েবসাইটে ট্রাফিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়, তাহলেই চলে আসবে ‘গুগল জিরো’। নিলয় প্যাটেলের তত্ত্ব তাই বলে। তাঁর যুক্তি হলো, যদি গুগল নিজেদের সার্চ ইঞ্জিনেই প্রয়োজনীয় সব তথ্য ব্যবহারকারীদের সরবরাহ করতে থাকে, তবে থার্ড পার্টি ওয়েবসাইটে ট্রাফিক পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশেই কমে আসবে। এবং চাইলেই গুগল তখন থার্ড পার্টি ওয়েবসাইটে ট্রাফিক পাঠানো বন্ধ করে দিতে পারে। আর যেভাবে গুগল নিজেদের এআই সামর্থ্য বাড়াচ্ছে, তাতে ‘গুগল জিরো’ যে আসবে না কখনো, সেটি দাবি করাও আসলে কঠিন।

সোজা কথায়, ফ্রি’তে চা দিয়ে দিয়ে ভোক্তা তৈরির পর যেভাবে চায়ে আসক্ত ভোক্তার কাছে উচ্চমূল্যে চা বিক্রির আয়োজন করে বিদেশি কোম্পানি, গুগল জিরো’র ব্যাপারটা অনেকটা তেমনই। গুগল ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে বিকল্প সামান্যই। তাই চাইলে গুগল এনেই ফেলতে পারে গুগল জিরো। সেটি গায়ের জোরেও করতে পারে গুগল, যেমনটা অনেকটা ফেসবুক করা শুরু করেছে এরই মধ্যে!

Google Zero কী ওয়েব দুনিয়া পাল্টে দেবে

ছবি: এআই দিয়ে তৈরি
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

অনেক বিশ্লেষক বলছেন, গুগল জিরো আসবে কি, এসেই গেছে আসলে। ওয়েবকেন্দ্রিক অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসা এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও হবে বলে তাদের শঙ্কা। অর্থাৎ, পুরো ই-কমার্স ইকোসিস্টেমই বদলে যেতে পারে।

এর প্রভাব কীভাবে পড়ছে, তা নিয়ে পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক একটি জরিপের উল্লেখ করা যাক। এই জরিপ প্রতিষ্ঠান চলতি বছরের ২২ জুলাই একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর শিরোনাম হলো, ‘Google users are less likely to click on links when an AI summary appears in the results’। আমেরিকার ৯০০ জন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ওপর চালানো এই জরিপে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে প্রতি ১০ জনে ৬ জন কমপক্ষে একটি এমন কনটেন্টের গুগল সার্চ করেছেন, যার এআই ওভারভিউ বা এআই জেনারেটেড সামারি তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরও বিশ্লেষণের পর পিউ রিসার্চ সেন্টার দেখেছে যে, যেসব গুগল সার্চে এআই জেনারেটেড সামারি তৈরি হয় না, সেসবের তুলনায়, যেসব গুগল সার্চে এআই জেনারেটেড সামারি তৈরি হয়, সেগুলোতে রেজাল্ট হিসেবে পাওয়া থার্ড পার্টি ওয়েবসাইটের লিংকে ক্লিক করার হার বেশ কম। অর্থাৎ, এআই জেনারেটেড সামারি পাওয়ার পর ব্যবহারকারীরা খুব কমই থার্ড পার্টি ওয়েবসাইটের লিংকে ক্লিক করছেন। বরং এআই জেনারেটেড সামারি দিয়েই তথ্যের ঘাটতি মিটিয়ে ফেলার আগ্রহ ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশি।

পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষকেরা আরও বলছেন, আমেরিকার অনলাইন পাবলিশাররা সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ওয়েব ট্রাফিকে যে ভাটার টান দেখছেন, সেটির অন্যতম প্রধান কারণ গুগলের এই এআই ওভারভিউ। কারণ, এআই ওভারভিউ দেখেই গুগল ইউজাররা সন্তুষ্ট থাকছেন, আসল সোর্সের ওয়েবসাইটে ক্লিক করে সেই তথ্য আরও সুচারুভাবে জানার ইচ্ছা তাদের হচ্ছে না!

এসব তথ্য, উপাত্তে এতটুকু স্পষ্ট যে, ‘গুগল জিরো’ আবির্ভূত হওয়ার সকল প্রেক্ষাপট আসলে ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এখন গুগল যদি সত্যিই ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ‘একের ভেতর সব’ হিসেবে হাজির হতেই চায়, তবে কে বাধা দেবে? বাধা কি আদৌ দিতে পারবে?

উত্তর হলো, না। সেই সক্ষমতা কারও নেই আপাতত। আর ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসার দুনিয়ায় সত্যিই যদি এমন এক মনোপলি কায়েম করে গুগল তথা অ্যালফাবেট, তাহলে ওয়েব দুনিয়া আক্ষরিক অর্থেই পাল্টে যাবে। তখন ওয়েব দুনিয়ার ঈশ্বর হিসেবে পূজিত হতে পারে গুগল। আসলেই সেটি হবে কিনা, তা অবশ্য বলতে পারবে একমাত্র ভবিষ্যতই!

সম্পর্কিত