ঢাকা কি হয়ে উঠছে দারিদ্র্যের ফাঁদ?

ঢাকা কি হয়ে উঠছে দারিদ্র্যের ফাঁদ?
জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ঢাকা। ছবি: চরচা

দীর্ঘ সাত দশক ধরে টোকিওকে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান সেই ধারণা পাল্টে দিয়েছে।  এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা। সেখানে বসবাস করে প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ, যা কানাডার মোট জনসংখ্যার কাছাকাছি। এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, যার জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগের ‘ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টস ২০২৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঢাকার জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম একটি কারণ হলো কাজের সন্ধানে বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে গ্রাম থেকে আসা মানুষের ঢল।

টোকিও আছে তিন নম্বরে। সেখানকার জনসংখ্যা ৩ কোটি ৩০ লাখ। শীর্ষ পাঁচে আরও রয়েছে দিল্লি ও সাংহাই। প্রতিটি শহরেই বাস করে প্রায় ৩ কোটি মানুষ।

জাপানের টোকিও শহর। ছবি: রয়টার্স
জাপানের টোকিও শহর। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের শীর্ষ ১০ জনবহুল শহরের মধ্যে মাত্র একটি এশিয়ার বাইরে। আর ১০ মিলিয়নের বেশি জনসংখ্যার ৩৩টি ‘মেগাসিটি’-এর মধ্যে মাত্র সাতটি ধনী দেশে অবস্থিত। পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে শুধু জাকার্তা ও ঢাকাতেই আরও ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ যোগ হবে, যা অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার কাছাকাছি।

এই শহরমুখী যাত্রা বহু মানুষের জীবন বদলে দিচ্ছে। যেমন, ২০২২ সালে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসা ক্লিনটন চাকমা বলেন, “ঢাকা আমার জীবন বদলে দিয়েছে, আমার সন্তানদের পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছে।”

কিন্তু একই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে বড় ঝুঁকি। দ্রুত ও অপরিকল্পিত বিস্তারের ফলে দারিদ্র্য, দূষণ, যানজট ও বাসযোগ্যতার সংকট শহরগুলোর অর্থনৈতিক সুবিধাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলাইন বার্টডের ভাষায়, মানুষ শহরে আসে শ্রমবাজারের সুযোগ নিতে। কিন্তু যদি সেই শ্রমবাজার ঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে শহরই হয়ে ওঠে দারিদ্র্যের ফাঁদ।

এর প্রতিফলন দেখা যায় বাসযোগ্যতার সূচকে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তালিকায় জাকার্তা, ঢাকা ও দিল্লি বিশ্বের সবচেয়ে কম বাসযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে। ১৭৩টি শহরের মধ্যে জাকার্তার অবস্থান ১৩২, দিল্লির ১৪৫ এবং ঢাকা নিচের দিক থেকে তৃতীয়। ঢাকার চেয়ে কমবাসযোগ্য শহর শুধু সিরিয়ার দামেস্ক ও লিবিয়ার ত্রিপোলি।

এই সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে শহুরে প্রশাসনের অকার্যকর ও খণ্ডিত কাঠামো। জাকার্তায় বোগর, দেপোক, তাঙ্গেরাং ও বেকাসিকে কার্যত এক শহরে পরিণত করলেও এসব এলাকার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নেই। ফলে একটি বিশাল জনবসতি কার্যত অসংগঠিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

এর সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ যানজট। জাকার্তা বিশ্বের ১২তম, দিল্লি সপ্তম এবং ঢাকা তৃতীয় সবচেয়ে যানজটপূর্ণ শহর। কর্মস্থলের কাছে বাসা কেনার সামর্থ্য না থাকায় মানুষ দূরের উপশহরে থাকতে বাধ্য হয়। দুর্বল গণপরিবহন ব্যবস্থার কারণে তারা ব্যক্তিগত যানবাহনের ওপর নির্ভর করে, যা যানজট ও বায়ুদূষণ বাড়ায়। জাকার্তা সরকারের হিসাব অনুযায়ী, যানজটের কারণে শহরটি বছরে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ে।

২০১৯ সালে জাকার্তা প্রথম মেট্রো পেলেও সেটি শহরের প্রশাসনিক সীমানায় গিয়ে থেমে যায়, ফলে উপশহর থেকে আসা যাত্রীদের খুব একটা উপকার হয়নি। শহর কর্তৃপক্ষের মতে, আশপাশের এলাকাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় না হলে এমন অবকাঠামো কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে।

ঢাকার শাসনব্যবস্থা আরও বেশি বিভক্ত। এখানে রয়েছে দুটি সিটি কর্পোরেশন, একটি জাতীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, একাধিক মন্ত্রণালয় ও ডজনখানেক সংস্থা। তারা যারা পানি, নর্দমা, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে আলাদাভাবে দায়িত্ব পালন করে। একসময় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এক মেয়র অভিযোগ করেছিলেন, শহরের ৮০ শতাংশ সমস্যার যেমন যানজট ও জলাবদ্ধতা সমাধানের ক্ষমতাই তার হাতে নেই।

ঢাকার একটি রাস্তায় তীব্র যানজট। ছবি: রয়টার্স
ঢাকার একটি রাস্তায় তীব্র যানজট। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বব্যাংক বলছে, ভারতের দিল্লি ও কলকাতাতেও একই চিত্র। দিল্লিতে পৌরসভা, রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার মধ্যে ক্ষমতা বিভক্ত। আর কলকাতা মেট্রোপলিটন এলাকায় রয়েছে অন্তত ৪২৩টি ভিন্ন শাসনকারী সত্তা।

এই প্রেক্ষাপটে দুটি ভিন্ন মডেল উল্লেখযোগ্য। সাংহাই কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে একটি প্রাদেশিক শহর হিসেবে পরিচালিত হয়। পরিকল্পনা থেকে পরিবহন সবখানেই রয়েছে শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ। তবে চীনের শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক দেশের জন্য সহজে অনুকরণযোগ্য নয়।

অন্যদিকে, টোকিও একটি তুলনামূলকভাবে বাস্তবসম্মত মডেল। টোকিও মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট বড় সেবাগুলোর দায়িত্ব নেয়, আর এর অধীন ২৩টি বিশেষ ওয়ার্ড ও আশপাশের শহরগুলো স্থানীয় সেবা পরিচালনা করে। জাতীয় সরকার এখানে সমন্বয়কের ভূমিকা রাখে। বর মেট্রো ও কমিউটার রেল নেটওয়ার্ক পুরো অঞ্চলকে যুক্ত করেছে। ফলে গ্রেটার টোকিও এলাকার ৯০ শতাংশ মানুষ স্টেশন থেকে মাত্র ২০ মিনিট হাঁটার দূরত্বে বাস করে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, টোকিও নিঃসন্দেহে ঢাকার চেয়ে অনেক ধনী শহর। কিন্তু জাকার্তা, ঢাকা বা দিল্লিকে আরও বাসযোগ্য করার জন্য শুরুটা বিশাল অবকাঠামো বিনিয়োগ দিয়ে নয়, বরং শাসনব্যবস্থার সংস্কার দিয়েই করা সম্ভব। ক্ষমতার কাঠামো বদলানো কঠিন, রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল, কিন্তু এর সুফল হতে পারে বহু গুণ বেশি। মধ্যম আয়ের ফাঁদ এড়াতে চাইলে এশিয়ার মেগাসিটিগুলোর সামনে এই পথেই হাঁটা ছাড়া বিকল্প নেই।

তথ্যসূত্র: ইকোনমিষ্ট, আল জাজিরা, রয়টার্স, জাতিসংঘের ওয়েবসাইট

সম্পর্কিত