ডেনিসোভান: আধুনিক মানুষের এই রহস্যময় নিকটাত্মীয় আসলে কারা?

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
ডেনিসোভান: আধুনিক মানুষের এই রহস্যময় নিকটাত্মীয় আসলে কারা?
প্রতীকী ছবি। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

মানব ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বর্তমান মানুষের প্রজাতি ‘হোমো সেপিয়েন্স’ পৃথিবীর বুকে একা ছিল না। এই প্রজাতির খুব কাছাকাছি আরও কিছু মানব প্রজাতি একসময় পৃথিবীতে বিচরণ করত, যাদের অন্যতম হলো ডেনিসোভান।

ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়, হোমিনিন বা প্রাচীন মানব প্রজাতির ইতিহাসের শুরুটা হয়েছিল আফ্রিকায়। সেখান থেকে প্রথম যে প্রজাতিটি বাইরের পৃথিবীতে পা রাখে, তা হলো ‘হোমো ইরেক্টাস’। প্রায় ১.৮ মিলিয়ন বছর আগে তারা বর্তমান জর্জিয়া অঞ্চলে বসবাস শুরু করে এবং দ্রুতই পূর্ব দিকে ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আসে নিয়ানডারথালরা (হোমো নিয়ানডারথালেনসিস), যারা মূলত ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করে। ঠিক একই সময়ে পূর্ব এশিয়ায় বসবাস করত ডেনিসোভানরা।

বর্তমান মানব প্রজাতি ‘হোমো সেপিয়েন্স’-এর উদ্ভব ঘটে সবার শেষে, অন্তত ২ থেকে ৩ লাখ বছর আগে আফ্রিকায়। তারা বিভিন্ন পর্যায়ে আফ্রিকা ত্যাগ করে এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তবে অন্য প্রজাতিগুলোকে পুরোপুরি হটিয়ে দেওয়ার আগে, হোমো সেপিয়েন্সরা নিয়ানডারথাল ও ডেনিসোভানদের সাথে প্রজনন প্রক্রিয়ায় মিলিত হয়েছিল। যার প্রমাণ আজও আমাদের ডিএনএ-তে বিদ্যমান। বিশেষ করে ফিলিপাইনের ‘আইতা’ জনগোষ্ঠী এবং পাপুয়া নিউ গিনিসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের মধ্যে ডেনিসোভান ডিএনএ-র ব্যাপক উপস্থিতি পাওয়া যায়।

২০০৮ সালে সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহায় ৩০ থেকে ৬০ হাজার বছর পুরনো একটি শিশুর আঙুলের হাড়ের টুকরো পাওয়া যায়। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী সভান্তে প্যাবো-র নেতৃত্বে গবেষক দল সেই হাড় থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করেন। পরীক্ষায় দেখা যায়, এই ডিএনএ-র সাথে নিয়ানডারথাল কিংবা আধুনিক মানুষ কারও মিল নেই। এভাবেই উন্মোচিত হয় এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ও প্রাচীন প্রজাতি—ডেনিসোভান।

দীর্ঘদিন ডেনিসোভানদের চেহারা কেমন ছিল, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মনে প্রশ্ন ছিল। কারণ তাদের মাত্র ১২টি ক্ষুদ্র হাড়ের টুকরো পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালে চীনের গবেষক নি সিজুন-এর দল ‘হারবিন স্কাল’ বা হারবিনের খুলি সামনে আনলে রহস্যের জট খুলতে শুরু করে।

১ লাখ ৪৬ হাজার বছরের পুরনো এই খুলিটি বিশাল মস্তিস্কের কারণে সেপিয়েন্সদের কথা মনে করিয়ে দিলেও এর ভুরুর গঠন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। গবেষকরা প্রথমে একে ‘হোমো লংগি’ বা ‘ড্রাগন ম্যান’ নামে একটি নতুন প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এই খুলিটি আসলে একজন ডেনিসোভানের। খুলির দাঁতের প্লাক থেকে পাওয়া প্রোটিন ও ডিএনএ ডেনিসোভানদের প্রোফাইলের সাথে হুবহু মিলে গেছে। ফলে প্রথমবারের মতো ডেনিসোভানদের একটি সম্ভাব্য চেহারা খুঁজে পেল বিশ্ব।

ডেনিসোভানদের নিয়ে গবেষণায় বর্তমানে একটি বড় ধাঁধার সৃষ্টি হয়েছে। ডিএনএ বিশ্লেষণ বলছে, ডেনিসোভান ও নিয়ানডারথালরা একই বংশধারার ছিল। প্রায় ৫ থেকে ৮ লাখ বছর আগে তারা আধুনিক মানুষের (সেপিয়েন্স) থেকে আলাদা হয়ে যায়। এই যৌথ গোষ্ঠীটিকে অনেক সময় ‘নিয়ানডারসোভান’ বলা হয়। পরে তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে একদল পশ্চিমে (নিয়ানডারথাল) এবং একদল পূর্বে (ডেনিসোভান) চলে যায়।

কিন্তু হারবিনের খুলি বা শারীরিক গঠন নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের দাবি ভিন্ন। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ক্রিস স্ট্রিংগার মনে করেন, ‘লংগি’ বা ডেনিসোভানরা নিয়ানডারথালদের চেয়ে সেপিয়েন্সদের বেশি কাছাকাছি।

জেনেটিক্সবিদদের মতে, ডিএনএ বিশ্লেষণই প্রজাতি নির্ধারণের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়। তবে জীবাশ্ম নৃবিজ্ঞানী জন হকস একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, ডেনিসোভানরা যখন এশিয়ায় পৌঁছায়, তখন সেখানে আগে থেকেই থাকা ‘ইরেক্টাস’ সদৃশ আদিম মানুষের সাথে তাদের সংমিশ্রণ ঘটে থাকতে পারে। এই আন্তঃপ্রজাতিক প্রজননের ফলেই তাদের শারীরিক গঠনে প্রাচীন বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে, যা ডিএনএ তথ্যের সাথে কিছুটা সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে।

ডেনিসোভানদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পেতে বিজ্ঞানীদের আরও অনেক জীবাশ্ম ও ডিএনএ নমুনা প্রয়োজন। তবে সাম্প্রতিক সাফল্যগুলো প্রমাণ করেছে যে, আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে নগণ্য পরিমাণ উপাদান থেকেও প্রাচীন মানুষের ইতিহাস উদ্ধার করা সম্ভব। ডেনিসোভানরা কেবল পূর্বপুরুষদের সঙ্গীই ছিল না, তারা আমাদের জেনেটিক ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আজও টিকে আছে।

সম্পর্কিত