আবু নওফেল সাজিদ

“রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।”
হ্যাঁ,ঠিক এই কথাই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত ২ ডিসেম্বর বলেছেন। বলা ভালো হুমকি দিয়েছেন। ওই দিনই আমেরিকা ও রাশিয়ার শান্তি আলোচনার কথা থাকলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এর আগেও বহুবার শান্তি আলোচনায় বসা হয়েছে। তবে ফলাফল একই রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জায়গার মতো ইউরোপও এখন আর আগের মতো শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। রাশিয়ার নানা হুমকি এবং বন্ধুপ্রতীম দেশ আমেরিকার হাত ছেড়ে দেওয়ার শঙ্কায় ইউরোপজুড়ে ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে। এর মাঝেই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভিন্ন পথে হাঁটা শুরু করেছে মহাদেশটি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপে সামরিক ব্যয়ে নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। কিন্তু রাশিয়ার ভয় কিংবা আধুনিক এই সময়ের রূপরেখায় সে বাজেট কতটা গুরুত্বপূর্ণ? যুদ্ধ তো রাশিয়া-ইউক্রেন করছে, তাহলে ইউরোপের কপালে কেন চিন্তার ভাঁজ? যদি সামরিক বাজেট বাড়ানো হয় তাহলে এর চূড়ান্ত লক্ষ্য-ই বা কী?
বাজেট ও চিন্তা
গল্পের শুরুটা স্নায়ুযুদ্ধের পরের সময়ের। ওই সময়ে সামরিক বাজেট এত ছিল না ইউরোপে। তখন ইউরোপে সামরিক বাজেট বৃদ্ধির কোনো তাড়াও ছিল না।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় অনেক বেড়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী মোট সামরিক ব্যয়ের মাত্রাও বেড়েছে।
এই ব্যয় বৃদ্ধির মূল কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে অনেকাংশে ধরা হয়। কারণ, এ যুদ্ধ আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
বিশেষ করে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলো যেমন, পোল্যান্ড ও রোমানিয়া প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছে। একই সঙ্গে ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোও সামরিকায়নে জোর দিয়েছে।
যদি আমরা একটু সমীক্ষার দিকে নজর দিই, তাহলে আমরা দেখব, জিডিপির অনুপাতে সামরিক ব্যয়ে ইউরোপে শীর্ষে রয়েছে পোল্যান্ড। এ বছর দেশটি সামরিক খাতে প্রায় ৫৯ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার বাজেট রেখেছে।
যদিও বিষয়টি অনেকটা অনুমিতই ছিল। কারণ, ২০১৯ সালের পর থেকে পোল্যান্ড প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ইউরো (১৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি) সামরিক খাতে ঢেলেছে। এর মাধ্যমে তারা ইউরোপের অন্য দেশগুলোর চেয়ে বৃহৎ অস্ত্র চুক্তি করেছে।

অন্যদিকে জার্মান সেনাবাহিনীকে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী করার লক্ষ্যে ৫২ বিলিয়ন পাউন্ড বা ৬৯ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার সামরিক চুক্তির অনুমোদন দেওয়ার কথা রয়েছে। আর বাজেটটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে পোশাক থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও স্যাটেলাইটসহ সবকিছুই কেনা হবে।
ইউরোপ আধুনিক অস্ত্র, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সামরিক বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে–বিষয়টি শুধু এমনই নয়। মহাদেশটি ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করা এবং নতুন করে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
ইউরোপীয় দেশগুলো এই সংকটের ওপরে ইতোমধ্যে পদক্ষেপও নেওয়া শুরু করেছে।
ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় ২০২২ সালের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী পাঁচ বছরে যা প্রতি বছর ৫০০ বিলিয়ন থেকে ৭০০ বিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত বাড়বে।
যদিও স্পেন ও ইতালির মতো কিছু দেশ পিছিয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে ফ্রান্স ও ব্রিটেন সামরিক ব্যয়ে জিডিপির ৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। তবে পোল্যান্ড ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, তারা ২০২৬ সালে জিডিপির ৪ দশমিক ৮ শতাংশ খরচ করবে।
পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী জার্মানি ২০২৯ সালের মধ্যে সামরিক ব্যয় জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীতের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, জার্মান সামরিক বাহিনী ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী হয়ে উঠবে।
ইউরোপের সামগ্রিকভাবে পদক্ষেপ
ইউরোপীয় কমিশন ১৭৪ বিলিয়ন ডলারের নিরপত্তা-বিষয়ক তহবিল চালু করেছে। যদিও এ বাজট কতখানি ফলপ্রসূ কিংবা তা দিয়ে ইউরোপের নিরাপত্তা কতখানি পুরণ করা যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে এমন পদক্ষেপের বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। তহবিলের মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো কম সুদে ঋণ নিয়ে প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে। বিশেষ করে সামরিক সরঞ্জাম কেনা এবং সামরিক ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তহবিলটি কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
এই তহবিল নিয়ে নানা সংশয়ে থাকা সত্ত্বেও গত ৩০ নভেম্বর তহবিলের প্রাথমিক আবেদনের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর ১৯টি দেশ আবেদন করেছে। অদ্ভুত হলেও সত্য শুধু পোল্যান্ডই ৫০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে।

তহবিলটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামরিক ব্যয় বাড়ানোর আরেকটি প্রধান পরিকল্পনা, যা ‘রেডিনেস ২০৩০’ নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনা দেশগুলোকে আগামী চার বছরে তাদের জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ দেয়। পাশাপাশি ইইউ-এর সামরিক আইন ভঙ্গ করবে না এই তহবিলের কার্যক্রম।
ইতোমধ্যে জার্মানিসহ ১৬টি দেশ এই পরিকল্পনায় সই করেছে। এই আইনে আরও প্রায় প্রায় ৮৭৩ বিলিয়ন ডলার সামরিক ব্যয় যোগ করতে পারে।
গত জুনে ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যরা ২০৩৫ সালের মধ্যে সামরিক বাজেট জিডিপির ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত অবকাঠামোতে আরও ১ দশমিক ৫ শতাংশ খরচ করা হবে।
ভয় বা শঙ্কার কারণ
ভয় কিংবা শঙ্কা, যাই বলা হোক না কেন এর পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকলেও আমেরিকার ভিন্ন পথে হাঁটাই মূল কারণ। আমেরিকা ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার খরচ ইউরোপকে বহন করতে বলছে। এ ছাড়া আমেরিকা এশিয়া-প্যাসিফিকে তাদের সৈন্য স্থানান্তরের কথা ভাবছে।
রাশিয়া যুদ্ধর জন্য তাদের সামরিক অর্থনীতি জোরদার করেছে। লন্ডনের থিঙ্কট্যাঙ্ক আইআইএসএস মনে করে রাশিয়া ২০২৭ সালের মধ্যেই ইউরোপের জন্য সরাসরি হুমকি তৈরি করতে পারে।
আইআইএসএস সতর্ক করে জানিয়েছে, রাশিয়ার অর্থনীতি ইউরোপের মাত্র দশ ভাগের এক ভাগ হলেও এ বছর তারা ন্যাটোর সমপরিমাণ খরচ করবে।
থিঙ্কট্যাঙ্কটি আরও সতর্ক করে জানায়, ইউরোপকে আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে সামরিক সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এর মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, বিমান পরিবহন, দূরপাল্লার অস্ত্র এবং অত্যাধুনিক ক্লাউড-কম্পিউটিং ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যবস্থা তৈরির জন্য প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার লাগতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউরোপের অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথমে আছে ইউক্রেনকে সমর্থন। বিশেষ করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহের মাধ্যমে ইউক্রেনকে সহায়তা করা। দ্বিতীয়ত ইউরোপের নিজস্ব যুদ্ধ-সক্ষমতা পুনরুদ্ধার এবং একটি সমন্বিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা। আর একদম শেষে আমেরিকার বিকল্প সক্ষমতা তৈরি করা। কেননা মহাদেশটি অনেকাংশে তার পশ্চিমা মিত্র আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল।

আধুনিক এই যুগে কোনো একটি পেশায় যুক্ত হয়ে থাকা যেমন বুদ্ধিমানের কাজ নয়, তেমনি একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য কোনো এক বন্ধু দেশের ওপর নির্ভর করা আত্মহত্যার শামিল। আর সে জায়গায় ৪৪টি দেশ নিয়ে গঠিত একটি মহাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো বিরাট ব্যাপার।
ঘনিষ্ঠ মিত্র আমেরিকার কাছ থেকে আশ্বাসের পাশাপাশি বেশ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকলেও ভবিষ্যতে কতটা বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করবে আমেরিকা, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এমন সময়ে কোনো জোটই হয়তো চাইবে না একটি শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকতে।
নিজেদের নিরাপত্তা সমস্যা নিয়ে অস্ত্রসহ সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়তো দোষের কিছু নয়। তবে এটা কি নিছকেই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা, নাকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব-প্রস্তুতি–সে প্রশ্ন থেকেই যায়!

“রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।”
হ্যাঁ,ঠিক এই কথাই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত ২ ডিসেম্বর বলেছেন। বলা ভালো হুমকি দিয়েছেন। ওই দিনই আমেরিকা ও রাশিয়ার শান্তি আলোচনার কথা থাকলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এর আগেও বহুবার শান্তি আলোচনায় বসা হয়েছে। তবে ফলাফল একই রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জায়গার মতো ইউরোপও এখন আর আগের মতো শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। রাশিয়ার নানা হুমকি এবং বন্ধুপ্রতীম দেশ আমেরিকার হাত ছেড়ে দেওয়ার শঙ্কায় ইউরোপজুড়ে ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে। এর মাঝেই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভিন্ন পথে হাঁটা শুরু করেছে মহাদেশটি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপে সামরিক ব্যয়ে নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। কিন্তু রাশিয়ার ভয় কিংবা আধুনিক এই সময়ের রূপরেখায় সে বাজেট কতটা গুরুত্বপূর্ণ? যুদ্ধ তো রাশিয়া-ইউক্রেন করছে, তাহলে ইউরোপের কপালে কেন চিন্তার ভাঁজ? যদি সামরিক বাজেট বাড়ানো হয় তাহলে এর চূড়ান্ত লক্ষ্য-ই বা কী?
বাজেট ও চিন্তা
গল্পের শুরুটা স্নায়ুযুদ্ধের পরের সময়ের। ওই সময়ে সামরিক বাজেট এত ছিল না ইউরোপে। তখন ইউরোপে সামরিক বাজেট বৃদ্ধির কোনো তাড়াও ছিল না।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় অনেক বেড়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী মোট সামরিক ব্যয়ের মাত্রাও বেড়েছে।
এই ব্যয় বৃদ্ধির মূল কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে অনেকাংশে ধরা হয়। কারণ, এ যুদ্ধ আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
বিশেষ করে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলো যেমন, পোল্যান্ড ও রোমানিয়া প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছে। একই সঙ্গে ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোও সামরিকায়নে জোর দিয়েছে।
যদি আমরা একটু সমীক্ষার দিকে নজর দিই, তাহলে আমরা দেখব, জিডিপির অনুপাতে সামরিক ব্যয়ে ইউরোপে শীর্ষে রয়েছে পোল্যান্ড। এ বছর দেশটি সামরিক খাতে প্রায় ৫৯ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার বাজেট রেখেছে।
যদিও বিষয়টি অনেকটা অনুমিতই ছিল। কারণ, ২০১৯ সালের পর থেকে পোল্যান্ড প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ইউরো (১৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি) সামরিক খাতে ঢেলেছে। এর মাধ্যমে তারা ইউরোপের অন্য দেশগুলোর চেয়ে বৃহৎ অস্ত্র চুক্তি করেছে।

অন্যদিকে জার্মান সেনাবাহিনীকে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী করার লক্ষ্যে ৫২ বিলিয়ন পাউন্ড বা ৬৯ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার সামরিক চুক্তির অনুমোদন দেওয়ার কথা রয়েছে। আর বাজেটটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে পোশাক থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও স্যাটেলাইটসহ সবকিছুই কেনা হবে।
ইউরোপ আধুনিক অস্ত্র, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সামরিক বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে–বিষয়টি শুধু এমনই নয়। মহাদেশটি ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করা এবং নতুন করে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
ইউরোপীয় দেশগুলো এই সংকটের ওপরে ইতোমধ্যে পদক্ষেপও নেওয়া শুরু করেছে।
ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় ২০২২ সালের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী পাঁচ বছরে যা প্রতি বছর ৫০০ বিলিয়ন থেকে ৭০০ বিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত বাড়বে।
যদিও স্পেন ও ইতালির মতো কিছু দেশ পিছিয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে ফ্রান্স ও ব্রিটেন সামরিক ব্যয়ে জিডিপির ৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। তবে পোল্যান্ড ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, তারা ২০২৬ সালে জিডিপির ৪ দশমিক ৮ শতাংশ খরচ করবে।
পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী জার্মানি ২০২৯ সালের মধ্যে সামরিক ব্যয় জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীতের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, জার্মান সামরিক বাহিনী ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী হয়ে উঠবে।
ইউরোপের সামগ্রিকভাবে পদক্ষেপ
ইউরোপীয় কমিশন ১৭৪ বিলিয়ন ডলারের নিরপত্তা-বিষয়ক তহবিল চালু করেছে। যদিও এ বাজট কতখানি ফলপ্রসূ কিংবা তা দিয়ে ইউরোপের নিরাপত্তা কতখানি পুরণ করা যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে এমন পদক্ষেপের বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। তহবিলের মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো কম সুদে ঋণ নিয়ে প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে। বিশেষ করে সামরিক সরঞ্জাম কেনা এবং সামরিক ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তহবিলটি কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
এই তহবিল নিয়ে নানা সংশয়ে থাকা সত্ত্বেও গত ৩০ নভেম্বর তহবিলের প্রাথমিক আবেদনের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর ১৯টি দেশ আবেদন করেছে। অদ্ভুত হলেও সত্য শুধু পোল্যান্ডই ৫০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে।

তহবিলটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামরিক ব্যয় বাড়ানোর আরেকটি প্রধান পরিকল্পনা, যা ‘রেডিনেস ২০৩০’ নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনা দেশগুলোকে আগামী চার বছরে তাদের জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ দেয়। পাশাপাশি ইইউ-এর সামরিক আইন ভঙ্গ করবে না এই তহবিলের কার্যক্রম।
ইতোমধ্যে জার্মানিসহ ১৬টি দেশ এই পরিকল্পনায় সই করেছে। এই আইনে আরও প্রায় প্রায় ৮৭৩ বিলিয়ন ডলার সামরিক ব্যয় যোগ করতে পারে।
গত জুনে ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যরা ২০৩৫ সালের মধ্যে সামরিক বাজেট জিডিপির ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত অবকাঠামোতে আরও ১ দশমিক ৫ শতাংশ খরচ করা হবে।
ভয় বা শঙ্কার কারণ
ভয় কিংবা শঙ্কা, যাই বলা হোক না কেন এর পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকলেও আমেরিকার ভিন্ন পথে হাঁটাই মূল কারণ। আমেরিকা ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার খরচ ইউরোপকে বহন করতে বলছে। এ ছাড়া আমেরিকা এশিয়া-প্যাসিফিকে তাদের সৈন্য স্থানান্তরের কথা ভাবছে।
রাশিয়া যুদ্ধর জন্য তাদের সামরিক অর্থনীতি জোরদার করেছে। লন্ডনের থিঙ্কট্যাঙ্ক আইআইএসএস মনে করে রাশিয়া ২০২৭ সালের মধ্যেই ইউরোপের জন্য সরাসরি হুমকি তৈরি করতে পারে।
আইআইএসএস সতর্ক করে জানিয়েছে, রাশিয়ার অর্থনীতি ইউরোপের মাত্র দশ ভাগের এক ভাগ হলেও এ বছর তারা ন্যাটোর সমপরিমাণ খরচ করবে।
থিঙ্কট্যাঙ্কটি আরও সতর্ক করে জানায়, ইউরোপকে আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে সামরিক সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এর মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, বিমান পরিবহন, দূরপাল্লার অস্ত্র এবং অত্যাধুনিক ক্লাউড-কম্পিউটিং ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যবস্থা তৈরির জন্য প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার লাগতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউরোপের অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথমে আছে ইউক্রেনকে সমর্থন। বিশেষ করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহের মাধ্যমে ইউক্রেনকে সহায়তা করা। দ্বিতীয়ত ইউরোপের নিজস্ব যুদ্ধ-সক্ষমতা পুনরুদ্ধার এবং একটি সমন্বিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা। আর একদম শেষে আমেরিকার বিকল্প সক্ষমতা তৈরি করা। কেননা মহাদেশটি অনেকাংশে তার পশ্চিমা মিত্র আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল।

আধুনিক এই যুগে কোনো একটি পেশায় যুক্ত হয়ে থাকা যেমন বুদ্ধিমানের কাজ নয়, তেমনি একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য কোনো এক বন্ধু দেশের ওপর নির্ভর করা আত্মহত্যার শামিল। আর সে জায়গায় ৪৪টি দেশ নিয়ে গঠিত একটি মহাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো বিরাট ব্যাপার।
ঘনিষ্ঠ মিত্র আমেরিকার কাছ থেকে আশ্বাসের পাশাপাশি বেশ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকলেও ভবিষ্যতে কতটা বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করবে আমেরিকা, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এমন সময়ে কোনো জোটই হয়তো চাইবে না একটি শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকতে।
নিজেদের নিরাপত্তা সমস্যা নিয়ে অস্ত্রসহ সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়তো দোষের কিছু নয়। তবে এটা কি নিছকেই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা, নাকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব-প্রস্তুতি–সে প্রশ্ন থেকেই যায়!