৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১

বন্ধ হয় পাকিস্তানের শেষ সুযোগ

বন্ধ হয় পাকিস্তানের শেষ সুযোগ
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যে যুদ্ধ অন্যায়ভাবে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানিরা, সাড়ে আট মাসের মধ্যে সে যুদ্ধে পরাজয় সুস্পষ্ট দেখতে পায় তারা। প্রতীকী ছবি: চরচা

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা একাত্তরের দিনগুলিতে ৯ ডিসেম্বরে লিখেছেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের আমাদের চেনাজানা প্রায় সবাই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা উঠিয়ে রাখছে। আর ন্যাশনাল ডিফেন্স সার্টিফিকেট ব্যাঙ্কে জমা রেখে তার বদলে নগদ টাকা ‘ধার’ নিচ্ছে। সবাই বলছে, কখন কি হয়, শেষে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে পারি কি না। ব্যাটাদের দিন তো ঘনিয়ে এল। হয়তো বা যাবার আগে ব্যাঙ্কের সব টাকাও জ্বালিয়ে দিতে পারে, প্লেনে করে ওদিকে নিয়েও যেতে পারে। তার চেয়ে যতটা পারা যায় নগদ টাকা কাছে থাকুক।”

জাহানারা ইমামের মতো লক্ষ-কোটি বাঙালি যেমন বুঝতে পারছিলেন বিজয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে, তেমনি পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পাকিস্তান ও দেশটির মিত্ররা। এদিন, যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে আরও একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করে, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তা তৃতীয়বারের মতো ভেটো প্রদান করে তা নাকচ করে দেয়। ফলে আন্তর্জাতিক আইনগত পথে যুদ্ধ থামানোর পাকিস্তানের শেষ সুযোগটিও বন্ধ হয়ে যায়।

বিজয় প্রায় নিশ্চিত বুঝতে পেরে কাজের গতি বেড়ে যায় বাংলাদেশ সরকারের। মুজিবনগরের এদিন সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

বাংলাদেশে জনগণের হাতে ধরা পড়া পাকিস্তানি সেনাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এদিন বাংলাদেশ সরকার নির্দেশ দেয়। নির্দেশে বলা হয়, ধৃত পাকিস্তানিদের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করা হবে এবং পাকিস্তান থেকে পাঁচ লাখ বাঙালিকে নিরাপদে স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে।

বাংলাদেশ সরকার এদিন সেনানিবাস বাদে মুক্ত কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা চালু করে। ৯ মাস পর সেখানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসে। কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যারা পাকিস্তানি বেয়নেটের মুখে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। পুলিশের দায়িত্ব নেয় মুক্তিবাহিনী।

দিল্লিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মিশন। বাংলাদেশের পতাকা তুলে উদ্বোধন করেন মিশনপ্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ভারতকে কৃতজ্ঞতা জানান।

এদিকে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশিদের অপসারণের জন্য ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিদেশি বিমান নির্বিঘ্নে অবতরণের সুবিধা দিতে ভারত সম্মত হয়। এ জন্য ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিমানবন্দরে কোনো আক্রমণ না চালাতে ভারতীয় বিমানবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণের মাত্রা আরও বাড়াতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক কমান্ড গঠন করা হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রণকৌশল ঠিক করতে কয়েক দিন আলাপ-আলোচনার পর দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তির ভিত্তিতে এই সামরিক যুদ্ধ কমান্ড গঠন করা হয়। ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ঘোষণায় আরও বলা হয়, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী একযোগে কাজ করবে। পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। দায়িত্ব থাকবে ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডে।

এরই মধ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয়ে গেছে। চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। একটি দল ঢুকছে আশুগঞ্জ দিয়ে ভৈরব বাজার হয়ে। আশুগঞ্জে যুদ্ধে নতি স্বীকার করে মেঘনার বিরাট রেলসেতু ভেঙে দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। আরেকটা দল এগোয় দাউদকান্দির দিক দিয়ে। সেখান থেকেও পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যায়। উত্তর দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যায় জামালপুর হয়ে। পশ্চিমে যৌথ বাহিনী মধুমতির তীরে। সেটি পেরোলেই পদ্মা। কুষ্টিয়ার দিক থেকে আরেকটি বাহিনী এগোয় গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। চূড়ান্ত লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা মিত্রবাহিনীর সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী। এমন অবস্থাতেই ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে বলেন, ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাঁচতে চাইলে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

তথ্যসূত্র—

  • বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, এইচ. টি. ইমাম
  • একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম
  • একাত্তরের দিনপঞ্জি, রাশেদুর রহমান, সাজ্জাদ শরিফ
  • মুক্তিযুদ্ধ ই আর্কাইভ

সম্পর্কিত